ধর্ষণ! এটি কি শুধুই একটি অপরাধ? না। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি- যা শরীর, মন ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেয়। একটি নিষ্পাপ জীবন মুহূর্তের মধ্যে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়, হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিভে যায় চিরতরে। কী ভাবছেন? ধর্ষণ কি শুধু শরীরের ওপর আঘাত করা? না, এটি তার আত্মবিশ্বাস, আত্মা ও জীবনের স্বাভাবিকতা কেড়ে নেয়। ধর্ষকের পরিচয় নির্দিষ্ট নয়। তবে এ দুর্ঘটনা প্রত্যেক ভিকটিম নারীকে জীবনভর একটি ট্যাগ দিয়ে যায়। এ বিষয় নিয়েই এবারের নারী ও শিশু পাতার প্রধান ফিচার
ধর্ষণবিরোধী কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও বলতে পারেন, কেন অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে? কেন ভিকটিমদের ন্যায়বিচার পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়? বরং অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের চাপ ভিকটিমকেই অপরাধী বানিয়ে দিচ্ছে। এই বৈষম্যের অবসান কবে হবে? অনেকেই আবার আসিয়ার মত বিচার না পেয়েই মরে গিয়ে বেঁচে যায়।
বরাবরই ধর্ষণ হওয়ার পর আমরা সবাই শুধু ধর্ষক নিয়ে আলোচনা করি এবং ভিক্টিমের প্রতি সহমর্মিতার পাশাপাশি ধর্ষককে ন্যায্য শাস্তি দেয়া হলো কি না, এ পর্যন্তই! ধর্ষণের পর একজন সারভাইভার কেমন জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে, কীভাবে সে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে- এগুলো সম্পর্কে আমরা বা সারভাইভার নিজেই হয়তো অবগত থাকেন না।
চলুন জেনে নেয়া যাক ধর্ষণের পর একজন সারভাইভারের শারীরিক পরিস্থিতি কেমন হতে পারে এবং কীভাবে তার শারীরিক ও মানসিক অবকাঠামো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে-
ধর্ষণের পর একজন সারভাইভারের শারীরিক পরিস্থিতি: ধর্ষণের ফলে যৌনাঙ্গের ছেঁড়া বা ফুলে যাওয়া ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোলা, কাটা বা রক্তক্ষরণ হতে পারে। এ অবস্থায় দেরি না করে গাইনোকোলজিস্টের কাছে যাওয়াই শ্রেয়। নিয়ম করে দিনের একটা সময়ে কাঁটা বা ছেঁড়া জায়গায় কুসুম গরম পানি দিয়ে হালকা করে পরিষ্কার করা যেতে পারে। এ সময় পরিষ্কার ও নরম কটন কাপড় পরা উচিত; যাতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে। ফোলা কমাতে বরফের প্যাক বা ঠান্ডা পানির কমপ্রেস দেওয়া যেতে পারে। তবে সরাসরি বরফ ব্যবহার করা উচিত নয়। একটি কাপড়ে মুড়িয়ে নিতে হবে। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হলে সার্জারি বা সেলাই লাগতে পারে সেক্ষেত্রে দেরি করলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ প্রতিরোধে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জরুরি গর্ভনিরোধক (ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপশন) গ্রহণ করা উচিত। যৌনবাহিত রোগ ঝবীঁধষষু ঃৎধহংসরঃঃবফ রহভবপঃরড়হং ঝঞও)-এর সংক্রমণ ঘটতে পারে। ধর্ষণের পরপরই (৩-৭ দিনের মধ্যে) ঝঞও পরীক্ষা করানো দরকার। এর মধ্যে এইচআইভি ভাইরাস ইমিউন সিস্টেমকে ধ্বংস করে এবং দীর্ঘমেয়াদে এইডস (অওউঝ) হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যদি ঐওঠ সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে, তাহলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চড়ংঃ-ঊীঢ়ড়ংঁৎব চৎড়ঢ়যুষধীরং (চঊচ) ওষুধ নিতে হবে। এটি সংক্রমণের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে যৌনাঙ্গে ব্যথা ও পুঁজ বের হতে পারে যাকে বলা হয় গনোরিয়া। প্রাথমিকভাবে উপসর্গ কম থাকলেও পরবর্তীতে তলপেটে ব্যথা, অনিয়মিত রক্তক্ষরণ হতে পারে; যা ক্ল্যামিডিয়া নামে পরিচিত। আবার সিফিলিস- যার কারনে প্রথমে ছোট ক্ষত তৈরি হয়। পরে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করলে গনোরিয়া, ক্ল্যামিডিয়া ও সিফিলিস প্রতিরোধ করা যায়। তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব ও চুলকানির কারণ হতে পারে। ট্রাইকোমোনিয়াসিস হারপিসের কারণে যৌনাঙ্গে ফুসকুড়ি ও ব্যথাযুক্ত ঘা হতে পারে। ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারনে পেটে ব্যথা, ইনজেকশনের পর অল্প ব্যথা, এলার্জি, মাথা ঘোরা হতে পারে। চিকিৎসককে সব খোলাখুলি বর্ণনা করতে হবে কারন শরীরে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারনে অলটারনেটিভ ঔষধ প্রয়োজন হতে পারে।
এইচপিভির কারণে দীর্ঘমেয়াদে জরায়ুর ক্যান্সার হতে পারে। ঐচঠ ও হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন নিতে হবে। হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ ধর্ষণের পর পরই নিতে হবে। দ্বিতীয় ডোজ এক মাস পর এবং তৃতীয় ডোজ ছয় মাস পর নিতে হবে।
মূত্রনালি সংক্রমণের কারণে প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া বা ব্যথা, ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ অনুভব করা, প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হয়ে যাওয়া বা দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যাওয়া, তলপেটে ব্যথা অনুভব হতে পারে। এক্ষেত্রে দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত; যাতে শরীর থেকে ব্যাকটেরিয়া দূর হয়। প্রস্রাবের পর বা যৌনাঙ্গ ধোয়ার সময় সামনে থেকে পিছনের দিকে মুছতে হবে, যাতে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ না ঘটে।
ধর্ষণের ফলে অনেক সময় প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যা হতে পারে। এসময় পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ (চওউ) হতে পারে; যা জরায়ু, ডিম্বনালি এবং ডিম্বাশয় সংক্রমিত করে। দুর্ঘটনার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জরুরি গর্ভনিরোধক পিল গ্রহণ করা হলে অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। জরায়ুতে আঘাতের ফলে প্রজননসংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিতে পারে। ভবিষ্যতে সন্তান ধারণের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ফার্টিলিটি টেস্ট করাতে হবে।
এবার কথা বলা যাক, ধর্ষণের কারণে মানসিক প্রভাব কতোটা ভয়াবহ হতে পারে। অনেকের জীবনে মানসিক এই ক্ষত সারতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়, আবার অনেকের জন্য এটি আজীবন বয়ে বেড়ানোর মতো এক দুঃসহ স্মৃতি হয়ে থাকে। তবে আমাদের চেষ্টা থাকবে যথাযথ সহায়তা, বৈজ্ঞানিক ও প্রমাণিত বিভিন্ন পদ্ধতি সমর্থন করে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা।
ধর্ষণের পর বারবার সেই ঘটনা মনের মধ্যে ফিরে আসে যাকে বলে ফ্ল্যাশব্যাক, দুঃস্বপ্ন দেখা, আচমকা ভয় পাওয়া বা আতঙ্কিত হয়ে যাওয়া, নিজেকে নিরাপত্তাহীন মনে হওয়া যাকে বলা হয় পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (চঞঝউ)। এর কারণে নিজেকে দায়ী মনে করা, আত্মহত্যার চিন্তা আসতে পারে। তাই এই মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে সাইকোলজিস্ট বা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ষণের পর অনেক ভুক্তভোগী নিজেকে দোষারোপ করেন। এক্ষেত্রে কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (ঈইঞ) নেয়া প্রয়োজন। ঈইঞ এই ভুল ধারণাগুলো সংশোধন করতে, নেতিবাচক চিন্তা পরিবর্তন করতে, ট্রমার কারণে ভয় পাওয়ার প্রবণতা কমাতে সাহায্য করে এই থেরাপি।
ট্রমার স্মৃতি পুনরায় প্রক্রিয়াকরণে চোখের বিশেষ নড়াচড়া ও মস্তিষ্কের নিউরাল প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে থেরাপি খুবই কার্যকর।
গ্রুপ থেরাপি এ সময় সব থেকে বেশি প্রয়োজনীয় দ্রুত মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রে। গ্রুপ থেরাপি হচ্ছে সমমনা মানুষদের সাথে কথা বলা যাতে আপনার অনুভব হবে যে আপনি একা নন। এই থেরাপি আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং সমাজে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে।
ধর্ষণের পর অনেক ভুক্তভোগী কিছু নির্দিষ্ট স্থান, শব্দ বা গন্ধের কারণে অতীত ঘটনার স্মৃতি ফিরে পেতে পারেন। যার জন্য প্রয়োজন মানসিক ট্রিগার শনাক্তকরণ। এই ট্রিগারগুলোর তালিকা তৈরি করলে ধাপে ধাপে এগুলোর প্রভাব কমানো সম্ভব।
‘গ্রাউন্ডিং টেকনিক’ ব্যবহার করা জরুরি। আতঙ্কিত হলে নিজেকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনতে এই টেকনিক ব্যবহার করা হয়। নিজেকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনতে ৫-৪-৩-২-১ পদ্ধতি অনুসরণ করুন। ৫টি বস্তু দেখুন, ৪টি জিনিস স্পর্শ করুন, ৩টি শব্দ শুনুন, দুটি গন্ধ নিন, একটি জিনিসের স্বাদ নিন এবং পুনরাবৃত্তি করুন।
শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে; যা ট্রমার কারণে সৃষ্ট উদ্বেগ কমাবে। যোগব্যায়াম ও ধ্যান করলে মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো শান্ত হয় এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়ে। তা ছাড়া শারীরিক ব্যায়াম এন্ডরফিন হরমোন নিঃসরণ করে; যা মস্তিষ্ককে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। ঘুমের অভাব এসময় মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই প্রতিদিন ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। প্রোটিন, ভিটামিন ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার খেলে শরীর ও মস্তিষ্ক সুস্থ থাকে।
নিজের প্রতি সদয় হোন, সবসময় চিন্তা করবেন ধর্ষণের জন্য আপনি কখনোই দায়ী নন, এটি আপনার সাথে হয়ে যাওয়া একটি দুর্ঘটনা যা থেকে আপনার সময়ের তালে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে শারীরিক ও মানসিকভাবে। নিজেকে নতুন কিছু শেখান কারন নতুন দক্ষতা শেখা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। আপনার আরামদায়ক ব্যক্তিগত সীমানা নির্ধারণ করুন এবং সেগুলো রক্ষা করুন। বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলুন কারণ পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব বা কাউকে বিশ্বাস করলে মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যাবে। যদি সরাসরি কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করেন, তাহলে ডায়েরি লিখুন বা চিঠি লিখে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করুন। নিজেকে অপরাধী ভাববেন না, বরং নিজেকে আগের থেকেও বেশি ভালবাসতে হবে। কারণ আপনি একজন যোদ্ধা এবং বিশ্বের প্রতিটি নারীর অনুপ্রেরণা।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ