লাইফস্টাইল ডেস্ক: ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্যই নিজেদের মতো আয়েস করে শহুরে ক্লান্তি দূর করে আসা। শহুরে কর্মক্লান্তি আর একঘেয়েমি দূর করতে চলে গিয়েছিলাম কক্সবাজারের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঘেরা পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট মারমেইড বিচ রিসোর্টে।
মারমেইডে যাওয়ার আগে একটু ধারণা নিয়েছিলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘেটে। টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের একপাশে পেঁচার দ্বীপ নামের একটি জায়গায় ১৪ একর জায়গা নিয়ে এই রিসোর্ট।
৩৫টি রুম ১০টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা। বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলাম এমন চমৎকার একটি জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছি ভেবে। সারারাত বাসের যাত্রা শেষে সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম মারমেইডে।
মূল ফটকে পা রাখতেই মনে হয় যেন ব্যস্ত নগর জীবনকে পেছনে রেখে ভিন্ন এক জগতে চলে এসেছি। বাগানবিলাসে সাজানো মারমেইডের ফটক। ভেতরে ঢুকতেই টের পাওয়া যায় এর শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশের। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ার মতো অবস্থা।
মূল ফটক থেকে লবি পর্যন্ত যেতেই পরিস্কার ধারণা করা যায় কেন ইকো রিসোর্ট হিসেবে এত নাম কুড়িয়েছে মারমেইড। একদম বিলীন হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত প্রতি জিনিসকে কোনও না কোনোভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে মারমেইডে। ফেলে দেওয়া বালতি ও বোতল দিয়ে করা হয়েছে ভেতরের পথগুলোর আলোকসজ্জা। পুরনো অনেকগুলো হারিকেন সাজানো হয়েছে গাছের ডালে। নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত সামগ্রী দিয়ে বানানো হয়েছে স্থাপত্য। লবি পর্যন্ত যেতেই এত চমক!
মন ভালো করে দেয় মারমেইডের ব্যতিক্রমী উষ্ণ অভ্যর্থনা। অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয় টকটকে লাল জবা ও নারকেল পাতায় তৈরি মালা দিয়ে। ওয়েলকাম ড্রিংকস হিসেবে দেওয়া হয় ডাবের পানি। এর পরিবেশনাও বেশ নান্দনিক। গ্লাসটি সাজানো হয় নারকেল পাতা আর জবাফুলের পাপড়ি দিয়ে। উল্লেখ্য, তাদের প্রতিটি আয়োজন ও পরিবেশনায় নজর কাড়ে জবাফুল।
লবিতে বসে ডাবের পানি খেতে খেতে আমাদের থাকার জায়গাটাও ঠিক হয়ে যায়। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিন্যাস করা তাদের কটেজগুলো। বাহুল্যবর্জিত প্রতিটি কটেজ নির্মাণ করা কাঠ, বাঁশ, বেতে। ঠিক যেন কোনও গ্রাম!
কটেজগুলোর নামও দারুণ। আমি উঠেছিলাম ব্লু পয়েম মারমেইড স্যুটে। মাটির হাফ দেয়াল করে আড়াল করা পুরো জায়গাটা। চারদিকে গাছপালাও অসংখ্য। বেশ প্রসারিত একটি কক্ষ। স্নানঘরে ঢুকে আনমনে বলে ওঠে মন ‘আরে বাহ’। বাইরের দিকটি গ্রামীণ আবহের হলেও, ভেতরে আধুনিক সকল সুবিধা আছে।
হাত-মুখ ধুয়েমুছে খেতে যাওয়ার সময় পথটা খেয়াল করলাম আরও ভালো করে। রাস্তায় সিমেন্টের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে ভাঙা বোতলের টুকরো। জাহাজের কাঠ দিয়ে বেঞ্চ, ঝাউগাছের গুঁড়ি দিয়ে সাজসজ্জা। আবারও মনে পড়ল আসলেই কোনও জিনিসকে ফেলে দেওয়া হয় না এখানে। কচ্ছপের একটি স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়েছে রিসোর্টের ভেঙে যাওয়া সকল জিনিসপত্র থেকে।
সকালের নাশতার জন্যই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় মারমেইড। মারমেইডের অতিথিরা ছাড়াও আশেপাশের অন্যান্য জায়গার দর্শনার্থীরাও চলে আসেন এখানে সকালের নাস্তা উপভোগ করতে। কক্সবাজারের সবচেয়ে বড় সুইমিংপুলের পাশে বসে স্বাস্থ্যকর নাশতা শুধু স্বাদ নয়, মনকেও পরিপূর্ণ করে। ৩০০ ফিট দীর্ঘ এই পুল।
খাবারের আয়োজনও কম নয়। শীতকাল থাকায় এখানে ছিল ‘লাইভ পিঠা স্টেশন’। স্থানীয়দের হাতে তৈরি পিঠার স্বাদ মন ভোলায় অতিথিদের। সব মৌসুমেই থাকে তাজা ফল ও ফলের রস। রঙিন সব ফলের জুস দেখে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম সবগুলোর স্বাদ নেওয়ার। পেঁপে, আনারস, তরমুজ, গাজর, কমলার জুসসহ ইশপগুল আর তুকমাও ছিল এদিন। পরোটা, খিচুড়ি, ডিম ভাজি, ডাল আর মুরগির মাংসসহ কন্টিনেন্টাল কুইজিন ব্যুফের পাশাপাশি উপভোগ করা যায় অন্যান্য কুইজিনও। এতকিছুর পর চা কফি না হলে হয়!
খাবার যেমন সুস্বাদু, তেমনি নয়নাভিরাম সুইমিংপুলসহ আশেপাশের প্রকৃতি। এককাপ আমেরিকানোর সঙ্গে সুইমিংপুল আর বিচ ভিউ উপভোগ করেছি দীর্ঘক্ষণ। অদূরের সমুদ্র থেকে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যায় এখানে। অনেকেই আবার ডেকচেয়ারে গা এলিয়ে বসে রৌদ্রস্নান করছেন। পেছনে পাহাড় আর সামনে বালিয়াড়ি, একটু দূরে রেজু খাল, তারপর অথৈ সমুদ্র। পুরোটা সময় প্রকৃতির লীলাময় রূপ মুগ্ধ করে রাখে যেন!
সকালের নাশতা সেরে চলে যাই মারমেইডের প্রাইভেট বিচে। ভিড় নেই, নেই কোনও অপ্রয়োজনীয় শব্দ। হাতে গোনা কয়েকজন উপভোগ করছেন সমুদ্র সৈকত। এখানেও আছে একটি কফি স্টোর। নাম ‘সি সাইলেন্স ক্যাফে’। কুকি, কোকোনাট কেক ও বিভিন্ন ধরনের কফি পাওয়া যায় এখানে।
দুপুরের খাবার বেছে নিতে হয় তাদের রেস্তোরাঁ থেকে। মাছ, মাংস ও ভর্তার বিভিন্ন প্লেটারে সাজানো মেন্যু। শেফের স্পেশাল বিভিন্ন পদও থাকে দুপুরের আয়োজনে। শেষ পাতে বিভিন্ন পদ থাকলেও আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে শেফস স্পেশাল নারকেল আইসক্রিম। একবার হলেও মারমেইডের এই আইসক্রিমের স্বাদ নেওয়া উচিত।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো মারমেইড। রেস্তোরাঁর বর্ধিত অংশটুকু সমুদ্রের দিকে মুখ করা। দোতলা কাঠামোর নিচের অংশে টেবিল বিছিয়ে খাবারের আয়োজন করা। আর উপরের অংশটুকু আয়েসের জন্য, আড্ডার জন্য। সমুদ্র, পাহাড় আর রিসোর্টের পুরো রূপ দেখা যায় এখানে বসে।
রেস্তোরাঁর পাশেই ফ্রেশ জুস বার ও বারবিকিউ স্টেশন। মূলত লাইভ ফিশ বারবিকিউ সেশনটি কেমিস্ট্রি অব কাঁকড়া নামে পরিচিত। অতিথিদের নির্বাচিত সামুদ্রিক মাছ কিংবা কাঁকড়া বারবিকিউ করা যায় এখানে।
মারমেইডের বালির মাঠ পেরিয়ে গেলেই রেজু খাল তারপর বে অব বেঙ্গল। ঝাউবনে ঘেরা বালিয়াড়ির অংশটুকু সাজানো নান্দনিক নানা স্থাপনায়। রেজু খালের অংশটুকুতে মৃদু ঢেউ, হিমেল বাতাস ভালোই লাগে। চাইলে এখানে কায়াকিং-এর ব্যবস্থা করে দেয় মারমেইড। অথবা কায়াকিং করে খাল পাড়ি দিয়ে চলে যাওয়া যায় মূল সমুদ্র সৈকতে।
সমুদ্রসৈকতের সূর্যাস্ত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি। সেই দৃশ্যে মন ভরিয়ে ফিরে যাই কটেজে। রুমে ফেরার কিছুক্ষণ পড়েই আমাদের জন্য পাঠানো হয় কমলা, তেঁতুল, জলপাই আর কলা ভর্তি ঝুড়ি।
সান্ধ্যকালীন বিভিন্ন আয়োজনে মাতিয়ে রাখা হয় মারমেইড। বিশেষ করে ফায়ার শোর ব্যবস্থা ছিল দুর্দান্ত। মাঝে মাঝেই মুভি নাইটের আসর বসানো হয়। বিশেষ করে এই মৌসুমে। রাতের খাবারের আগে আবার হেঁটে বেড়িয়েছি পুরো রিসোর্ট। রাতের আলোকসজ্জায় আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এই রিসোর্ট। প্লাস্টিকের বোতল, বালতিগুলো আরও বেশি দৃশ্যমান এ সময়, জানান দেয় নিজেদের পুনর্ব্যবহারযোগ্যতার।মারমেইডের আরেকটি বৈশিষ্ট্য আমার মন কেড়েছে। কটেজ যেটাই হোক পুরো রিসোর্ট ঘুরে বেড়ানো যাবে নিজেদের মতো। ঠিক নিজের গ্রামের বাড়ির মতো।