নিজস্ব প্রতিবেদক : শীতের হিমকে আনুষ্ঠানিক বিদায় দিয়ে ভালোবাসার দিনে চলে এসেছে ফাল্গুনী সমীরণ; পাতাঝরা পলাশ আর শিমুলের ডালে ডালে যে রঙ লেগেছে, তারই উৎসব চলেছে নগরজুড়ে। একদিকে ঋতুরাজ বসন্ত, অন্যদিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে, একই দিনে দুই উদযাপনে আনন্দের জোয়ার বইছে তরুণ প্রাণে।
বাসন্তী-লালের সাজপোশাকে কারো হাতে গোলাপ, কারো মুঠোয় কুড়ানো পলাশ, মাথায় বাহারি ফুলের টায়রা; বসন্তের প্রথম দিনে রাজধানীবাসী মেতেছে ভালোবাসার উদযাপনে।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন সাজ-সাজ আয়োজনে ভিড় বাড়তে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে বইমেলায়, যেন ছোট-বড় সকলের আলাদা এক দিন। বইমেলা এলাকায় দেখা মিলল দুই তরুণীর, যারা এসেছেন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকা থেকে। গোলাপী আর গোলাপীর মাঝে নীল শাড়ি পরা দুই তরুণীর একজন হৃদিকা দেবী, অন্যজন শ্রাবন্তী দাস। জানালেন, দুজনে খুব ভালো বন্ধু। এসেছেন বইমেলায়, কিন্তু মেলা খোলার সময় না হওয়ায় তারা বাইরে অপেক্ষা করছেন। তাতে অবশ্য ‘খারাপও লাগছে না’।
তেজগাঁও কলেজের বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী শ্রাবন্তী বললেন, “আমরা আসছি সাড়ে ১১টার দিকে। অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। একসাথে থাকলে কোনোকিছুতেই আমাদের বিরক্ত লাগে না। আর এখন তো গরম নাই। হালকা বাতাস, ছায়ায় বসে আছি। ভালোই লাগছে।” দুজনের একইরকমের সাজ-পোশাকের কারণ জানতে চাইলে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজে বিএসসি নার্সিংয়ের শিক্ষার্থী হৃদিকা বললেন, “আসলে আমরা একসাথে যেখানেই যাই, আমাদের জামাকাপড়ের কালার কীভাবে কীভাবে যেন মিলে যায়। আমরা কেউ জানতাম না, কে কী রঙের শাড়ি পরবে। বের হয়ে দেখি মিলে গেছে।” ভালোবাসা দিবসের প্রসঙ্গ তুলতেই হৃদিকার ভাষ্য, “আমরা সিঙ্গেল, এই বাঁধাহীন জীবন খুব উপভোগ করছি। আর ভালোবাসা দিবস তো শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য না, বন্ধুদের জন্যও।“
পুরান ঢাকার লিজা আক্তার ও ইসাসিন কবিরের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। লিজার কথায়, “এটা আমাদের সেকেন্ড অ্যানিভার্সারি। গতবছর এই দিনে ও আমায় প্রপোজ করেছিল। তাই এই ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র ব্যাপারটাই আলাদা আমাদের কাছে।” সারাদিনের পরিকল্পনাও বললেন এই তরুণী। জানালেন, “এখানে এলাম, একটু ঘুরব-ফিরব। দুপুরে আশপাশেই কোথাও খাব। বিকালে ওর জন্য একটা সারপ্রাইজ রেখেছি। এভাবেই কাটাব।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রায় সবার সাজ-পোশোকে লাল-হলুদের ছটা থাকলেও কালো শাড়ি-পাঞ্জাবিতে আলাদা নজর কাড়ছিলেন রাইসা ইসলাম ও অপূর্ব হাসান। রাইসার পরনে কালো জর্জেট শাড়ি, খোঁপায় সাদা ও হলদে ফুল। কাছে গিয়ে তাদের ব্যতিক্রমী সাজের কারণ জানতে চাইলে রাইসা বললেন, “আজ সবাই তো হলুদই পরবে। সেটা ভেবেই আমরা কালো রঙের ড্রেস বাছাই করছি।”
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় অপেক্ষমাণ রুনা ও আমিরুল ইসলাম দম্পতি দুজনেরই পরনেই ছিল হলুদ, একজন শাড়ি, অন্যজন পাঞ্জাবি। রুনার হালকা কাঁচা-পাকা চুলে শোভা পাচ্ছিল লাল গোলাপ। ষাটোর্ধ্ব আমিরুল ইসলামেরও মাথা ভরা পাকা চুলে। আমিরুল হাসতে হাসতে বললেন, “শুধুই তো ভালোবাসা। আর কদিনই বা বাঁচব। যত পারা যায়, তত বেশি জীবনকে উপভোগ করে নেওয়া উচিত। জীবনের পুরোটাই তো বাচ্চাদের জন্য দিলাম। ওরা সবাই এখন বাইরে সেটেলড।”
পহেলা ফাল্গুন আর ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে সবাই শাড়ি-পাঞ্জাবি পরেছেন এমন নয়। প্রতিদিনের আরামদায়ক পোশাকেও ঘুরতে বেড়িয়েছেন অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তানহা হলুদ কুর্তি পরে বন্ধুদের সঙ্গে বসেছিলেন টিএসসি প্রাঙ্গনে। তিনি বললেন, “সকালে ক্লাস ছিল। তাই অত সকালে উঠে শাড়ি-টারি পরে রেডি হতে পারিনি, কুর্তি পরেছি।
বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতিবছরের মত এবারো জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ এর উদ্যোগে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় নাচ, গান, আবৃত্তিতে বরণ করে নেওয়া হয় ঋতুরাজ বসন্তকে। বিকাল ৩টা থেকে বকুলতলার পাশাপাশি উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র সরণির বঙ্গবন্ধু মুক্ত মঞ্চ এবং পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে চলে বসন্তবরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৩ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরেই আয়োজিত হতো এ বসন্ত বরণ উৎসব। কিন্তু ৮ ফাল্গুন এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে মেলানোর জন্য বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের ফলে ২০২০ সাল থেকে পহেলা ফাল্গুন এবং ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ১৪ ফেব্রুয়ারি একসঙ্গে পালিত হচ্ছে।
ভালোবাসার সুরে-ছন্দে বসন্ত বন্দনা: ঋতু বদলের চরাচরে শিমুল-পলাশের রাঙা হাসি, বাতাসে ফিসফাস; রবি ঠাকুর যে বলে গেছেন, ‘আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো’।
ফাল্গুনের প্রথম দিন মঙ্গলবার, এদিনই আবার ভ্যালেন্টাইস ডে, যাকে বাঙালি বলে ‘ভালোবাসা দিবস’। নবযৌবনের ঋতুকে বরণ করে নিতে ফাগুনের প্রথম প্রভাতে তাই উৎসব। বাসন্ত সাজে নর-নারী মেতেছে আনন্দে; রাজধানীর শাহবাগ, চারুকলা, টিএসসি, পাবলিক লাইব্রেরি আর উদ্যানে উদ্যানে ফুল আর ভালোবাসার রঙ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় সকালে নাচ, গান, আবৃত্তি ও বসন্ত কথনে শুরু হয় জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ এর দিনব্যাপি আয়োজন। বকুলতলা ছাড়াও পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এবং উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র সরণি রোডের বঙ্গবন্ধু উন্মুক্ত মঞ্চে রয়েছে এবারের বসন্ত উৎসবের আয়োজন। চারুকলার বকুলতলায় সকাল সোয়া ৭টায় বেঙ্গল মিউজিকের শিল্পীদের সমবেত যন্ত্রসংগীতে রাগ-বিহার পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। পরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা নানান পরিবেশনায় অংশ নেন।
৫ বছরের মেয়ে শায়ন্তনিকে নিয়ে আজিমপুর থেকে বসন্ত উৎসবে এসেছিলেন রুহুল আমিন ও সুরভি দম্পতি। রুহুল আমিন বললেন, “আমাদের মেয়ে সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠুক, আমরা এটা চাই। এজন্যই বসন্ত উৎসবে নিয়ে এসেছি।
“ঢাকা শহরে থেকে আমরা আসলে নিজস্ব উৎসব, পার্বণ সবই তো ভুলে যাচ্ছি। তবুও চেষ্টা করি মেয়েকে এগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। সময় পেলেই মেয়েকে গ্রামে নিয়ে যাই, যাতে আমাদের শেকড় সম্পর্কে ওর ধারণা জন্মে।”
বসন্ত কথন পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, “সংস্কৃতির যে আবহমান ধারা, তারই প্রকাশ ঘটে বিভিন্ন পার্বণে আর এ ধরণের উৎসবে। আজকে বসন্ত উৎসবে যেভাবে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ একত্রিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্রই ফুটে উঠছে।
“বসন্ত উৎসবের অসম্পদায়িক রূপ আবহমান বাংলার একটি চরিত্র, এটি আরও বেশি ছড়িয়ে দেয়া জরুরি।” অনুষ্ঠানের সভাপতি, বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ এর আহ্বায়ক স্থপতি সফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “মানুষের মাঝে মানবিকতার চর্চা যেন আরও বৃদ্ধি পায় তার জন্যই প্রতি বছর বসন্ত উৎসব উদযাপন করছি আমরা। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা মানবিকতার জয়গান শোনাই এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথে নিজেদের আরও এগিয়ে নিয়ে যাই।”
বসন্ত কথন পর্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কাজল দেবনাথ ও মানজার চৌধুরী সুইট। আর পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আহসান উল্লাহ তমাল ও নুসরাত ইয়াসমিন রুম্পা। বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ এর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ আমরা চেয়েছিলাম, তার মূলমন্ত্র ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ থেকে আমরা মনে হয় একটু একটু করে সরে যাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথকে বহমান রাখতে হলে সংস্কৃতির পথ ধরেই আমাদের হাঁটতে হবে। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। বসন্ত উৎসবের মত উৎসবগুলো যত বেশি উদযাপন করব, আমরা নিজেদের শেকড়কে ধারণ করে সামনে এগিয়ে যাব।”
দর্শক সারিতে হঠাৎ শিক্ষামন্ত্রী: মঞ্চে চলছিল বসন্ত কথন পর্ব। এ সময় হঠাৎ দেখা গেলো দর্শক সারিতে খুব সাধারণ বেশে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। পাশে থাকা এক নারী মন্ত্রীকে চিনতে পেরে ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে গেলেন, এরপরই দর্শক সারিতে খবর রটে গেল, মন্ত্রী এসেছেন। মঞ্চ থেকে মাইকে অনুরোধ করা হল মন্ত্রীকে মঞ্চে গিয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য। মঞ্চে গিয়ে দীপু মনি কেবল বললেন, “সবাইকে বসন্তের শুভেচ্ছা, অনেক ভালোবাসা।” তারপর ফের চলে গেলেন দর্শক সারিতে।
গণমাধ্যমকর্মীরা এসময় বসন্ত উৎসব আর ভালোবাসা দিবস নিয়ে মন্ত্রীর কথা শুনতে চাইলেন। দীপু মনি বললেন, “প্রতি বছরই বসন্ত উৎসবে আসার চেষ্টা করি। আজকেও এলাম। এই বসন্ত আমাদের চেতনার সাথে নানাভাবে জড়িয়ে আছে।”
মন্ত্রীকে ঘিরে বাড়তে থাকে সেলফি তোলার ভিড়। সেই ভিড় এক সময় বিড়ম্বনার রূপ নেয়। মন্ত্রীর মুখের হাসিতে মিশে যায় একটুখানি বিরক্তি। গাড়িতে ওঠার আগে দীপু মনি বলেন, “বিরক্ত হচ্ছি না। তবে আমি অনুষ্ঠান উপভোগ করতেই এসেছিলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অনুষ্ঠান দেখেছি। এখানে অনেক তরুণরা আসে, সবার এই আনন্দিত চেহারাটা দেখতে ভালো লাগে। আরও কিছু সময় থাকতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু আমার আরেকটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে। এজন্য বেরিয়ে যাচ্ছি।”
গান, নাচ ও আবৃত্তিতে জমজমাট অনুষ্ঠান: সকালের পর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বসন্ত’ কবিতা আবৃত্তি করেন একুশে পদকজয়ী আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়। কবি মুহম্মদ সামাদের লেখা ‘বসন্ত এলো যে আজ ঘরে’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী। একক কণ্ঠে গান শোনান ইয়াসমিন মুশতারি, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, লাইসা আহমেদ লিসা, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি। বিমান চন্দ্র যখন শাহ আবদুল করিমের ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’ গানটি গাইতে শুরু করেন তার সাথে কণ্ঠ মেলান দর্শক সারির অনেকে। নৃত্য ও গানের পরিবেশনার সময় দর্শক সারিতে অনেককে নাচতেও দেখা যায়।
‘দখিন হাওয়া জাগো জাগো’ গানের সাথে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে ওয়ার্দা রিহাবের পরিচালনায় ধৃতি নৃত্যালয়। প্রিয়াঙ্কা র্যাচেল প্যারিসের পরিচালনায় গৌড় নৃত্য পরিবেশন করে ‘গৌড়ীয় নৃত্য সারথী’। পূজা সেনগুপ্তের পরিচালনায় আরতি নৃত্য পরিবেশন করে তুরঙ্গমী, লুবনা মরিয়ামের পরিচালনায় সাধনা সংস্কৃতি ম-ল পরিবেশন করে ‘আহা আজি এ বসন্তে’ গানের সাথে নৃত্য। সামিনা হোসেন প্রেমার পরিচালনায় ভাবনা পরিবেশন করে ‘মাধবী হঠাৎ কোথা থেকে এলে ফাগুন দিনের শেষে’ গানের সাথে নৃত্য। দলীয় সংগীত পরিবেশন করে গীতাঞ্জলী, সত্যেনসেন শিল্পী গোষ্ঠী, বহ্নিশিখা, বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসের শিল্পীরা।
নগরজুড়ে বসন্ত আর ভালোবাসার মাতাল সমীরণ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ