সালেক উদ্দিন : শেষ পর্যন্ত ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাত্র জনতার গণ-আন্দোলনে রূপ নিল। এক মাসের মধ্যেই এলো এর পরিণতি। প্রায় ৩ শতাধিক মানুষের তাজা রক্তের বিনিময়ে ছাত্র জনতার এই গণ-আন্দোলন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন করলো। ৫ আগস্ট বাংলাদেশের চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। শুধু পদত্যাগই না বড় করুণভাবে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে অনেক। পত্রপত্রিকার হিসাব অনুযায়ী প্রায় তিনশত সম্ভাবনাময় মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। আন্দোলনকারীরা সরকার পতনের ডাক দিলে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। ইতোমধ্যে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠনের প্রচেষ্টা চলছে। সেই লক্ষ্যে সেনাপ্রধান দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে নিজে বৈঠক করেছেন এবং তাদের নিয়ে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করিয়েছেন এবং আন্দোলনকারী ছাত্র সমন্বয়কদের সাথে আলোচনাতেও বসবেন। আমরা আশাবাদী, আশা করছি এর ভেতর দিয়ে একটি সুফল আসবে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর গণআন্দোলনের যে চিত্র চোখে পড়লো তার এক পিঠ আনন্দঘন হলেও আরেকটি পিঠ ছিল খুব লজ্জার। ৫ আগস্ট দুপুর থেকেই শুনছিলাম সব স্তরের জনসাধারণ গণভবনে প্রবেশ করে গণভবনের সব কিছু ভেঙে চুরে লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। আমার উৎসুক মন চাইলো দৃশ্যটি দেখে আসতে। স্ত্রী এবং কন্যার বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও আমি আরেকজন কলাম লেখক ও কথাসাহিত্যিক বন্ধুকে নিয়ে সত্যটা দেখতে গেলাম। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে গণভবন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। তবে রাস্তায় দেখলাম গণভবনের মূল্যবান আসবাবপত্র, কম্পিউটার ল্যাপটপসহ অতি সামান্য জিনিসটিও এমনকি কাপড় চোপড়, ফাইলপত্র, গাছের টব ইত্যাদি মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে শতশত মানুষ এবং এ নিয়ে তারা বেশ গর্ববোধ করছে। আসাদগেট পার হয়ে দেখলাম একটি দামি জিপ গাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছে। এই গাড়িটি সরকারের নাকি সাধারণ একজন মানুষের তা প্রত্যক্ষদর্শীরা কেউ বলতে পারলো না।
আমার আর দেখতে ইচ্ছে করলো না। বন্ধুকে নিয়ে ফিরে এলাম। এসব দেখে ও শুনে একটা আশঙ্কা দানা বেঁধেছে যে, এত অর্জনের পরেও আমাদেরকে কি আরও ধ্বংসযোগ্য দেখতে হবে? আমার বয়োজ্যেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক বন্ধুটি বললেন, এটাই শেষ নয়। অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি। ইতিপূর্বেও বহুবার দেখেছি। এই কর্মটি কারা করে, কেন করে আমার জানা নেই। তবে বৃহৎ অর্জনকে কলুষিত করার জন্য এটি একটি মোক্ষম অস্ত্র! বাসায় ফিরে এসে টেলিভিশনে দেখলাম, এই আশঙ্কা শুধু আমার বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধুটির নয়। সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের, ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের, সেনাপ্রধানের, এমন কি স্বয়ং রাষ্ট্রপতির। তাঁদের সকলের বক্তব্যেই এটা উঠে এসেছে। আমি জানি না আমার এই লেখা ক’জনে পড়বে কিংবা আদৌ কেউ পড়বে কিনা। তারপরও যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো, এই বিজয়ের পরও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়, স্থাপনা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা বিভিন্ন জায়গা থেকে শুনছি। অনুরোধ থাকবে যেন আর একটি ঘটনাও না ঘটে। সকল রাজনৈতিক দল, আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা ইতিমধ্যেই এসব ঘটনা না ঘটানোর অনুরোধ করে আসছেন। আমরা আশা করবো যেন তাদের এই অনুরোধের প্রতিফলন ঘটে। যেন এই বিজয়ের মুখে কেউ কলঙ্কের ছাপ লেপটে দিতে না পারে। ‘ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ’ আমাদের এই আদর্শ যেন প্রমাণিত হয়। আর এর জন্য প্রয়োজন– এখন থেকে আর কোনও ধ্বংসযজ্ঞ যেন না ঘটে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া। আন্দোলনের সময় যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, যে অফিস আদালত গাড়ি বাড়ি পোড়ানো হয়েছে– ধ্বংস করা হয়েছে। এখন তো আর সেই প্রয়োজনীয়তা নেই। এরপরও যদি কোনও ঘটনা ঘটে তবে ধরেই নিতে হবে এটি একটি গোষ্ঠীর সুচিন্তিত পদক্ষেপ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর প্রয়াস। অতএব ধর্মীয় সম্প্রীতিতে আঘাতসহ সকল ধ্বংসযজ্ঞ এখনই বন্ধ হোক। যে যে পর্যায়ে রয়েছেন তাকে সেই পর্যায় থেকেই এটাকে বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অন্যথায় ছাত্র জনতার গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে ফসল ঘরে উঠেছে তা বিনষ্ট হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
ধ্বংসযজ্ঞ এখনই বন্ধ হোক
ট্যাগস :
ধ্বংসযজ্ঞ এখনই বন্ধ হোক
জনপ্রিয় সংবাদ