ঢাকা ০৪:২৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

নজরুল-পাঠের সনাতন ধারা ও সীমাবদ্ধতার দুটি দিক

  • আপডেট সময় : ০৯:৫২:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২২
  • ৮৮ বার পড়া হয়েছে

ড. মোহাম্মদ আজম : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারাক্রমের মধ্যে নজরুলকে জুতমতো আঁটানো যায় না। বয়সে প্রায় তার সমকালীন, কিন্তু এক দশক পরে বিকশিত, ‘আধুনিকতাবাদী’ কবিদের প্রবল প্রতাপ এবং বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে আধুনিকতাবাদের প্রবল প্রতিষ্ঠা নজরুল-পাঠে বেশ নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এই সংকট সত্ত্বেও নজরুল বাংলা ভাষার অতি-আলোচিত সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বই বটে।
এসব আলোচনায় সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথ ও তিরিশি কবিতার মূল অনুমানগুলোর ধারাবাহিকতার মধ্যেই নজরুলের কবিতা পঠিত হয়েছে। তাতে এই কাব্যলোকের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিশিষ্টতা জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান দিকগুলো এভাবে সূত্রায়িত করা যায়-
এক. সাধারণভাবে নজরুলকে চেনা হয় রোমান্টিক কবি হিসেবে। সেই রোমান্টিকতার এক পাশে বিদ্রোহ, অন্যদিকে প্রেম ও প্রকৃতি।
দুই. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তিরিশি কবিদের মধ্যবর্তী জায়গায় তার স্থান। আর এই স্থানে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার কিংবা যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের তুলনায় তার গুরুত্ব অনেক বেশি।
তিন. বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র-প্রভাব অতিক্রমে নজরুল খুব বড় ভূমিকা রেখেছেন ‘অলস শব্দসুষমা’র বিপরীতে বীরত্বব্যঞ্জক গতি-প্রবাহ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
চার. নজরুল ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের কবি এবং ‘ঔপনিবেশিক সমাজে সংগ্রামী কবি’।
পাঁচ. নজরুল নি¤œশ্রেণির মানুষের প্রতি দরদি কবি-ব্যক্তিত্ব। বাংলা কবিতার সীমাকে তিনি এদিক থেকে প্রসারিত করেছেন।
ছয়. নজরুল গভীরভাবে মানবতাবাদী কবি; তার সমগ্র উচ্চারণ এবং কর্মপ্রবাহ এক গভীর মানবতাবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত।
সাত. নজরুল বাংলা কাব্যের ধারায় একজন বড় কবি। বাংলা কবিতার শব্দ মুদ্রায় ও ছন্দে তার সুস্পষ্ট অবদান রয়েছে। তার কাব্যস্বর পৃথক ও বৈশিষ্ট্যম-িত। উত্তরকালীন কবিতার অন্তত তিনটি প্রধান ধারায়—ইন্দ্রিয়জাগর উচ্চারণে, সাম্যবাদী-মার্কসবাদী কবিতায় এবং ইসলাম চেতন কবিতায়—বিপুল প্রভাব তার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই তালিকা আরও বাড়ানো যায়। তবে, সাধারণভাবে বাংলা কাব্যের ধারাবাহিকতার মধ্যে থেকে নজরুল-সাহিত্যকে যারা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন, তাদের আলোচনার প্রধান সূত্রগুলো এতে পাওয়া যাবে।
সূত্রগুলো মূল্যবান; কারণ, এগুলোর ভিত্তিতে সহজেই দেখানো সম্ভব, নজরুল ‘আধুনিক’ বাংলা কবিতার প্রধান চার কবির অন্যতম। কিন্তু, এই সূত্রগুলো নজরুল-বিবেচনায় পুরোপুরি যথার্থ নয়, যথেষ্ট তো নয়ই।
তার প্রধান কারণ, এসব সূত্রে মান্য করা হয়েছে প্রতিষ্ঠিত-প্রভাবশালী নানা ছক—একদিকে ইউরোপের নন্দনতত্ত্বের যে ছকগুলো উপনিবেশিত কলকাতায় চর্চিত হয়েছে সেই সব ছক; অন্যদিকে, ঔপনিবেশিক কাঠামোর একটা সংকীর্ণ শ্রেণিভিত্তির মধ্যে জন্ম নেওয়া, বিকশিত হওয়া সব নন্দনতাত্ত্বিক কাঠামো। এখানে কেবল দুটি ছকের উদাহরণ দেওয়া হলো, যেগুলো হরহামেশাই নজরুলের ক্ষেত্রে আরোপ করা হয়, অথচ এসব ছাঁচে নজরুলকে কেবল অতি-আংশিকভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
প্রথমটি রোমান্টিকতার ছক। রোমান্টিক আন্দোলন বিকশিত হয়েছিল ইউরোপের এক বিশেষ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে, যার মূল কথা হলো সুদূরের আবাহন এবং রহস্যের আবেষ্টন।
শেষ উনিশ শতকে কলকাতায় সঙ্গত কারণেই এই ভাবধারা ব্যাপকভাবে প্রশ্রয় পায়। রোমান্টিক কাব্যতত্ত্বের গুণাগুণ নিয়ে কোনো প্রশ্নই এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।
বর্তমান প্রসঙ্গে শুধু বলা যায়, নজরুলের অতি-বাস্তবচেতন ও লিপ্ত কবিতার ধারা রোমান্টিক নন্দনতত্ত্বে খুব সামান্য পরিমাণেই আঁটে। তবু যে আমাদের কাব্য-বিশ্লেষকেরা নজরুলকে ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের সঙ্গে, বিশেষ করে শেলির সঙ্গে তুলনা করতে খুব পছন্দ করেন, তার মূল কারণ নিঃসন্দেহে ‘ইউরোকেন্দ্রিকতা’।
সমালোচক-তাত্ত্বিক আজফার হোসেন একে অভিহিত করেছেন ‘ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা’ বলে। দেখিয়েছেন, শেলির বিদ্রোহের গতি ও গন্তব্য প্রায়ই আকাশমুখী হয়ে ‘কখনো ঝুলে থাকে মেঘে, কখনো আকাশে’।
আর নজরুলের ‘বিদ্রোহী বীর ক্ষ্যাপা, বেপরোয়া, মুক্ত জীবনানন্দ হলেও তার ‘শির’ নতজানু হয় ইতিহাসের কাছেই … তাকে বলতে হয়, আমি সেইদিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না’।
বিস্ময়কর নয়, আমাদের অনেক সমালোচক এই পঙ্ক্তিতে এসেই শেলির বিদ্রোহের ‘শিল্পশোভন’ সাযুজ্য না দেখে হতাশ হয়েছেন, আর সংশয় পোষণ করেছেন খোদ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শিল্প সাফল্যে। এরপর বলা যাক ‘মানবতাবাদ’ প্রসঙ্গে। সমালোচকেরা নজরুলকে সাধারণত ‘মানবতাবাদী’ অভিধায় চিনতে পছন্দ করেন। যেমন, কবি আবুল হোসেন একবার লিখেছেন, ‘নজরুল ইসলামকে যদি এককথায় কোথাও দাঁড় করাতে হয়, তাহলে তাকে দাঁড় করাতে হবে হিউম্যানিজমের ভিত্তিতে। নজরুল ইসলাম হিউম্যানিজমের কবি, মানবতার কবি।’
এই দৃষ্টিভঙ্গি নজরুলের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জনপ্রিয়। নজরুল-রচনাবলি থেকে তাকে ‘মানবতাবাদী’ হিসেবে দেখানো বেশ সহজ। কিন্তু মনে রাখা দরকার, ‘হিউম্যানিজম’ পশ্চিমের বিশেষ ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে জন্ম নেওয়া এক দার্শনিক প্রকল্প, যা বেশ কয়েক দশক হলো খোদ পশ্চিমেই নানামুখী প্রশ্নে বিচলিত।
সেই প্রসঙ্গে না গিয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার, নজরুলের ‘মানবতাবাদ’ পশ্চিমা ‘লিবারেল হিউম্যানিজমে’র সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না। নজরুল-সাহিত্যে যাদের নাম উচ্চ মহিমায় প্রচারিত, যেমন, লেনিন, কালাপাহাড়, মুসোলিনি, সান ইয়াৎ সেন, তাদের একজনও পশ্চিমা অর্থে ‘হিউম্যানিস্ট’ গোত্রভুক্ত নন।
তাছাড়া, নজরুল ঘোষিতভাবে বিপ্লব-বিদ্রোহ-হত্যা-ধ্বংসের পয়গম্বর। এসব ধারণা ঘোরতরভাবে ‘লিবারেল হিউম্যানিজম’র বিরোধী। তার মানেই হলো, নতুন সংজ্ঞা তৈরি না করে নজরুল প্রসঙ্গে ‘মানবতাবাদী’ শব্দ ব্যবহার করলে আলোচনা জমে ওঠে বটে, কিন্তু কার্যকর কিছু হয় না।
সাহিত্য-পাঠের কতগুলো সর্বজনীন কেতা প্রতিষ্ঠিত হয়, আবার ব্যক্তি-কবিকে পাঠের কিছু বিশেষ ধ্যান-ধারণাও কালক্রমে গড়ে ওঠে।
নজরুলের ক্ষেত্রে নানা কারণে বিশেষ ধ্যান-ধারণাগুলো ঠিক নন্দনতাত্ত্বিক নিরিখে গড়ে ওঠেনি; বরং ‘ব্রিটিশ-বিরোধী রাজনীতি’, ‘অসাম্প্রদায়িকতা’, ‘মুসলমান সমাজের জাগরণ’ ইত্যাদি তুলনামূলক ‘সাহিত্য-বহির্ভূত’ বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তার ফল হয়েছে এই যে, বিশেষ নন্দনতত্ত্বের বিকাশ এবং তদনুযায়ী নজরুল-পাঠের ব্যাপক সম্ভাবনা বহুলাংশে এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান ও পরিবারের ৫৭৬ কোটি টাকা ফ্রিজ

নজরুল-পাঠের সনাতন ধারা ও সীমাবদ্ধতার দুটি দিক

আপডেট সময় : ০৯:৫২:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২২

ড. মোহাম্মদ আজম : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারাক্রমের মধ্যে নজরুলকে জুতমতো আঁটানো যায় না। বয়সে প্রায় তার সমকালীন, কিন্তু এক দশক পরে বিকশিত, ‘আধুনিকতাবাদী’ কবিদের প্রবল প্রতাপ এবং বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে আধুনিকতাবাদের প্রবল প্রতিষ্ঠা নজরুল-পাঠে বেশ নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এই সংকট সত্ত্বেও নজরুল বাংলা ভাষার অতি-আলোচিত সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বই বটে।
এসব আলোচনায় সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথ ও তিরিশি কবিতার মূল অনুমানগুলোর ধারাবাহিকতার মধ্যেই নজরুলের কবিতা পঠিত হয়েছে। তাতে এই কাব্যলোকের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিশিষ্টতা জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান দিকগুলো এভাবে সূত্রায়িত করা যায়-
এক. সাধারণভাবে নজরুলকে চেনা হয় রোমান্টিক কবি হিসেবে। সেই রোমান্টিকতার এক পাশে বিদ্রোহ, অন্যদিকে প্রেম ও প্রকৃতি।
দুই. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তিরিশি কবিদের মধ্যবর্তী জায়গায় তার স্থান। আর এই স্থানে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার কিংবা যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের তুলনায় তার গুরুত্ব অনেক বেশি।
তিন. বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র-প্রভাব অতিক্রমে নজরুল খুব বড় ভূমিকা রেখেছেন ‘অলস শব্দসুষমা’র বিপরীতে বীরত্বব্যঞ্জক গতি-প্রবাহ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
চার. নজরুল ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের কবি এবং ‘ঔপনিবেশিক সমাজে সংগ্রামী কবি’।
পাঁচ. নজরুল নি¤œশ্রেণির মানুষের প্রতি দরদি কবি-ব্যক্তিত্ব। বাংলা কবিতার সীমাকে তিনি এদিক থেকে প্রসারিত করেছেন।
ছয়. নজরুল গভীরভাবে মানবতাবাদী কবি; তার সমগ্র উচ্চারণ এবং কর্মপ্রবাহ এক গভীর মানবতাবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত।
সাত. নজরুল বাংলা কাব্যের ধারায় একজন বড় কবি। বাংলা কবিতার শব্দ মুদ্রায় ও ছন্দে তার সুস্পষ্ট অবদান রয়েছে। তার কাব্যস্বর পৃথক ও বৈশিষ্ট্যম-িত। উত্তরকালীন কবিতার অন্তত তিনটি প্রধান ধারায়—ইন্দ্রিয়জাগর উচ্চারণে, সাম্যবাদী-মার্কসবাদী কবিতায় এবং ইসলাম চেতন কবিতায়—বিপুল প্রভাব তার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই তালিকা আরও বাড়ানো যায়। তবে, সাধারণভাবে বাংলা কাব্যের ধারাবাহিকতার মধ্যে থেকে নজরুল-সাহিত্যকে যারা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন, তাদের আলোচনার প্রধান সূত্রগুলো এতে পাওয়া যাবে।
সূত্রগুলো মূল্যবান; কারণ, এগুলোর ভিত্তিতে সহজেই দেখানো সম্ভব, নজরুল ‘আধুনিক’ বাংলা কবিতার প্রধান চার কবির অন্যতম। কিন্তু, এই সূত্রগুলো নজরুল-বিবেচনায় পুরোপুরি যথার্থ নয়, যথেষ্ট তো নয়ই।
তার প্রধান কারণ, এসব সূত্রে মান্য করা হয়েছে প্রতিষ্ঠিত-প্রভাবশালী নানা ছক—একদিকে ইউরোপের নন্দনতত্ত্বের যে ছকগুলো উপনিবেশিত কলকাতায় চর্চিত হয়েছে সেই সব ছক; অন্যদিকে, ঔপনিবেশিক কাঠামোর একটা সংকীর্ণ শ্রেণিভিত্তির মধ্যে জন্ম নেওয়া, বিকশিত হওয়া সব নন্দনতাত্ত্বিক কাঠামো। এখানে কেবল দুটি ছকের উদাহরণ দেওয়া হলো, যেগুলো হরহামেশাই নজরুলের ক্ষেত্রে আরোপ করা হয়, অথচ এসব ছাঁচে নজরুলকে কেবল অতি-আংশিকভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
প্রথমটি রোমান্টিকতার ছক। রোমান্টিক আন্দোলন বিকশিত হয়েছিল ইউরোপের এক বিশেষ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে, যার মূল কথা হলো সুদূরের আবাহন এবং রহস্যের আবেষ্টন।
শেষ উনিশ শতকে কলকাতায় সঙ্গত কারণেই এই ভাবধারা ব্যাপকভাবে প্রশ্রয় পায়। রোমান্টিক কাব্যতত্ত্বের গুণাগুণ নিয়ে কোনো প্রশ্নই এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।
বর্তমান প্রসঙ্গে শুধু বলা যায়, নজরুলের অতি-বাস্তবচেতন ও লিপ্ত কবিতার ধারা রোমান্টিক নন্দনতত্ত্বে খুব সামান্য পরিমাণেই আঁটে। তবু যে আমাদের কাব্য-বিশ্লেষকেরা নজরুলকে ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের সঙ্গে, বিশেষ করে শেলির সঙ্গে তুলনা করতে খুব পছন্দ করেন, তার মূল কারণ নিঃসন্দেহে ‘ইউরোকেন্দ্রিকতা’।
সমালোচক-তাত্ত্বিক আজফার হোসেন একে অভিহিত করেছেন ‘ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা’ বলে। দেখিয়েছেন, শেলির বিদ্রোহের গতি ও গন্তব্য প্রায়ই আকাশমুখী হয়ে ‘কখনো ঝুলে থাকে মেঘে, কখনো আকাশে’।
আর নজরুলের ‘বিদ্রোহী বীর ক্ষ্যাপা, বেপরোয়া, মুক্ত জীবনানন্দ হলেও তার ‘শির’ নতজানু হয় ইতিহাসের কাছেই … তাকে বলতে হয়, আমি সেইদিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না’।
বিস্ময়কর নয়, আমাদের অনেক সমালোচক এই পঙ্ক্তিতে এসেই শেলির বিদ্রোহের ‘শিল্পশোভন’ সাযুজ্য না দেখে হতাশ হয়েছেন, আর সংশয় পোষণ করেছেন খোদ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শিল্প সাফল্যে। এরপর বলা যাক ‘মানবতাবাদ’ প্রসঙ্গে। সমালোচকেরা নজরুলকে সাধারণত ‘মানবতাবাদী’ অভিধায় চিনতে পছন্দ করেন। যেমন, কবি আবুল হোসেন একবার লিখেছেন, ‘নজরুল ইসলামকে যদি এককথায় কোথাও দাঁড় করাতে হয়, তাহলে তাকে দাঁড় করাতে হবে হিউম্যানিজমের ভিত্তিতে। নজরুল ইসলাম হিউম্যানিজমের কবি, মানবতার কবি।’
এই দৃষ্টিভঙ্গি নজরুলের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জনপ্রিয়। নজরুল-রচনাবলি থেকে তাকে ‘মানবতাবাদী’ হিসেবে দেখানো বেশ সহজ। কিন্তু মনে রাখা দরকার, ‘হিউম্যানিজম’ পশ্চিমের বিশেষ ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে জন্ম নেওয়া এক দার্শনিক প্রকল্প, যা বেশ কয়েক দশক হলো খোদ পশ্চিমেই নানামুখী প্রশ্নে বিচলিত।
সেই প্রসঙ্গে না গিয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার, নজরুলের ‘মানবতাবাদ’ পশ্চিমা ‘লিবারেল হিউম্যানিজমে’র সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না। নজরুল-সাহিত্যে যাদের নাম উচ্চ মহিমায় প্রচারিত, যেমন, লেনিন, কালাপাহাড়, মুসোলিনি, সান ইয়াৎ সেন, তাদের একজনও পশ্চিমা অর্থে ‘হিউম্যানিস্ট’ গোত্রভুক্ত নন।
তাছাড়া, নজরুল ঘোষিতভাবে বিপ্লব-বিদ্রোহ-হত্যা-ধ্বংসের পয়গম্বর। এসব ধারণা ঘোরতরভাবে ‘লিবারেল হিউম্যানিজম’র বিরোধী। তার মানেই হলো, নতুন সংজ্ঞা তৈরি না করে নজরুল প্রসঙ্গে ‘মানবতাবাদী’ শব্দ ব্যবহার করলে আলোচনা জমে ওঠে বটে, কিন্তু কার্যকর কিছু হয় না।
সাহিত্য-পাঠের কতগুলো সর্বজনীন কেতা প্রতিষ্ঠিত হয়, আবার ব্যক্তি-কবিকে পাঠের কিছু বিশেষ ধ্যান-ধারণাও কালক্রমে গড়ে ওঠে।
নজরুলের ক্ষেত্রে নানা কারণে বিশেষ ধ্যান-ধারণাগুলো ঠিক নন্দনতাত্ত্বিক নিরিখে গড়ে ওঠেনি; বরং ‘ব্রিটিশ-বিরোধী রাজনীতি’, ‘অসাম্প্রদায়িকতা’, ‘মুসলমান সমাজের জাগরণ’ ইত্যাদি তুলনামূলক ‘সাহিত্য-বহির্ভূত’ বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তার ফল হয়েছে এই যে, বিশেষ নন্দনতত্ত্বের বিকাশ এবং তদনুযায়ী নজরুল-পাঠের ব্যাপক সম্ভাবনা বহুলাংশে এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়