ঢাকা ০৮:০৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ মে ২০২৫

নতুন সরকার যেভাবে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে

  • আপডেট সময় : ১২:৩৯:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৪
  • ৫৪ বার পড়া হয়েছে

খন্দকার ফারজানা রহমান : বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর যে আলোচনা সামনে আসছে সেটি হচ্ছে, এই সরকারের মেয়াদ কতদিন থাকবে।
এমন পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সরকারের মেয়াদ নিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করার জন্য যতদিন থাকার দরকার হবে, অন্তর্র্বতী সরকার ততদিন থাকবে। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যখন ওনাদের মনে হবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পরিবেশ তৈরি হয়েছে তখন ওনারা নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন। তার আগে এই সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যাবে না’।
আপাতত মেয়াদের বিতর্কে না গিয়ে আমাদের এই আলোচনাতে আশা উচিত যে-বর্তমানের অন্তর্র্বতীকালীন সরকার কীভাবে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বাংলাদেশে স্থিতাবস্থা ও সর্বজনীন সমঅধিকার ফিরিয়ে আনতে, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকারকে ব্যাপক কৌশল গ্রহণ করতে হবে যা সাম্প্রতিক অস্থিরতার মূল কারণগুলো মোকাবিলা করবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে এবং জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করবে। বাংলাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে অন্তর্র্বতী সরকার যে পদক্ষেপ নিতে পারে সেক্ষেত্রে আমার মতামত তুলে ধরছি—
রাজনৈতিক পুনর্মিলন এবং জাতীয় সংলাপ: রাজনৈতিক বিভাজন নিরাময় করা এবং বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করাই হবে সরকারের মূল উদ্দেশ্য। সরকারের উচিত অবিলম্বে সব প্রধান রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, ছাত্র নেতা এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সংলাপ আহ্বান করা। এই সংলাপে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি রাজনৈতিক রোডম্যাপ তৈরির দিকে নজর দেওয়া উচিত। আলোচনায় আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং অন্যান্য দলগুলোর মতামত প্রাধান্য দিতে হবে।
অন্তর্র্বতী সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। সব ধরনের রাজনৈতিক জিঘাংসার বাইরে গিয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ গুরুত্ব দেওয়ার সাথে সাথে ক্রান্তিকালে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখার মাধ্যমে, পক্ষপাতিত্ব বা কারচুপির অভিযোগ রোধ করে আসন্ন নির্বাচনের জন্য সমতল ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার: দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা এবং আরও সহিংসতা প্রতিরোধ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া অন্যতম গুরুদায়িত্ব। অন্তর্র্বতী সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা অপব্যবহারের তদন্ত ও শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম সংক্রান্ত। সবক্ষেত্রে আইনের সুশাসন এবং মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, যাতে আইন প্রয়োগকারী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করা যায়। পুলিশের উচিত জনগণকে রক্ষা করার জন্য কাজ করা, দমন করা নয়, যা উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করবে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে বিচারকদের অযৌক্তিক চাপ থেকে রক্ষা করা এবং তাদের নিরপেক্ষভাবে মামলার বিচার করার অনুমতি দেওয়া, বিশেষ করে রাজনৈতিক সহিংসতার সাথে সম্পর্কিত।
কোটা পদ্ধতি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার: সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে সিভিল সার্ভিস নিয়োগ স্বচ্ছ, যোগ্যতার ভিত্তিতে এবং দুর্নীতিমুক্ত। নিয়োগের তত্ত্বাবধানের জন্য একটি শক্তিশালী, স্বাধীন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা পাবলিক প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে পারে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে সরকারি চাকরি নীতি প্রণয়নে সাধারণ মানুষের মতামত বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকে। এটি যেকোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে ঐক্যমত্য গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সমর্থন: মানুষের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি করে এমন অর্থনৈতিক কাঠামো দূর এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর জীবিকা উন্নত করা প্রয়োজন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
অস্থিরতা কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, যেমন দরিদ্র, ছোট ব্যবসার মালিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জালকে শক্তিশালী করা জরুরি। এর মধ্যে সরাসরি নগদ স্থানান্তর, খাদ্য সহায়তা এবং খাদ্য ও জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থানের কর্মসূচি চালু—বিশেষ করে যুবকদের লক্ষ্য করে, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্রঋণ এবং উদ্যোক্তা স্কিমগুলোয় বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায় উপকৃত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন, পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি: মূল আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে জড়িত: ভারত, চীন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি জাতিসংঘ, ইইউ এবং কমনওয়েলথের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। অন্তর্র্বতী সরকারের জন্য কূটনৈতিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা একে বৈধতা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রদান করবে।
নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি এবং সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মতো সংস্থাগুলো থেকে আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানান। তাদের উপস্থিতি স্বচ্ছতা বাড়াবে এবং নির্বাচনের ফলাফলে আস্থা তৈরি করবে। নাগরিকদের তাদের ভোটাধিকার সম্পর্কে শিক্ষিত করার জন্য প্রচারণা শুরু করুন, ভোটারদের উচ্চ ভোটদানকে উৎসাহিত করুন এবং নির্বাচনী অখণ্ডতা সম্পর্কে ভয় বা সংশয় হ্রাস করুন।
গণমাধ্যমের স্থিতাবস্থা: বর্তমান সরকারের নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে যে স্বাধীন মিডিয়া আউটলেটগুলো সেন্সরশিপ বা ভয়ভীতি ছাড়াই অবাধে কাজ করবে। জনগণকে সঠিক তথ্য প্রদানের সাথে সাথে সরকারকে দায়বদ্ধ করে স্বচ্ছভাবে উন্নয়নের প্রতিবেদন করার জন্য প্রেসকে ক্ষমতা দেওয়া উচিত। সাথে সাথে সুশীল সমাজ সংস্থা, এনজিও এবং নাগরিক সংগঠনগুলো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ বিভিন্ন নীতি গঠনে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করুন, যাতে জনগণের কণ্ঠস্বর সরকারি সিদ্ধান্তগুলো প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশে শান্তি ফিরে আসার জন্য অন্তর্র্বতী সরকারকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্তি, স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জাতীয় পুনর্মিলন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বাস্তবায়ন এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রস্তুতির মাধ্যমে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশাসন আস্থা পুনর্র্নিমাণ করতে এবং গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য মঞ্চ তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংস্কারের সাথে তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা, বাংলাদেশে অন্য রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ কিংবা পক্ষপাত মূলক আচরণ যেভাবে চর্চা করা হয়েছে এর বাইরে গিয়ে আইনের শাসন সুনিশ্চিত করাই এবং ধর্ম, গোষ্ঠী, দল ভেদে সব মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া বর্তমান সরকারের মূলনীতি থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও এক্স চেয়ার, ক্রিমিনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে পিএইচডিরত)

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

নতুন সরকার যেভাবে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে

আপডেট সময় : ১২:৩৯:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৪

খন্দকার ফারজানা রহমান : বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর যে আলোচনা সামনে আসছে সেটি হচ্ছে, এই সরকারের মেয়াদ কতদিন থাকবে।
এমন পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সরকারের মেয়াদ নিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করার জন্য যতদিন থাকার দরকার হবে, অন্তর্র্বতী সরকার ততদিন থাকবে। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যখন ওনাদের মনে হবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পরিবেশ তৈরি হয়েছে তখন ওনারা নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন। তার আগে এই সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যাবে না’।
আপাতত মেয়াদের বিতর্কে না গিয়ে আমাদের এই আলোচনাতে আশা উচিত যে-বর্তমানের অন্তর্র্বতীকালীন সরকার কীভাবে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বাংলাদেশে স্থিতাবস্থা ও সর্বজনীন সমঅধিকার ফিরিয়ে আনতে, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকারকে ব্যাপক কৌশল গ্রহণ করতে হবে যা সাম্প্রতিক অস্থিরতার মূল কারণগুলো মোকাবিলা করবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে এবং জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করবে। বাংলাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে অন্তর্র্বতী সরকার যে পদক্ষেপ নিতে পারে সেক্ষেত্রে আমার মতামত তুলে ধরছি—
রাজনৈতিক পুনর্মিলন এবং জাতীয় সংলাপ: রাজনৈতিক বিভাজন নিরাময় করা এবং বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করাই হবে সরকারের মূল উদ্দেশ্য। সরকারের উচিত অবিলম্বে সব প্রধান রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, ছাত্র নেতা এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সংলাপ আহ্বান করা। এই সংলাপে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি রাজনৈতিক রোডম্যাপ তৈরির দিকে নজর দেওয়া উচিত। আলোচনায় আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং অন্যান্য দলগুলোর মতামত প্রাধান্য দিতে হবে।
অন্তর্র্বতী সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। সব ধরনের রাজনৈতিক জিঘাংসার বাইরে গিয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ গুরুত্ব দেওয়ার সাথে সাথে ক্রান্তিকালে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখার মাধ্যমে, পক্ষপাতিত্ব বা কারচুপির অভিযোগ রোধ করে আসন্ন নির্বাচনের জন্য সমতল ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার: দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা এবং আরও সহিংসতা প্রতিরোধ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া অন্যতম গুরুদায়িত্ব। অন্তর্র্বতী সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা অপব্যবহারের তদন্ত ও শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম সংক্রান্ত। সবক্ষেত্রে আইনের সুশাসন এবং মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, যাতে আইন প্রয়োগকারী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করা যায়। পুলিশের উচিত জনগণকে রক্ষা করার জন্য কাজ করা, দমন করা নয়, যা উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করবে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে বিচারকদের অযৌক্তিক চাপ থেকে রক্ষা করা এবং তাদের নিরপেক্ষভাবে মামলার বিচার করার অনুমতি দেওয়া, বিশেষ করে রাজনৈতিক সহিংসতার সাথে সম্পর্কিত।
কোটা পদ্ধতি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার: সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে সিভিল সার্ভিস নিয়োগ স্বচ্ছ, যোগ্যতার ভিত্তিতে এবং দুর্নীতিমুক্ত। নিয়োগের তত্ত্বাবধানের জন্য একটি শক্তিশালী, স্বাধীন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা পাবলিক প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে পারে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে সরকারি চাকরি নীতি প্রণয়নে সাধারণ মানুষের মতামত বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকে। এটি যেকোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে ঐক্যমত্য গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সমর্থন: মানুষের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি করে এমন অর্থনৈতিক কাঠামো দূর এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর জীবিকা উন্নত করা প্রয়োজন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
অস্থিরতা কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, যেমন দরিদ্র, ছোট ব্যবসার মালিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জালকে শক্তিশালী করা জরুরি। এর মধ্যে সরাসরি নগদ স্থানান্তর, খাদ্য সহায়তা এবং খাদ্য ও জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থানের কর্মসূচি চালু—বিশেষ করে যুবকদের লক্ষ্য করে, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্রঋণ এবং উদ্যোক্তা স্কিমগুলোয় বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায় উপকৃত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন, পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি: মূল আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে জড়িত: ভারত, চীন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি জাতিসংঘ, ইইউ এবং কমনওয়েলথের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। অন্তর্র্বতী সরকারের জন্য কূটনৈতিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা একে বৈধতা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রদান করবে।
নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি এবং সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মতো সংস্থাগুলো থেকে আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানান। তাদের উপস্থিতি স্বচ্ছতা বাড়াবে এবং নির্বাচনের ফলাফলে আস্থা তৈরি করবে। নাগরিকদের তাদের ভোটাধিকার সম্পর্কে শিক্ষিত করার জন্য প্রচারণা শুরু করুন, ভোটারদের উচ্চ ভোটদানকে উৎসাহিত করুন এবং নির্বাচনী অখণ্ডতা সম্পর্কে ভয় বা সংশয় হ্রাস করুন।
গণমাধ্যমের স্থিতাবস্থা: বর্তমান সরকারের নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে যে স্বাধীন মিডিয়া আউটলেটগুলো সেন্সরশিপ বা ভয়ভীতি ছাড়াই অবাধে কাজ করবে। জনগণকে সঠিক তথ্য প্রদানের সাথে সাথে সরকারকে দায়বদ্ধ করে স্বচ্ছভাবে উন্নয়নের প্রতিবেদন করার জন্য প্রেসকে ক্ষমতা দেওয়া উচিত। সাথে সাথে সুশীল সমাজ সংস্থা, এনজিও এবং নাগরিক সংগঠনগুলো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ বিভিন্ন নীতি গঠনে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করুন, যাতে জনগণের কণ্ঠস্বর সরকারি সিদ্ধান্তগুলো প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশে শান্তি ফিরে আসার জন্য অন্তর্র্বতী সরকারকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্তি, স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জাতীয় পুনর্মিলন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বাস্তবায়ন এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রস্তুতির মাধ্যমে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশাসন আস্থা পুনর্র্নিমাণ করতে এবং গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য মঞ্চ তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংস্কারের সাথে তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা, বাংলাদেশে অন্য রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ কিংবা পক্ষপাত মূলক আচরণ যেভাবে চর্চা করা হয়েছে এর বাইরে গিয়ে আইনের শাসন সুনিশ্চিত করাই এবং ধর্ম, গোষ্ঠী, দল ভেদে সব মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া বর্তমান সরকারের মূলনীতি থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও এক্স চেয়ার, ক্রিমিনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে পিএইচডিরত)