মীর আব্দুল আলীম
পরকীয়া, ব্যভিচার, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি, সমকামিতা এর সবই যৌনতা। কোনোটা সেচ্ছায়; আবার কোনোটা জোড়পূর্বক। আইনে শাস্তির ভিন্নতাও আছে। ধর্ষণ আর অবৈবাহিক আপোসের যৌনাচার ব্যভিচারের বিচার এক নয়। ধর্ষণ বলে সব যৌনতাকে চালিয়ে দেয়া যাবে না। যেটা আমাদের দেশে হচ্ছে। চুন থেকে পান খসলেই ফাঁসিয়ে দিতে আপোসের যৌনাচারকে ধর্ষণ বলে অভিযোগ তোলা হয়। তা মোটেও সমীচীন নয়। কোনোটাই সমর্থন যোগ্য অপরাধ নয়। শাস্তি যোগ্য সবটাই। তবে সাজার প্রকারভেদ আছে। আইনে পরকীয়া, ব্যভিচার, পতিতাগামিতার বিচার অবশ্যই হতে হবে; যেন ধর্ষণের অপরাধে ফেলে সেসব বিচার না হয়, এ বিষয়ে প্রশাসন খেয়াল রাখতে হবে।
ব্যভিচার বলতে বোঝায় বিয়ে বন্ধন ছাড়া অবৈধ পন্থায় যৌন তৃপ্তি লাভ করাকে। এসব অবৈধ পন্থায় যৌন সম্ভোগ এদেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইসলামী শরিয়তে সম্পূর্ণ হারাম। রাষ্ট্রীয় বিধান মতে, একেকটার একেক ধরনের সাজা রয়েছে। দেশে যেহেতু ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা বলবৎ, সেহেতু সব অপরাধকেই ধর্ষণের আওতায় এনে অনেকেই আজকাল বাড়তি সুবিধা পেতে আদালতে যান। তখন আপোসে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া ব্যক্তিটিই সর্বোচ্চ সাজার আওতায় আসেন।
একটু জেনে নেওয়া যাক ধর্ষণ এবং অবৈবাহিক আপোসের যৌনাচার কি? এক নয়। সব যৌনতাকে কোনোমতেই ধর্ষণ বলা যাবে না, ধর্ষণ বলে চালিয়ে দেওয়াও ঠিক না। চুক্তিতে না মিললে পতিতা, কথায় না মিললে আপোসে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া নারী সহজেই তা ধর্ষণ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। প্রমাণও মিলছে ধর্ষণের, সাজাও হচ্ছে ধর্ষণের। এ দেশে তা হচ্ছে হরহামেশাই। ধর্ষণের সাজা ইসলামিক এবং রাষ্ট্রীয় সাজা এক ধরনের আবার বিবাহোত্তর যৌনতা এবং বিয়ে-পূর্ব যৌনতার সাজা আরেক ধরনের। আমাদের দেশে যৌনতা যেভাবেই হোক না কেন, সবটাই ধর্ষণের কাতারে ফেলা হয়। গোটা বিষয়টা ধর্ষণ নয়।
জানতে হবে ধর্ষণ কী? জোরপূর্বক অবৈবাহিক যৌনসঙ্গম হলো ধর্ষণ। পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহিতের অবৈবাহিক যৌন সম্পক হলো পরকীয়া। বিবাহোত্তর যৌনতা এবং বিবাহপূর্ব যৌনতা। দুজন অবিবাহিতের পারস্পরিক সম্মতিতে যৌনসঙ্গম হলো ব্যভিচার। অর্থের বিনিময়ে যৌনসঙ্গম হলো পতিতাবৃত্তি। সমলিঙ্গীয় ব্যক্তিদ্বয়ের পারস্পরিক সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক হলো সমকামিতা। ধর্মীয় দৃষ্টিতে পরিবারের সদস্য বা অবিয়েযোগ্য রক্তসম্পর্কের ব্যক্তির সঙ্গে যৌনসঙ্গম হলো অজাচার। অমানব পশুর সঙ্গে যৌনসঙ্গমকে পশুকামিতা বলে। আমাদের দেশে এজাতীয় যৌনতায় লিপ্ত অনেক নারী পুরুষ। এসবেরও বিচার হতে হবে।
জিনা ও ধর্ষণের পার্থক্য কী? জিনা ও ধর্ষণ ইসলামি শরিয়াহ ও সমাজবিজ্ঞান উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়, যদিও দুটিই নৈতিক ও সামাজিক অপরাধ। জিনা হলো নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিয়েবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিচিত্র এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ হতে পারে। ইসলামী আইন অনুযায়ী, জিনা অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তি যদি অবিবাহিত হয়, তবে তাকে ১০০ দোররা মারার শাস্তি দেওয়া হয় আর বিবাহিত হলে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
অন্যদিকে ধর্ষণ সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অধিকতর গুরুতর অপরাধ। এটি এমন একটি জঘন্য ও পৈশাচিক কার্যকলাপ যেখানে একজন ব্যক্তি জোরপূর্বক, ভয় দেখিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে অন্যের সম্মতি ছাড়াই তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ধর্ষণ শুধু শরিয়াহ নয়, সাধারণ আইনেও গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় এবং সমাজে এটি ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনে। ইসলামে ধর্ষকের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, এমনকি প্রয়োজনে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত কার্যকর করা যেতে পারে। সুতরাং জিনা ও ধর্ষণ উভয়ই পাপকর্ম হলেও, জিনায় পারস্পরিক সম্মতি থাকে, আর ধর্ষণে ভুক্তভোগীর সম্মতি থাকে না বরং জোরজবরদস্তি, প্রতারণা ও শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন থাকে। এ জন্য আইন প্রণয়ন ও বিচারকার্য পরিচালনার সময় এই মৌলিক পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে বিবেচনায় রাখা জরুরি।
মিথ্যা ধর্ষণ মামলা- এক ভয়াবহ বাস্তবতা: ধর্ষণ আইনের অপব্যবহারের ফলে অনেক নির্দোষ পুরুষের জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রেমের সম্পর্ক থেকে তৈরি হওয়া অসন্তোষ বা প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব থেকে অনেক নারী মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। এতে প্রকৃত ধর্ষণের শিকার নারীদের ন্যায়বিচার পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই প্রতিটি অভিযোগ যাচাই করা এবং মিথ্যা মামলা প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি।
বর্তমানে সমাজে মিথ্যা ধর্ষণ মামলার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে; যা আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। অনেক নিরপরাধ ব্যক্তি বছরের পর বছর কারাবন্দি থাকেন, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হন এবং মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস হয়ে যান। অন্যদিকে প্রকৃত ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে যায়। কারণ মিথ্যা অভিযোগের কারণে আসল মামলার গুরুত্ব হারিয়ে যায়। এ সমস্যার সমাধানে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়ার পর দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করা জরুরি। মিথ্যা মামলা করলে তার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান কার্যকর করা হলে আইনের অপব্যবহার কমে আসবে এবং প্রকৃত ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাবেন।
আইনের যথাযথ প্রয়োগই পারে নিরপরাধ ব্যক্তিদের সুরক্ষা এবং ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করতে।
প্রকৃত ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে: যারা প্রকৃত ধর্ষক, তারা যেন কোনোভাবেই আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে না পারে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অনেক সময় প্রভাবশালী ধর্ষকরা টাকার জোরে, রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে বিচারের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায়। এটি সমাজের জন্য ভয়াবহ সংকেত বহন করে। ধর্ষণের মতো অপরাধের শাস্তি কঠোর না হলে অপরাধ প্রবণতা আরও বাড়বে। তাই এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রাখা উচিত।
বিয়ের প্রতিশ্রুতি ও ধর্ষণের আইনি ব্যাখ্যা: বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি একজন পুরুষ নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং পরবর্তীতে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তবে এটি ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হতে পারে। তবে প্রশ্ন হলো, প্রতিশ্রুতিটি কি ছিল ভুয়া, নাকি বাস্তবতার কারণে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি? অনেকে বিয়ের কথা বলে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, পরে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কারণে সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখতে পারেন না। তাই প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখা জরুরি, যাতে প্রকৃত অপরাধী শাস্তি পায় এবং নির্দোষ কেউ হয়রানির শিকার না হয়।
প্রশ্ন হলো, দেশে এত ধর্ষণ, যৌনাচার হচ্ছে কেন? তা রোধের উপায় কি? ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন এবং আপোষ যৌনতা বন্ধে আগে আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। এসব াপরাধ কমাতে হলে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলী জাগ্রত করতে হবে। ধর্ষণ, ব্যভিচার রোধে সচেতন হতে হবে। অবাধ মেলামেশার সুযোগ, লোভ-লালসা-নেশা, উচ্চাভিলাষ, পর্নো সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাচ-গান, যৌন উত্তেজক বই-ম্যাগাজিন, অশ্লীল নাটক-সিনেমা ইত্যাদি থেকে সরে আসতে হবে। এগুলো বর্জন করতে হবে। পর্ণোসাইটগুলো বন্ধ করতে হবে যেন মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে তা দেখা না যায়। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বাজে সঙ্গ ও নেশা বর্জন করতে হবে। এর পাশাপাশি নারীকেও শালিন হতে হবে। যৌন উত্তেজক পোষাক বর্জন করতে হবে। বলা বাহুল্য, প্রবল কামোত্তেজনা মানুষকে পশুতুল্য করে তুলে। এর অন্যতম কারণ কামোত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপকরণ। ফলে এগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
ধর্ষণ, পরকীয়া, ব্যভিচার, পতিতাবৃত্তি, সমকামিতার ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগে খুব বেশি কাজ হবে না। এ জন্য প্রয়োজন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার পারিবারিক বলয়ে ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠতা, পোশাকের শালীনতা, অশ্লীল সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে শিক্ষণীয় বিনোদনমূলক ও শালীন সংস্কৃতি চর্চার প্রচলন নিশ্চিতকরণ। এটা করতে হলে কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা, আইনের শাসন প্রয়োগের কথা বললেই হবে না, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যার যার অবস্থানে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপসনালয়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও সমাজের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন ধর্ষণ রোধের অন্তরায় মনে করা হয়। অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে, তা হাল আমলের পরকীয় আর ধর্ষণের চিত্র দেখলেই আন্দাজ করা যায়। শুধু ধর্ষণ, পরকীয়া, ব্যভিচার নয়; ধর্ষণের পর নৃশংস হত্যার ঘটনা অহরহ ঘটছে। অপরাধীর সাজা না হলে এ জাতীয় অপরাধ বাড়তেই থাকবে। বিশ্বের যেসব দেশে এজাতীয় অপরাধ বাড়ছে তার অন্যতম কারণ সাজা না হওয়া। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধ বেশি হয়ে থাকে। ধর্ষণের শিকার বেশির ভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির।
যারা উচ্চবিত্ত, সমাজের উপর তলার মানুষ, তারা শিকার হচ্ছে কম। যারা নিম্নবর্গের, তারা সম্ভবত এখনো ধর্ষণকে স্বাভাবিকভাবে নেয়। ভয়ে চুপ থাকে। তাদের ধারণা, আইন আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে। এ মানসিকতা এবং অন্যায় করে অপরাধির পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই দেশে ধর্ষণ বেড়ে গেছে। দেশপ্রেম, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদির নেতিবাচক মানসিকতার বিস্তৃতি ঘটছে। সমাজ থেকে মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। নিঃশর্ত ভালবাসা বা ভক্তি কমে যাওয়ার কারণে আমাদের গঠনমূলক মনোভাব বা সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধার পরিবর্তে আমাদের ভোগের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশে অবৈধ যৌনাচার দিন দিন বাড়ছে। এসব অপরাধ বৃদ্ধির জন্য সরকার ও তার প্রশাসনের ব্যর্থতাই দায়ী বেশি। কারণ অন্যায়কারী জঘণ্য অন্যায় করার পরও আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না। এ জন্য অবশ্য রাজনৈতিক চাপও দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে আইন সমানভাবে কার্যকর হয় না। উচ্চশ্রেণির নারীরা নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাস করেন বলে তারা এর শিকার কম হয়। আসল সমস্যাটা হলো একশ্রেণির কুরুচিপূর্ণ পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি; এমনকি শিক্ষাগত যোগ্যতাও তাদের এই মানসিকতা বদলাতে পারে না। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্থানে শিক্ষকের হাতে ছাত্রী, ডাক্তারের হাতে রোগী ধর্ষণের শিকার হয় কি করে? এমন সুশিক্ষিত মানুষ পরকীয়ায়ও জড়াচ্ছে এমন খবর আমরা পত্রিকায় দেখতে পাই।
এ যাবৎ কত পরকীয়া, ব্যভিচার আর ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার সম্পন্ন হয়েছে। গত দশ বছরে কয়টা। খুব কম। কারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ, চূড়ান্ত রিপোর্টে ঘাপলা নয়তো স্বাক্ষ্যপ্রমাণ প্রভাবিত করে অপরাধী পার পেয়ে গেছে। উপরন্তু এর বিচার চাইতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীরা পাল্টা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।
উপরোক্ত বিষয়টি ধর্ষকদের পক্ষে ভেবে পাঠক ভুল করবেন না প্লিজ। ধর্ষণ যেমন অপরাধ আবার অন্য অপরাধে ধর্ষণের দ্বায়ে ফাঁসিয়ে দেওয়াও অপরাধ। ধর্ষন করে কোন ধর্ষক যেন পার না পায় সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ দেশে ধর্ষণ বেড়েছে এটা বলতেই হবে। এটাও স্পষ্ট যে ধর্ষকদেও প্রায় ক্ষেত্রেই বিচার হচ্ছে না। ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০০৩, ২০১৯ সালে এ আইন আবার সংশোধন করা হয়।
ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা অনেকেই জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। এ ছাড়া অর্থদণ্ডও দিতে হবে। ৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দণ্ডনীয় হবে। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। উপধারা ৯(৩)-এ বলা হয়েছে- যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুর জন্য দায়ী। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দণ্ডিত হবে ও এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
বলা বাহুল্য, ধর্ষণের আইন আছে ঠিকই তবে তার যথাযথ প্রয়োগ নেই বললেই চলে। আইন যারা প্রয়োগ করবেন তারা ঐ আইনের পথে হাঁটে না। কখনো অর্থের লোভ কখনোবা হুমকি ধমকিতে শুরুতেই গলদ দেখা দেয়। মামলার চার্জসিট গঠনের সময় ফাঁক ফোকর থেকে যায়। তাই আদালতের রায়ে ধর্ষিত কিংবা নির্যাতনের শিকার সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। এসব মামলার ক্ষেত্রে চার্জসিট গঠনের সময় কোন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশের কোন পদস্থ কর্মকর্তার নজরদারি করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত রিপোর্টের সময় ভিক্টিমের স্বাক্ষাৎকার গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে চার্জসিট দাখিলের ক্ষেত্রে যে জটিলতা তৈরি হয় তা কমে আসবে।
নারীদের জন্য ঘরের বাইরে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এটা স্পষ্ট যে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধীকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। এ জন্য সততা, আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। একই সঙ্গে এক ধরনের অপরাধের জন্য অপরাধীকে অন্য ধরনের অপরাধে সাজা যেন ভোগ না করতে হয় তা সরকার সংশ্লিষ্টদেও সজাগ থেকে দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন করতে হবে। পরকীয়া, ব্যভিচার, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি, সমকামিতা এসব যৌনতা বন্ধে এবং নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার প্রশাসন তা সুনিশ্চিত করবে- এটিই সবার প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক ও মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
www.mirabdulalim.com