স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা ডেস্ক: মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই, চিকিৎসকদের এই বার্তা এখন ক্ষীণ হয়ে আসছে। কেননা ফর্মুলা দুধে বাজার সয়লাব। বাংলাদেশের সিংহভাগ যেখানে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়াতে পছন্দ করেন সেখানে এখন তারা ফর্মুলা দুধের দিকে ঝুঁকছেন। বিশেষ করে কর্মজীবী নারীরা। কোম্পানিগুলোর বিপণন কৌশল ভয় আর সন্দেহ তৈরি করছে নবজাতকের মায়ের মনে। অনেক সময় মায়ের দুধের অপর্যাপ্ততার কথা বলেও বিভ্রান্ত করা হয়। এ ধরনের পরামর্শ স্পষ্টত আইনের লঙ্ঘন বলছেন বিশেষজ্ঞরা। একটি শিশু জন্মের পর থেকে পরবর্তী ৬ মাস শুধু মায়ের দুধ খাওয়াতে হয়। এই সময়কালকে বলা হয় এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং। জন্মের প্রথম ঘণ্টায় মায়ের দুধ খাওয়ানো, এরপর ছয় মাস পর্যন্ত এবং এর ধারাবাহিকতায় দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে মায়ের দুধ খাওয়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন চিকিৎসকরা। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাপী ৬ মাসের কম বয়সী শিশুদের মাত্র ৪৪ শতাংশকে শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো হয়। গত দুই দশকে শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার খুব সামান্যই বেড়েছে, অন্যদিকে, প্রায় একই সময়ে ফর্মুলা দুধের বিক্রি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। তবে যদি কোনো চিকিৎসক, নার্স কিংবা যে কেউ মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ানোর পরামর্শ দেয় তাহলে আন্তর্জাতিকভাবেও আইনগত অপরাধ বলে গণ্য হবে।
যে কোনো ফার্মেসিতে গেলে হরহামেশাই চোখে পড়ে সদ্যজাত শিশুর জন্য তার স্বজনরা ফর্মুলা দুধ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। মায়ের দুধ ছাড়া ফর্মুলা দুধ কেন এমন প্রশ্নে তারা বলেন, শিশু মায়ের দুধ পাচ্ছে না, কান্না করছে, তাই বিকল্প হিসেবে ফর্মুলা দুধ কেনা। দেড় বছর বয়সী শিশু প্রমীকে জন্মের পর থেকেই ফর্মুলা দুধ খাইয়েছেন তার মা। প্রমীর মায়ের ভাষ্য, জন্মের পর থেকে প্রমী ঠিকমত বুকের দুধ পেতো না। শুরুতে ফর্মুলা দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। পরবর্তীতে বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেও মেয়েকে খাওয়াতে পারেননি তিনি। মেয়ে এই ফর্মুলা দুধ-ই পছন্দ করেছে, মায়ের দুধ আর খেতে চাইতো না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মের প্রথম ঘণ্টা থেকে দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে বুকের দুধ খাওয়ানো হলে তা শীর্ণকায় হয়ে যাওয়া বা স্থূলতায় আক্রান্ত হওয়াসহ সব ধরনের অপুষ্টির বিরুদ্ধে শিশুদের শরীরে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। বুকের দুধ শিশুদের প্রথম টিকা হিসেবেও কাজ করে। শুধু তাই নয় নারীদের ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের সমাজে নানাভাবে ফর্মুলা দুধের চাহিদা তৈরি হয়। শিশু ঠিকমতো বুকের দুধ পাচ্ছে না, ওজন বাড়ছে না, বিশেষ করে কর্মজীবী নারীরা সঠিকভাবে সময় দিতে পারছেন না শিশুকে। এসব দুর্বলতার সুযোগ নেয় ফর্মুলা দুধের বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) ২০২২ সালের একটি প্রতিবেদন বলছে, দেশে জন্মের পর থেকে পাঁচ মাস বয়সের শিশুদের শুধু বুকের দুধ পানের হার কমেছে। ২০২২ সালে তা হয় ৫৫ শতাংশ। তবে ২০১৭-১৮ সালে এ হার ছিল ৬৫ শতাংশ। এর আগে ২০১৪ সালে ৫৫ শতাংশ, ২০১১ সালে ৬৪ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৪৩ শতাংশ এবং ২০০৪ সালে ৪২ শতাংশ ছিল।
অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি প্রফেসর সামিনা চৌধুরী জানান, এখনো এমন কোনো বিষয় পাওয়া যায়নি যে বাচ্চা জন্মের পর মায়ের দুধ আসবে না। দুধ আসবে না এমন ধারণা অনেকটা মানসিক বিষয়। তাই প্রত্যেক শিশুরই জন্মের পর থেকে ৬ মাস অবশ্যই মায়ের দুধ দিতে হবে। এসময় পানিও খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। ৬ মাস পর মায়ের বুকের দুধের সঙ্গে সাপ্লিমেন্ট হিসেবে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের (বিবিএফ) পরিচালক খুরশিদ জাহান জাগো নিউজকে বলেন, ২০০৮ সাল পর্যন্ত এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ে বাংলাদেশে ৪০ শতাংশের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। এর থেকে বেশি আমরা এগোতে পারিনি। বেশ লম্বা সময় ধরেই দেশে এই অবস্থান ছিল। এরপর ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহে শিশু ও মায়ের পুষ্টি ও শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে কার্যক্রম জোরদার করার জন্য বলেন। এরপরই বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়ন বৃদ্ধি পায় এবং সরকারি বিভিন্ন অপারেশনাল প্ল্যান গৃহিত হয়। বিশেষ করে জাতীয় পুষ্টি সেবা (এনএনএস) ২০১১ সাল থেকে মাতৃদুগ্ধ বিষয় নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর অধীনে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং সোসাইটিও কাজ করে যাচ্ছে। এই কার্যক্রম পরিচালনা করার সময় আমরা দেখেছি ওয়ার্ল্ড ব্রেস্ট ফিডিং ট্রেইন ইনিশিয়েটিভ (ডবিøউবিটিআই) তাদের এক পর্যালোচনায় জানিয়েছে, ২০১৮ সালে প্রথমবারের মত শিশুদের মায়ের দুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের ৯৮টি দেশের মাঝে বাংলাদেশ প্রথম অবস্থানে উঠে এসেছে। এরপরের অবস্থানে ছিল শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ের হার বেশি ৯০ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশের হার ৬৫ শতাংশ ছিল। তবে বাংলাদেশ এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। খুরশিদ জাহান বলেন, নবজাতকের জন্য আদর্শ পুষ্টিকর উপাদান মায়ের বুকের দুধ। এ কারণে স্বাভাবিক জন্মের পর এক ঘণ্টা এবং সিজারে প্রসবের পর চার ঘণ্টার মধ্যে নবজাতককে মায়ের স্তন চুষতে দিতে হবে। এভাবে তিন ঘণ্টা পর পর বুকের দুধ খাওয়াতে হয়। তবে অনেকের মাঝে ভুল ধারণা আছে শিশু মায়ের দুধ পাচ্ছে না, কম আসছে এমন। তবে জন্মের পর মায়ের থেকে যে শাল দুধ পাওয়া যায় যার পরিমাণ ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ১ থেকে ২ চামচের সমপরিমাণ। ফলে মায়েদের ধারণা, বাচ্চা দুধ পাচ্ছে না। এটুকুই শিশুর জন্য পর্যাপ্ত। এই দুধ শিশুদের খাদ্যের জন্য পর্যাপ্ত হয়। এই দুধ শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টিগুণ বহন করে, যাকে নবজাতকের প্রথম ভ্যাক্সিনও বলা হয়ে থাকে। বিবিএফ পরিচালক বলেন, কিন্তু দেখা যায় যেসব নারী প্রথম মা হয়েছেন তারা বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। একদিকে শাল দুধ, যা পরিমাণে অত্যন্ত অল্প, তার সঙ্গে যদি বাচ্চা কান্না করে, মা বা মুরুব্বিদের প্রথম অভিযোগ থাকে বাচ্চা বুকের দুধ পাচ্ছে না। ফলে ওই প্রথম ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বেশির ভাগ নবজাতক ইনফান্ট ফর্মুলা পেয়ে থাকে। যা কোনোভাবেই উচিত নয়। তিনি বলেন, মূলত ফর্মুলা দুধ প্রয়োজন হয়ে থাকে যখন কোনো শিশুর মা মারা যায়, মা যদি ক্যানসারের ওষুধ পায়, কিছু জন্মগত ত্রæটি, যেমন, গ্যালাকটোসেমিয়া, যেখানে বুকের দুধ খেলে বাচ্চা অন্ধ হয়ে যায়, মা যদি অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধ পায় এবং মা যদি অ্যান্টিসাইকোটিক ড্রাগ পায়।
তিনি আরও বলেন, কিছু অসৎ চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে এসব গুঁড়া দুধের কোম্পানির যোগসাজশ থাকে। এর ফলে কিছু কমিশনের বিনিময়ে শিশুদের ফর্মুলা দুধের পরামর্শ দেন তারা। অনেকে দুধ পাচ্ছে না এই কথাকে কাজে লাগিয়ে এসব ফর্মুলা দুধ দিয়ে থাকেন, যার কোনো ভিত্তি নেই। শিশু জন্ম নিলে প্রাকৃতিক ভাবেই মায়ের অবশ্যই দুধ আসবে। এখন পর্যন্ত এটি প্রমাণ হয়নি বাচ্চা হওয়ার পরও কোনো শিশু মায়ের দুধ পায়নি। যারা মায়ের দুধ পাবে না বলে ফর্মুলা দুধ দিচ্ছেন তারা আইন লঙ্ঘন করছেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে আইনের ব্যত্যয় বেশি ঘটছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন নিয়মিত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো মনিটরিং করি এই আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটছে কি না। অধিকাংশ জায়গায় দেখা যায়, কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই গুঁড়া দুধের কথা লিখে দিচ্ছে। অনেকে একটা চিরকুটে বা সিল দেওয়া থাকে সেখানে টিক চিহ্ন দিয়ে দেন। এতে করে তাদের ধরার সুযোগও কম। ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট অ্যাক্ট-২০১৩, এই আইনে বলা আছে, কোনো স্বাস্থ্যকর্মী (চিকিৎসক, নার্স বা মায়ের সেবায় নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি) অথবা কোম্পানির লোকজন, বুকের দুধের পরিবর্তে অন্য কোনো দুধ খাওয়ার জন্য যদি উপদেশ দেন বা উৎসাহিত করেন, তবে তিনি ফৌজদারি অপরাধে দÐিত হবেন। এমন কি শুধু লিফলেট বিলি করলেই অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের সাজা হিসেবে প্রথমবার অপরাধ করলে, তিন বছরের জেল বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দÐে দÐিত হতে পারে। পরবর্তীতে একই অপরাধ করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে। বারে বারে করতে থাকলে, প্রতিবারই আগের বারের দ্বিগুণ শাস্তি ভোগ করতে হবে। যদি এই অপরাধে বাচ্চা অসুস্থ অথবা মৃত্যু হয়, তাহলে ১০ বছরের জেল বা ৫০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দÐে দÐিত হতে পারে এবং এই অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত বাচ্চার পরিবার পাবে।