গুঞ্জন রহমান : চিত্রনায়িকা অঞ্জনার মৃত্যু সংবাদ জেনে দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু তার মৃত্যুতে আমি তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখিনি।
ইতোপূর্বে বাংলাদেশের ও দেশের বাইরের বেশ ক’জন সেলিব্রিটির মৃত্যুতে তাদের নিয়ে আমি লিখেছি। সেই লেখাগুলো যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ায় সামাজিক মাধ্যম থেকে বইয়ের পাতায় উঠে এসেছে।
আলো যায় রাত্রি আসে নামক বইটি আমি লিখেছি মূলত নতুন প্রজন্মের জন্যই, যাতে ইতিপূর্বে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া এই আলোর পথযাত্রীদের কীর্তিমান জীবন থেকে তারা অনুপ্রেরণা পেতে পারে।
সেই গ্রন্থে অবশ্য মৃত্যু সংবাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লিখিত প্রবন্ধ ছাড়াও এমন অনেক তারকার সম্পর্কে আমি লিখেছি, যাদের মৃত্যু বেশ আগেই হয়েছিল। তবে বিশেষ করে কোনো সেলিব্রিটির মৃত্যু হলে সামাজিক মাধ্যমে আমার বন্ধু ও অনুসরণকারীরা রীতিমতো অপেক্ষা করে থাকেন, সদ্যবিদায়ী এই তারকাকে নিয়ে আমার কোন লেখা কখন আসবে!
সেই হিসেবে, অঞ্জনা’কে নিয়ে আমার একটি লেখাও তাদের পাওনা হয়ে থাকার কথা। অথচ দেখুন, সেই দেনা শোধ করার আগেই দেনার দায় বাড়িয়ে দিয়ে চলে গেলেন প্রবীর মিত্র’ও!
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগৎ পরপর দুটো বড় আঘাত পেল।
কিন্তু কতা বড় আঘাত? শুনতে খারাপ লাগবে, মানতে কষ্ট হবে, কিন্তু কঠিন বাস্তবতা এই যে, এরকম দু’জন প্রসিদ্ধ অভিনেতা-অভিনেত্রীকে হারিয়েও আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তেমন কিছুই হয়নি।
বড়ই নির্মম এই কথাটা, সদ্য প্রয়াতদের জন্য অসম্মানজনকও, তবু এ কথা না বলে উপায় নেই, স্বীকার না করে গতি নেই। কারণ ওই সিনেমার ভাষাতেই, মেলোড্রাম্যাটিক ডায়ালগ আওড়াতে হয়Ñ ‘লাশের গায়ে আঘাত করে সাধ্য কার?’ যে ইন্ডাস্ট্রি আগে থেকেই মৃত, তাকে আঘাত দিয়ে ঘায়েল করবে এমন সাধ্য কার? মৃতদেহ কি আঘাত বুঝতে পারে আদৌ? আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একটা শবদেহ ছাড়া আর কী?
অঞ্জনা সম্পর্কে এ দেশের তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই তেমন কিছু জানে না। এ জন্য তাদের খুব বেশি দোষও দেওয়া যায় না।
কারণ তাদেরকে জানানোর দায়িত্বটা যে প্রজন্মের ছিল, তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। আপনি আন্তর্জাতিক মুভি ডাটাবেজ বা আইএমডিবি খুঁজে দেখুন, তার নামের পাশে গোটা বিশেক ছবির তালিকা পাবেন বড়জোর। অথচ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি প্রায় তিনশো সিনেমায় অভিনয় করেছেন। সেসব ছবির ক’টার নাম উল্লেখ আছে আমাদের চলচ্চিত্রের আর্কাইভে? আমাদের গণমাধ্যমে ক’টা ছবির তথ্য আছে? তিনি বাংলাদেশের সেই তারকা, যিনি গোটা উপমহাদেশজুড়ে নয়টি ভাষার ইন্ডাস্ট্রিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন।
তারপরও তার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না কেন? তার অভিনীত ক’টা ছবির প্রিন্ট সংরক্ষিত আছে খোদ প্রযোজকদের দপ্তরে?
৭০ বছরের পুরোনো মুঘলে আজম সাদা-কালোয় নির্মিত হয়ে ফ্রেম বাই ফ্রেম কালার কারেকশন করে সম্পূর্ণ রঙিন হয়ে গেছে, আজও বিভিন্ন উপলক্ষে ভারতের সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়, দর্শকদের ঢল নামে বহুবার দেখা ছবিটা আবারও থিয়েটারে গিয়ে দেখতে।
আমাদের দেশের কোন ছবিটা দশ বছর পরে আরেকবার সিনেমা হলে প্রদর্শনযোগ্য? ভারতের নায়ক-নায়িকারা মারা গেলে তাদের মুভি চ্যানেলগুলোতে সদ্য প্রয়াত তারকার অভিনীত সিনেমাগুলো দেখানো হতে থাকে।
আমাদের দেশের কোনো একটি টিভি চ্যানেল কি অঞ্জনার অভিনীত কোনো সিনেমা প্রচার করেছে? আছে কি তাদের কাছে কোনো একটি সিনেমা? একাধিকবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী, তিন তিনবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী – তার কোনো কাজেরই কোনো রেকর্ড সংরক্ষণের প্রয়োজন যে ইন্ডাস্ট্রি অনুভব করে না, সেটা কীভাবে একটা জীবিত ইন্ডাস্ট্রি হতে পারে?
চিত্রনায়িকা অঞ্জনার যে মৃত্যুসংবাদ গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে, সেগুলো কিছতা বিভ্রান্তিকর। যেমন, রিপোর্টগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে, মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
সেই হিসাবে ধরে নেওয়া যায়, তার জন্ম ১৯৬৫ সালে। অথচ ওই রিপোর্টই বলছে, তার প্রথম সিনেমা চিত্রনায়ক সোহেল রানার বিপরীতে ‘দস্যু বনহুর’, যা ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায়। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটার নির্মাণ শুরু হয় ১৯৭৫ সালে, তাহলে কি মাত্র ১০ বছর বয়সে এই সিনেমায় নায়িকা হন অঞ্জনা? …
তিনশ’ ছবির নায়িকা হওয়ার পরও এই যে নিজেকে সর্বজনগ্রাহ্য করতে না পারা, একটা গোটা প্রজন্মের কাছে পরিচিত করতে না পারা– তার পেছনে বোধকরি এটাই সবচেয়ে বড় কারণ সময়ের সঙ্গে চলতে না পারা, নিজেকে আপডেট করতে ব্যর্থ হওয়া।
‘মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই’ কিংবা ‘নায়িকারা বরাবরই বয়স কমিয়ে বলেন’Ñ এসব কথা মেনে নিয়েও বলতে হয়, একটা সময়ের পর এসে বাস্তবতা মেনে নিতে হয়। অন্তত ত্রিশ বছর আগে নায়িকার অবস্থান হারিয়েছেন যিনি, তাকে অনর্থক খুকি সেজে থাকা মানায় না। চলতে শুরু করার সময়েই শিখতে হয় কখন থামতে হবে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির অধিকাংশ চরিত্র এটা শেখেননি, শেখেন না।
কখন থামতে হবে সেটা শেখার মানেই যে থেমে যাওয়া, তা বলছি না। অমিতাভ বচ্চন এখনও অভিনয় করছেন এবং আমৃত্যু করে যাবেন বলে তার প্রতিজ্ঞা জানিয়ে রেখেছেন। তাহলে কি তিনি থামতে জানেন না? জানেন। জানেন বলেই তিনি সেই চরিত্রগুলোতেই অভিনয় করেন, যেগুলো তার চলতি বয়সের সঙ্গে মানানসই। আশি বছর বয়সে তিনি চল্লিশ বছর বয়সী চরিত্রে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সংগ্রাম করেন না।
অঞ্জনাই বা কেন সত্তর-বাহাত্তর বছর বয়সেও ত্রিশ বছরের তরুণীর মতো ‘লুক’ আনতে মেকআপের পলেস্তারা ঘষেই চলতেন চেহারায়? কেন ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দেওয়ার দুই দশকের বেশি সময় পরও বয়স নিয়ে এই লুকোচুরি? এসব হাস্যকর ‘আনস্মার্টনেস’ই যে তাদের অপাংক্তেয় করে দেয়, আলোচনার অযোগ্য করে রাখে – এটা বুঝতে কি অনেক বেশি বুদ্ধি রাখতে হয় মাথায়?
প্রবীর মিত্রের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়সের সমান। অত্যন্ত দক্ষ এই অভিনেতা চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন ঊনসত্তরের টালমাটাল রাজনৈতিক বাতাবরণে, তার প্রথম ছবি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনটিতে।
প্রবল বৈরী সেনাশাসনের আওতায় পশ্চিম পাকিস্তানি নিষ্পেষণ আর চলচ্চিত্র জগতে করাচির প্রভুত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ঢাকায় যখন নতুন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্য রীতিমতো বিপ্লব শুরু করলেন সালাউদ্দিন, এহতেশাম, ফতেহ লোহানী, জহির রায়হান প্রমুখ কীর্তিমানেরা, তখন তাদের প্রয়োজন হলো বাঙালির নিজেদের অভিনেতা-অভিনেত্রীর, বাঙালি নায়ক-নায়িকার। সেই সময়েই রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, শওকত আকবরদের চলচ্চিত্রে আগমন হয়।
এই নায়কদের একই সঙ্গে লড়তে হচ্ছিল করাচির উর্দুভাষী তারকাদের পাশাপাশি কলকাতার উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়দের বিরুদ্ধেও। শুধু তাই নয়, হিন্দি ছবির দেব আনন্দ, দিলিপ কুমার, রাজ কাপুররাও যথেষ্ট ভাগ বসাতেন তাদের দর্শক-অংশীদারত্বে। খুবই বিশ্বাসযোগ্য কাহিনির অত্যন্ত প্রাণবন্ত অভিনয় ছাড়া কেবল চেহারা দেখিয়ে সাদাকালো পর্দায় নিজের অবস্থান ধরে রাখা সে কালে একেবারেই সম্ভব ছিল না।
সেই যুগে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেই নিজেদের অবস্থান গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন পূর্বোক্ত অভিনেতারা।
তাদেরই উত্তরসূরি প্রবীর মিত্র স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তত দুটো দশক সেই দাপটটা ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু তারপর, আমাদের চলচ্চিত্রের নিজেরই যখন যুগের হাওয়ার ঝাপটায় খড়কুটোর মতো উড়ে যাওয়ার উপক্রম, তখন প্রবীর মিত্রও ক্রমশ হয়ে পড়লেন অপ্রাসঙ্গিক।
নব্বইয়ের পর তার অভিনীত অধিকাংশ চরিত্রের স্থায়িত্ব থাকতো বড়জোর পাঁচ থেকে দশ মিনিট।
বুড়ো বাপ বা রোগশয্যায় পড়ে থাকা দাদা-নানা, খক খক করে কাশতে কাশতে মরে গিয়ে জায়গা খালি করে দেওয়াই যার একমাত্র কাজ। বিটিভির এক অনুষ্ঠানে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি খোলাখুলি আক্ষেপ করেছিলেন এ নিয়ে। বলেছিলেন, আমি নিজেও বুঝতে পারি না কেন আমাকে ওই রকম ক্ষণস্থায়ী একেকটি চরিত্রেই বারবার নির্বাচন করা হয়।
এর কারণটা কী? নির্মাতা কি মনে করেন আমি অভিনয় জানি না? এর চেয়ে বেশি ব্যাপ্তির চরিত্র আমি ফুটিয়ে তুলতে পারবো না? নাকি চরিত্রটাকে আরও বড় করতে তার অনেক খরচ হয়ে যাবে? খরচটা কারণ হয়ে থাকলে আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমার পারিশ্রমিক নিয়ে অন্তত ভাবতে হবে না, আমি অল্প টাকাতেই বেশি দিন ধরে অভিনয় করতে প্রস্তুত।
আর যদি এমন হয়ে থাকে যে ওই দুটো-চারটে দৃশ্যের বাইরে চরিত্রটার দরকারই নেই, তাহলে বরং ওটুকুও না রাখুক। দেয়ালে একটা ছবি ঝুলিয়ে দিলেই তো বোঝা যায় এরকম একজন বাবা বা দাদা ছিল তাদের, এখন যিনি নেই! ব্যস, ঝামেলা শেষ!
চলচ্চিত্র উৎকর্ষের সঙ্গে মূলত দুটি দিক জড়িত। একটি সৃজনশীল দিক, অন্যটি কারিগরি।
কাহিনি, সংলাপ, অভিনয় দক্ষতা, সংগীত, নৃত্য ইত্যাদি ছবিটির সৃজনশীল দিক। আর এর কারিগরি দিকে থাকে নির্মাণের দিকটিÑ সিনেমাটোগ্রাফি, লাইট, সাউন্ড, এডিটিং, কালার গ্রেডিং, ডাবিং ইত্যাদি। চিত্রনাট্য, আবহসংগীত, পোশাক পরিকল্পনাÑ এগুলো আধা সৃজনশীল, আধা কারিগরি দিক।
আমাদের চলচ্চিত্র সৃজনশীল দিকটাতে বরাবর উদাসীন। নকল গল্প বা গড়পড়তা বৈচিত্র্যহীন কাহিনি, অনাকর্ষণীয় সংলাপ, অভিনয় না জানা অভিনেতা-অভিনেত্রী, নকল সুরের সস্তা কথার গান, নকল-সর্বস্ব ও অশ্লীলতায় ভরা নাচ বা কোরিওগ্রাফি – এগুলোকে আর যাই বলা যাক, সৃজনশীলতা বলা যায় না।
এবং এসব নিয়ে নির্মাতারা একেবারেই কিছু ভাবেন বলে মনে হয় না। এ দেশের নির্মাতারা মনে করেন, কারিগরি দিকটা ঠিক রাখতে পারলেই একটা ‘হিট সিনেমা’ বানানো যাবে।
কার্যত, কারিগরি দিকটাতেও তারা বরাবর দুর্বল। গ্রহণযোগ্য মানের চেয়ে অনেক অনেক নিচে থাকে তাদের ছবির কারিগরি দিকটা।
ডিজিটাল যুগে প্রবেশের আগে আমাদের সিনেমার স্ক্রিন যে এতাই অস্পষ্ট ও অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল, তা আর বলতে নেই! থার্টি-ফাইভ মিলিমিটার সেলুলয়েডের যুগে না সিনেম্যাটোগ্রাফি, না ফিল্ম ডেভেলপ, না কালার গ্রেডিং, না লাইট কারেকশন– কোনো একটা দিকেও টেনেটুনে পাসমার্ক পাওয়ার মতো কাজ বছরব্যাপী খুঁজে পাওয়া যেতো না।
চিত্রনাট্য নিয়ে আদৌ কোনো পরিচালক-লেখক ভাবতেন বলে মনে হয় না। কিছু ছবি চলতো নায়ক-নায়িকার জনপ্রিয়তার জোরে, কিছু চলতো গানের জোরে। ছবির গল্প তো বলাই বাহুল্য, নির্লজ্জ নকল-নবিসি। অথচ তারা বাজেট কমানোর নামে সিনেমায় অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যা কমাতে বরাবর তৎপর থাকেন।
নায়ক-নায়িকা, নায়কের একজন কমেডিয়ান বন্ধু, একজন ভিলেন ও তার কিছু চ্যালাচামুন্ডা, নায়িকার এক বা একাধিক সখী।
আর খুব দয়াপরবশ হয়ে নায়ক-নায়িকার দুজন মিলিয়ে একজন মা’কে রাখা, অর্থাৎ নায়কের মা থাকলে নায়িকার থাকবে না, নায়িকার মা থাকলে নায়ক এতিম। এই হলো আমাদের সিনেমার টোটাল কাস্টিং।
সেখানে প্রবীর মিত্রর মতো শক্তিমান অভিনেতার ক্ষয়কাশে আক্রান্ত হয়ে শক্তি হারিয়ে কাশতে কাশতে মরে যাওয়া ছাড়া গতি কী? সিনেমার পর্দায় বারবার অবহেলা সয়ে মরে যাওয়ার দৃশ্যে অভিনয় করতে করতে বেচারা এবার সত্যি সত্যিই মরে গেলেন… অবহেলা সয়েই মরে গেলেন!
প্রবীর মিত্রের মৃত্যু সংবাদ আমি গণমাধ্যমে এখনও খুঁজে দেখিনি, তবে অঞ্জনার মৃত্যুসংবাদ আমি কয়েকটা কাগজে পড়েছি। তার সময়ের সহকর্মীদের এবং তার পরের প্রজন্মের ক’জনের প্রতিক্রিয়া পড়েছি। সেই প্রজন্ম বড়জোর জয়া আহসান পর্যন্তই গড়িয়েছে।
তার পরের নায়িকারাও সম্ভবত কোনোদিন নাম শোনেননি অঞ্জনার। ইলিয়াস কাঞ্চন বললেন, অঞ্জনা একাকিত্বে ভুগছিলেন। কর্মহীন ছিলেন। তা থেকে আমার মনে হলো, আর্থিক সংকট হয়তো তার ছিল না, কিন্তু তিনি সংকটে ছিলেন বৈকি। তিনশ’ সিনেমায় অভিনয় করা অভিনেত্রী যখন চুপচাপ ঘরে বসে থাকেন, তখন কোনো সন্দেহ নেই যে তা অনেক বড় সংকট। আলো ঝলমল রুপালি পর্দার দিনগুলো আর ফিরবে না– এটা মেনে নিয়েও একটু সঙ্গ তো মন চাইবেই।
সামাজিক যোগাযোগের ‘কৃত্রিম জগতে’ নয়, বাস্তবের সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দিতে মন চাইবে। এবং সেসব হতে হবে চলচ্চিত্র কেন্দ্রিক। কারণ, জীবনের অর্ধেকের বেশি যে জগতকে দিয়ে দেওয়া হয়, সেই জগতের বাইরে আর কিছুই থাকে না একজন তারকার জীবনে। সিনেমা থেকে অবসর নেওয়ার পরও তাই যখন যে অনুষ্ঠানেই যান না কেন, চাইবেন সেখানে চলচ্চিত্রের মানুষদের সঙ্গে দেখা হোক।
কিন্তু তেমন অনুষ্ঠান কি হতো আমাদের দেশে? হয় সেভাবে? বছরে এক-আধটা অ্যাওয়ার্ড শো ছাড়া আর কোনো আয়োজন কি হয় এ দেশে?
শিল্পীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ কেমন? সম্পর্ক কেমন? সদ্ভাব কতা? শাহরুখরা যেভাবে বলতে পারেনÑ ফিল্ম ফ্রেটার্নিটি, সেভাবে আমরা কতা দাবি করতে পারি? আদৌ পারি কি? সভাপতির চেয়ার নিয়ে বছরভর কামড়াকামড়ি করা ছাড়া এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির আদৌ কোনো কার্যক্রম আছে কি? পরিচালক সমিতির ভূমিকাই বা কী? প্রযোজক সমিতিও তো দেখলাম তাদের শপথ অনুষ্ঠানেই মারপিটের ঘটনা ঘটিয়ে নাম কামালো বেশ! … তো, এরকম একটা পরিবেশে একজন অবসরে যাওয়া শিল্পী একাকিত্বে ভুগবেন– এটাই তো স্বাভাবিক।
মৃত্যুকে বরণ করতে হবে প্রতিটি জীবিত প্রাণীকেই। বয়সের সঙ্গে প্রকৃতির নিয়মে চলে যেতে হবে সবাইকেই।
তবু প্রিয় মানুষদের বিদায় আমাদের ব্যথিত করে। কিন্তু জীবিত থাকতেই এভাবে তাদের ইমেজের মৃত্যুও কি আমাদের ব্যথিত করতে পারে? ব্যথিত না করুক, একটুও কি ভাবিত করে? অঞ্জনা-প্রবীর মিত্ররা চলে গেলেন বিধায় আপনি জানলেন তারা ছিলেন এতদিন।
তো এবার কার পালা– মরে গিয়ে আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার যে তিনিও এতদিন জীবিত ছিলেন? বেঁচে থাকতে কি একবারও আমরা তাদের এই উপলব্ধিটুকু হতে দিচ্ছি যে– আমাদের জন্য, আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য, সংস্কৃতির জন্য, শিল্পের জন্য– সর্বোপরি দেশের মানুষের জন্য তারা আদৌ কিছু অবদান রাখতে পেরেছিলেন?
তাদের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের পরিশ্রম, মেধা, দক্ষতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে আদৌ তারা আমাদের মন জয় করতে পেরেছিলেন?
এতা অকৃতজ্ঞ হওয়াও কি আমাদের সাজে!
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও গবেষক