নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর নিম্নবিত্ত পরিবারের ৫-৬ বছরের একটি মেয়েশিশু ২০২১ সালে প্রতিবেশীর মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয়। মামলার তদন্ত পর্যায়ে শিশুটির বাবা বলেন, তিনি মামলা চালাতে চান না। কারণ, সামাজিকভাবে তিনি লোকলজ্জায় পড়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ধর্ষণের মামলা আপসযোগ্য না। চাইলেই এ ধরনের মামলা তুলে নেওয়া যায় না। কিন্তু মেয়েটির বাবা সিদ্ধান্তে অনড়। তিন দফা নোটিশ পাঠানোর পরও তিনি থানায় হাজির হননি। শেষ পর্যন্ত এ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও)। প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘ফাইনাল রিপোর্ট-ট্রুু’ (চূড়ান্ত প্রতিবেদন-সত্য)।
এ বছরের জুনে একজন বাড়িমালিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে পল্লবী থানায় মামলা করেন এক নারী। তদন্তের এক পর্যায়ে ওই নারী স্বীকার করেন, একটি বিষয় নিয়ে বিবাদ হওয়ায় তিনি ‘ভুয়া মামলা’ করেছিলেন। মামলাটি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় ‘ফাইনাল রিপোর্ট-ফলস’ (চূড়ান্ত প্রতিবেদন-মিথ্যা) লিখে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। মামলার আইও এ তথ্য জানিয়েছেন।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ১১ হাজারের বেশি মামলা তদন্ত করে দেখেছে, ধর্ষণের ৪৪ শতাংশ মামলা তদন্তে প্রমাণিত হয়নি। ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের অভিযোগে থানা ও আদালতে এসব মামলা করা হয়েছিল। পিবিআই এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। তবে পিবিআইয়ের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. মোস্তফা কামাল বলেছেন, প্রমাণিত না হলেও সব মামলাই ভুয়া নয়। প্রমাণিত না হওয়া মামলার অন্তত ৩০ শতাংশ সত্য। এগুলো তদন্তে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। পিবিআইয়ের ৪৭টি জেলা ইউনিট ৮ বছরে থানায় হওয়া ১ হাজার ৪৭টি মামলা তদন্ত করেছে। তদন্তে ৫৭৫টি মামলায় অভিযোগপত্র এবং ৪১২টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদন প্রকাশের সময় বাকি ৬০টি মামলার তদন্ত চলছিল। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ৪২ শতাংশ মামলা প্রমাণিত হয়নি। একই সময়ে আদালতের নির্দেশে ১০ হাজার ৫৮১টি সিআর মামলা (আদালতে করা) তদন্ত করে পিবিআই। এর মধ্যে ৫ হাজার ৪৭৪টি মামলা প্রমাণিত হয়। ৪ হাজার ২৪৮টি মামলা প্রমাণিত হয়নি। ৬৬৭টি নানাভাবে নিষ্পত্তি হয়। ১৯২ মামলা তদন্তাধীন ছিল। অর্থাৎ পিবিআইয়ের তদন্তে আদালতে করা মামলার ৪১ শতাংশ প্রমাণিত হয়নি।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন তিনভাবে হয়: ধর্ষণ নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন পিবিআইপ্রধান মোস্তফা কামাল। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানান, তদন্তের পর্যায়ে সাধারণত তিন ধরনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এক. ঘটনা সত্য। কিন্তু তা প্রমাণ করা যায়নি সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে, বাদীর অনীহায়। কখনো কখনো ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় পরিচয়হীন মৃতদেহ পাওয়া গেল। কখনো অনেক চেষ্টা করেও আসামি শনাক্ত করা যায় না। এসব মামলায় একটা সময় পর পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট-ট্রু দাখিল করে।
দুই. অপরাধ সংঘটিত না হলেও অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল-বোঝাবুঝি থেকে মামলা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে ‘ফাইনাল রিপোর্ট-মিসটেক অব ফ্যাক্ট’ (চূড়ান্ত প্রতিবেদন-তথ্যগত ভুল) দেওয়া হয়।
তিন. ইচ্ছাকৃতভাবে ভুয়া মামলা তদন্তে প্রমাণিত হলে সেটিকে ‘ফাইনাল রিপোর্ট-ফলস’ দেওয়া হয়। এ ছাড়া আইনের ভুল ধারায় মামলা হলে ‘ফাইনাল রিপোর্ট-মিসটেক অব ল’ (চূড়ান্ত প্রতিবেদন-আইনের ভুল ব্যাখ্যা) নামে আরেকটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়, তবে এটার ব্যবহার নেই বললেই চলে।
মোস্তফা কামাল বলেন, সত্য ঘটনা তদন্তে প্রমাণ করতে না পারলে তা আইওর ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য হয়। অপর দিকে অভিযোগ তদন্তে অসত্য প্রমাণিত হলে তার কৃতিত্ব আইওর। তাঁর তদন্তদক্ষতার কারণে নির্দোষ লোক ভুয়া মামলায় ফেঁসে যাওয়া থেকে রক্ষা পান। পিবিআই যেসব মামলা পর্যবেক্ষণ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে, মোটাদাগে বলা যায়, সেসব মামলার ৭০ শতাংশ ভুয়া ও ৩০ শতাংশ সত্য ছিল।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পরও ঘটনা প্রমাণিত হয়: চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া মামলা পরে প্রমাণিত হওয়ার ঘটনাও দেখা গেছে। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা। রাজশাহীতে রাহাত মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি জানতে পারেন, তাঁর সাবেক প্রেমিকা হোটেলে অবস্থান করছেন। সঙ্গে বর্তমান প্রেমিকও রয়েছেন। রাহাত কয়েকজনের সহায়তায় হোটেলের পেছন দিক দিয়ে কৌশলে ওই নারীর কক্ষে প্রবেশ করেন। এরপর ওই নারীর প্রেমিককে ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাস রোধ করে হত্যা করেন। পরে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেন ওই নারীকে। ওই নারীর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ঢুকে আত্মহত্যামূলক স্ট্যাটাসও দেন।
নিখুঁত পরিকল্পনায় করা ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ না পেয়ে এবং মেডিকেল প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বলা হলে ‘চূড়ান্ত প্রতিবেদন-তথ্যগত ভুল’ দাখিল করে পুলিশ। পরে আদালতের নির্দেশে মামলাটি পিবিআই তদন্ত করে রহস্য উদ্ঘাটন করে। এরপর আসামিরা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক দীপ্তি শিকদার বলেন, অনেক সময় স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে, সাক্ষী সুরক্ষার অভাবে, মামলা চলাকালীন দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধর্ষণের মামলার বাদী আপস করতে বাধ্য হন। এ দেশে ধর্ষণের মামলায় মেডিকেল প্রতিবেদনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। মেডিকেল পরীক্ষা দেরি হলে অনেক সময় ধর্ষণ প্রমাণিত হয় না। আবার আর্থিক লেনদেনের কারণেও তদন্ত এগোয় না। ফলে তদন্তে প্রমাণিত না হলেই ঘটনা মিথ্যা বলার সুযোগ নেই। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে তদন্তে সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াতে তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দেওয়ার ওপর জোর দেন।
সানা/কেএমএএ/আপ্র/২৭/০৯/২০২৫