প্রত্যাশা ডেস্ক : মাগুরায় ধর্ষণের শিকার ৮ বছরের শিশুটি মারা গেছে। এ নিয়ে শোকের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মাগুরার বিশিষ্টজনেরা। সাধারণ মানুষ দাবি তুলেছেন আসামিদের প্রকাশ্যে সর্ব্বোচ্চ শাস্তির। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয় বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর- আইএসপিআর জানিয়েছে। শিশুটির মৃত্যুর সংবাদে জেলায় শোকাতুর-শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। এর আগে গত ৫ মার্চ রাতে মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী এলাকায় বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয় আট বছর বয়সী ওই শিশু। ধর্ষক তাকে হত্যারও চেষ্টা চালায়। পরে গত ৮ মার্চ সংকটাপন্ন শিশুটিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
মাগুরা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহেদ হাসান টগর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। মাগুরায় এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। কোনোভাবেই এ ধর্ষণ-মৃত্যুর বিষয়টি মেনে নিতে পারছি না।” তিনি বলেন, “আমরা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ধর্ষকদের পক্ষে কোনো আইনি সহায়তা দেওয়া হবে না। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য আইনজীবী সমিতি সব ধরনের সহায়তা করবে।” জেলা মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লাবণী জামান বলেন, “সারাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে চলেছে। যে কারণে মাগুরায় এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে।
“আমরা মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে শিশুটির ধর্ষকের অবিলম্বে ফাঁসির দাবি জানাচ্ছি। বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত জেলা মহিলা পরিষদ সবসময় শিশুটির পরিবারের পাশে থাকবে।” বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক মো. হুসাইন বলেন, ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় তারা চরমভাবে ক্ষুব্ধ। তিনি অবিলম্বে শিশু ধর্ষণ-মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের ফাঁসির দাবি করে তিনি বলেন, “এ ঘটনায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধর্ষকদের ফাঁসি কার্যকর করা না হলে ছাত্র-যুব সমাজ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মাগুরায় দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে।”
শিশুটির ধর্ষণ-মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে জেলা গণকমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী শম্পা বসু বলেন, “শিশুটির মৃত্যুতে আমরা শোকাহত, একইসঙ্গে আমরা অবিলম্বে ধর্ষকের বিচার দাবিতে আন্দোলনে মাঠে থাকব।” এ বিষয়ে মাগুরা শহরের রিকশা চালক আব্দুর রহমান ‘ধর্ষকের প্রকাশ্যে ফাঁসি’ দাবি করেন। মাগুরা শহরতলীর নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ৫ মার্চ রাতে শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ করে তার পরিবার। শিশুটির মা গত ৮ মার্চ মাগুরা সদর থানায় চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন- শিশুটির ভগ্নিপতি সজীব হোসেন (১৮) ও বোনের শ্বশুর হিটু মিয়া (৪২), সজীবের অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাই (১৭) এবং তাদের মা জাবেদা বেগম (৪০)। তাদের চারজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার নথিতে বলা হয়, সজীবের সহায়তায় তার বাবা হিটু মিয়া শিশুটিকে ‘ধর্ষণ’ করেন। বিষয়টি জাবেদা ও তার ছোট ছেলেও জানতেন। ঘটনা ধামাচাপা দিতে শিশুটিকে হত্যার চেষ্টা চালান তারা।
নির্যাতনের শিকার শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে নেওয়া হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ৬ মার্চই তাকে ঢাকা মেডিকেলের পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) ভর্তি করা হয়। পরে শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা শনিবার জানিয়েছিলেন, শিশুটির অবস্থা ‘সংকটাপন্ন’। এরপর তার চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হলেও সন্ধ্যায় তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচে নেওয়া হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক বার্তায় বলা হয়, “আজ সে আরও দু’বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হয়েছে। দ্বিতীয়বার প্রায় ৩০ মিনিট সিপিআর দেওয়ার পর হৃৎস্পন্দন ফিরেছে, তবে তার মস্তিষ্ক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। “কোমা স্কেলে (জিসিএস) মাত্রা ৩, যা গভীর অচেতন অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। শিশুটির রক্তচাপ ও অক্সিজেনের মাত্রাও বিপজ্জনকভাবে কম।’’ এরপর দুপুরে শিশুটির মৃত্যুর খবর দেয় আইএসপিআর। সেখানে সেনাবাহিনীর তরফে শোক প্রকাশ করা হয়।
সেনাবাহিনীর শোক প্রকাশ
কয়েক দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেল মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশু আছিয়া। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসারত অবস্থায় বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এদিন দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। পাশাপাশি এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছে সেনাবাহিনী। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানানো যাচ্ছে যে, মাগুরায় নির্যাতিত শিশুটি আজ দুপুর ১টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে । সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)-এর সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োগ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আরও বলা হয়েছে, ‘শিশুটি সকালে তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। দুইবার স্থিতিশীল করা গেলেও তৃতীয়বার আর হৃদস্পন্দন ফিরে আসেনি। উল্লেখ্য, গত ৮ মার্চ শিশুটিকে সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি করা হয়।’
‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিশুটির শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে এবং যেকোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিশুটির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছে।’ গত ৫ মার্চ মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় শিশু আছিয়া। ৬ মার্চ সকাল সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে দুপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে অবস্থা আরও খারাপ হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। এরপর গত ৮ মার্চ সিএমএইচে ভর্তি করা হয় শিশুটিকে। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না।
মাগুরা সংবাদদাতা জানান, মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার শিশুর মৃত্যুতে পরিবারে চলছে শোকের মাতম। সেই শোক ছড়িয়ে পড়েছে জেলাব্যাপী। মৃত্যুর সংবাদ শোনার সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিবারের সদস্যরা। তারা বলতে থাকেন যেভাবে শিশুটিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তেমনি দ্রুত ধর্ষক আর খুনিদের ফাঁসি দিতে হবে। শিশুটির মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই সাধারণ মানুষ শোকাহত হয়ে পড়েন। আশপাশের এলাকাসহ দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে যান শিশুটির বাড়িটিতে। তারা শোকাহত পরিবারের পাশে থেকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে নিজেরাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। দুপুর থেকেই সোস্যাল মিডিয়ায় মুত্যুর সংবাদ প্রকাশ করে হাজারো মানুষ শিশুটিকে নিজেদের বোন, মা, কন্যা বা স্বজন হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। সবারই যেন এক কথা ‘ওপারে ভালো থাকিস মা, এই অসভ্য সমাজ তোর না’। সোস্যাল মিডিয়ায় শিশুটির ধর্ষণ ও হত্যার সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তিও দাবি করা হয়। অনেকে ধর্ষকদের প্রকাশ্য বিচার দাবি করেন।
কেউ কেউ বলেন, দীর্ঘ দেড় যুগ দেশে যেভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু ছিল ধর্ষকরা সে কারণে এই ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিতে পারছে বার বার। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) দুপুরে শিশুটির বাড়িতে যেয়ে তার চাচার সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি জানান, মরদেহ হেলিকপ্টার যোগে মাগুরা আসার পর শহরের নোমানী ময়দানে নামাজে জানাজা শেষে তাকে শ্রীপুর সোনাইকুন্ডি গ্রামে কবরস্থনে দাফন করা হবে।