মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ভূঞা
কর্তৃপক্ষের অবহেলা, নিষ্ক্রিয়তা, ট্রাভেল এজেন্সির দুর্নীতি, দেশীয় পর্যটকদের অনাচার ও সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প। দেশের অভ্যন্তরে পর্যটন গন্তব্যের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজার, সিলেট, সুন্দরবন অন্যতম। খাগড়াছড়ির সাজেক, রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেক, বান্দরবানের নীলগিরি, নীলাচল, নাফাখুম, আলীকদম, কেউক্রাডং ইত্যাদি স্থানে একসময় দলে দলে পর্যটক সমাগম হলেও গত কয় বছরে নানা নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে সেখানে যেতে কেউ সাহস করছেন না। জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে কাছিমের বংশবৃদ্ধি নির্বিঘ্ন করতে পরিবেশবাদীদের বাধার মুখে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন বন্ধের পথে।
দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ভ্রমণ গন্তব্য সুন্দরবন বছরের অর্ধেক সময় বন্ধ থাকে। সিলেট ভ্রমণের উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। শুকনো মৌসুমে সিলেটে পর্যটক সমাগম হয় না বললেই চলে। এহেন পরিস্থিতিতে নানা ধরনের হয়রানি, স্ক্যামিং, চারদিকের নোংরা পরিবেশ, নিরাপত্তাহীনতা উপেক্ষা করেও প্রতি সপ্তাহান্তে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটে কক্সবাজারে। নানা অনিয়ম, অবহেলা ও অপরিকল্পিত উন্নয়নে পৃথিবীর দীর্ঘ এই সমুদ্র সৈকতের অবস্থাও সঙ্গিন।
বাংলাদেশি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় বৈদেশিক ভ্রমণ গন্তব্যগুলোও একের পর এক বন্ধ হয়ে লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে ৩৯টি দেশে বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টে ভিসা ফ্রি বা ভিসা অন অ্যারাইভাল ভ্রমণ করা যায়। ২০২৪ সালেও এই সংখ্যা ছিল ৪২। আরো আগে এ সংখ্যাটি ছিল ৪৮। এই সংখ্যা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি হলেও মালদ্বীপ, ভারত, ভুটান, মিয়ানমার ও শ্রীলংকার চেয়ে কম।
শক্তিমত্তার বিচারে বাংলাদেশের পাসপোর্ট এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্নে অবস্থান করছে। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতি এশিয়ার মধ্যে নবম ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। বৈশ্বিক সূচকে দেশের পাসপোর্টের মানের অবনমন ও ভিসা ফ্রি দেশের সংখ্যা কমে যাওয়া আমাদের জন্য বিব্রতকর। এতে বহির্বিশ্বে দেশ ইমেজ সংকটে পড়ছে। করোনা পরিস্থিতিতে ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের পর্যটকদের জন্য ভিসা অন অ্যারাইভাল সুবিধা বাতিল করেছিল, পরে তা আর চালু করেনি। এখন তাদের দূতাবাস থেকে উচ্চমূল্যে ভিসা নিতে হয় এবং তাও অনেক সময়সাপেক্ষ। করোনার পরে ভুটান বাংলাদেশি পর্যটকদের উপর নানা বিধিনিষেধের পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত ভ্রমণ ফি ধার্য করলে ভুটানের দরজাও বন্ধ হয়ে যায়।
গত কয়েক বছরে ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ছিল বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য সহজলভ্য ও আকর্ষণীয় গন্তব্য। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে ইন্ডিয়া ভিসা বন্ধ করে দিলে পর্যটকরা সত্যিকার বিপদ দেখেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত টুরিস্ট ভিসার শর্ত সহজ করলে হাজার হাজার বাংলাদেশি টুরিস্ট ভিসায় আবুধাবি গিয়ে ফিরে না এসে রাস্তার ধারে, গাছের তলায় রাত যাপন করতে শুরু করে। অবৈধ অভিবাসীর চাপ সামলাতে গত বছরের জুনে আবুধাবি বাংলাদেশিদের সব ধরনের ভিসা প্রদান বন্ধ করে দেয়। গত আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অন অ্যারাইভাল ভিসার সুযোগ নিয়ে বহু বাংলাদেশি কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে প্রবেশ করে থেকে যাওয়ার চেষ্টায় আত্মগোপন করে। এতে কম্বোডিয়ার সরকার দ্রুত পদক্ষেপ হিসেবে ভিসা দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দেয়। একই কারণে ভিয়েতনামও এখন সতর্ক; ভিসা দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে।
সর্বশেষ ঈদুল আজহার বড় ছুটি সামনে রেখে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের ভিসা পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাংলাদেশি পর্যটকরা। জানা যাচ্ছে সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডও ভিসা প্রদান কমিয়ে দিয়েছে। জমাকৃত ৯০ শতাংশের বেশি ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করছে দেশ দুটি। এভাবে বিদেশের সব দরজা একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ কী? কেনো এমন হচ্ছে? কারণ প্রথমত কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও দ্বিতীয়ত আমাদের আত্মমর্যাদাবোধের অভাব। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বঙ্গমাতা’ কবিতায় লিখেছিলেন- ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি।’ আমরা আজও ঠিক মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।
আমরা যারা ‘জেনারেশন Y’-এর প্রতিনিধিত্ব করি- আমরা পড়া না বোঝে মুখস্থ করে পাস করা প্রজন্ম, আমরা নকল করে পরীক্ষা পাস করা প্রজন্ম, আমরা প্রশ্ন ব্যাংকের প্রশ্নে টিক চিহ্ন দিয়ে পাস করা প্রজন্ম। সেই শিক্ষায় আমরা সভ্যতা-ভব্যতা, রুচিশীলতা, সততা, শৃঙ্খলা, সৌন্দর্যবোধ, দেশপ্রেমের মতো মানবিক গুণাবলি অর্জন করতে পারেনি; নিজেদের আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের আচরণে গ্রহণযোগ্য ও কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনতে পারিনি।
অন্যদিকে ‘জেনারেশন Z’-এর হালও একই। তারা গত পাঁচ বছর ঠিকঠাক লেখাপড়া করেনি, শর্টকাটে পার হওয়া এই প্রজন্মও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন হয়ে ওঠেনি। তারা ক্লাস বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাদা ও লাল দলে ভাগ হয়ে রাজনীতি করতে দেখেছে। রাজনীতির মাঠে শিক্ষকগণকে রক্তাক্ত হতে দেখেছে। খুনোখুনিতে ক্যাম্পাসে তালা ঝুলতে দেখেছে। ছাত্রছাত্রীরা লাঠিসোটা নিয়ে মিছিল-মিটিং, জবরদস্তি ইত্যাদি করেছে। দুটো প্রজন্মই প্রকৃত অর্থে দেশপ্রেমিক ও আত্মমর্যাদাবান হয়ে উঠেনি। ফলে শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত-দেশের স্বার্থ নিয়ে কাউকেই ভাবতে দেখা যায় না। সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি।
আমরা দুই প্রজন্ম মিলে দেশের ভেতর ও বাইরে সবখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছি, অবলীলায় দেশের ভাবমূর্তির বারোটা বাজিয়ে যাচ্ছি। টুরিস্ট ভিসায় বিদেশ গিয়ে না ফিরে যে কোনো উপায়ে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করি। বাড়তি টাকায় কন্ট্রাকে ভিসা করে, এয়ারপোর্টে ঘুস দিয়ে বিদেশ গিয়ে রিফিউজি হয়ে পড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে অড জব করি। এসবে দেশের ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই অনেক দেশ আমাদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ জন্য একে একে বন্ধ হচ্ছে বৈদেশিক পর্যটনের সব দুয়ার।
উপায় কী: টুরিস্ট ভিসায় বিদেশ গমনেচ্ছুদের বোর্ডিং পাস দেওয়ার আগে যাচাই করতে হবে। যাত্রীর প্রোফাইল চেক করতে হবে। দেশে ভাল বেতনের স্থায়ী চাকরি কিংবা ব্যবসায় আছে কি না, ফ্যামিলির স্ট্যাটাস, লেখাপড়া, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি তথ্য যাচাই করলে অনেকে আটকা পড়বেন। এভাবে স্ক্রিনিং করে ছাড়লে সুযোগ সন্ধানীরা বিদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত হবেন। প্রকৃত পর্যটকগণ বিদেশ বিভূঁইয়ে হয়রানির শিকার হবেন না। এছাড়া কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। ভিসা ফ্রি বা অন অ্যারাইভাল ভিসা প্রদানকারী দেশের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
দেশের মধ্যকার পর্যটন গন্তব্যগুলোর নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। সুন্দরবন ও সেন্টমার্টিনকে সারাবছর পর্যটনের জন্য খোলা রাখতে হবে। তবেই পর্যটনে সুদিন ফিরবে।
লেখক : শিক্ষক
[email protected]
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ