নিজস্ব প্রতিবেদক : ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধির প্রতিবাদে ডাকা অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনেও সারাদেশে দূরপাল্লার বাস ও পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে দুর্ভোগ বেড়েছে সাধারণ যাত্রীদের। যানবাহন না পেয়ে নিরুপায় হয়ে পড়েছেন তারা।
গত শুক্রবারের মতো শনিবারও সারাদেশে বাস বন্ধ আছে। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি ও অটোরিকশা ও রিকশা চলাচল করছে রাস্তায়। রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে গাড়ির অপেক্ষায় থাকা অসংখ্য মানুষের ভিড় করতে দেখা গেছে। বিআরটিসি বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে তাদের।
আগের দিনের মত গতকাল শনিবারও ঢাকায় বিআরটিসির বিভিন্ন ডিপো থেকে বাস ছেড়েছে। একটি বাস এলেই তাতে হুড়মুড়িয়ে উঠছেন যাত্রীরা। অনেকে বাসে উঠতে না পেরে বিকল্প উপায়ে তাদের কর্মস্থলে রওনা হয়েছেন। এজন্য রিকশা ও অটোরিকশায় কয়েকগুণ ভাড়া দিয়ে যেতে হচ্ছে।
শনিবার সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটারসাইকেল আর রিকশা ছাড়া তেমন কোনো যানবাহন চোখে পড়েনি। বাস না থাকার সুযোগে অটোরিকশা এবং রিকশা চালকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেছেন। পথে বিআরটিসির বাস চললেও সেগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। অনেক যাত্রীকে ঝুঁকি নিয়ে বাসের দরজায় ঝুলতে দেখা গেছে।
মানুষকে জিম্মি করে এই আন্দোলনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। বাংলামোটরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা আনিস নামে একজন বলেন, ‘পরিবহন মালিকদের দাবি অযৌক্তিক। কারণ তারাতো বাসের ভাড়া দেবেন না। মানুষের পকেট থেকেই এই টাকা যাবে। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করলেই এই সমস্যার সমাধান হতো। মানুষকে জিম্মি করে আন্দোলন করা তাদের জন্য ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।’
শ্যামলী থেকে কারওয়ানবাজারে যাবেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা যুবক আরমান। তিনি বলেন, বাস না থাকায় তিনি অটোরিকশা ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ভাড়ায় বনেনি। শেষ পর্যন্ত আরেকজনের সঙ্গে শেয়ার করে রিকশায় অফিসের উদ্দেশে রওনা হয়েছি।
উত্তরা এলাকায় রিকশা ভ্যান বা অটোরিকশায় করে বহু মানুষকে ঢাকার দিকে আসার চেষ্টা করতে দেখা যায়। আবদুল্লাহপুরে কিছু মোটরসাইকেল চালকও অর্থের বিনিময়ে যাত্রীদের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে ভোগান্তিতে পড়া এসব মানুষ ধর্মঘটের নিরসন চান।
সরকার গত বুধবার রাত ১২টা থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছে। এতে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরি মালিকরা শুক্রবার ভোর থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধের ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণা কেন্দ্রীয়ভাবে নয়, স্থানীয়ভাবে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। বৃহস্পতিবার রাতে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয় সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে। সংগঠনটি জানায়, পণ্যবাহী যানের পাশাপাশি শুক্রবার সকাল ছয়টা থেকে বাস চালাবেন না বাস মালিকরা। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল সকাল ছয়টা থেকে বাস বন্ধ রয়েছে। আর এতে ভোগান্তিতে পড়েন মানুষ।
যৌক্তিক সমাধানের আগ পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে বৈঠকের পরও ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ডাকা পণ্য পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করেননি ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক সমিতির নেতারা। তারা বলছেন, যৌক্তিক সমাধান না মেলা পর্যন্ত ধর্মঘট প্রত্যাহার হবে না। শনিবার দুপুরে ধর্মঘট ইস্যুতে আলোচনা করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসায় যান মালিক-শ্রমিক সমিতির নেতারা।
বৈঠক শেষে বের হয়ে সমিতির অতিরিক্ত মহাসচিব আব্দুল মোতালেব গণমাধ্যমকে বলেন, যৌক্তিক সমাধান পেলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে। মোতালেব বলেন, ‘আমরা বৈঠক শেষ করেছি। বৈঠকে ধর্মঘটের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় আমাদের দাবির কথা শুনেছেন এবং তিনি বলেছেন যৌক্তিক দাবিগুলো আলোচনা করে মেনে নেয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে তাদের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন। দাবি মানা হলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে। দাবি মানা না হলে পরিবহন ধর্মঘট চলবে।’
ট্রাক শ্রমিক-মালিক ফেডারেশনের অতিরিক্ত অতিরিক্ত মহাসচিব আরও বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে আছেন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে যৌক্তির দাবির কথা জানাবেন। এরপর আমাদের সঙ্গে মন্ত্রী মহোদয় আজ সন্ধ্যায় অথবা রবিবার আবারও বসে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
তেলের দাম বাড়ানোয় পণ্য পরিবহনে সংশ্লিষ্ট মালিকরা লোকসানে পড়বেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের ভাড়ার ওপরে প্রভাব পড়েছে। আগে ভাড়া যেখানে ছিল ১০ হাজার, সেখানে এখন ভাড়া হবে তেলসহ ১২ হাজার। তাহলে কীভাবে আমরা গাড়ি চালাবো? আমাদের লাভের যে অংশটা ছিল তা এখন তেলেই চলে যাবে। লাভ না করতে পারলে রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে করবো কী? একটি রুটে যদি ২০০ লিটার তেল খরচ হয় তাহলে খরচের পরিমাণ কতটা বেড়ে গেলো? ‘
‘আমরা নেতৃত্ব দিই, আমরা যদি গাড়ি চালানোর কথা বলি তবুও গাড়ির মালিকেরা গাড়ি চালাবে না। কারণ এটি একটি ব্যবসা। ব্যবসা নাহলে গাড়ি কেন চালাবে তারা?
ঢাকায় সিএনজিচালিত বাস বন্ধ হল কেন, প্রশ্ন যাত্রীদের : বাস ধর্মঘটের কারণে ঢাকার সড়কে জনভোগান্তি গড়িয়েছে দ্বিতীয় দিনে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাস বন্ধ হলেও সিএনজিচালিত বাস কেন ধর্মঘটে গেল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেক যাত্রী। বেসরকারি অফিসের কর্মীদের শনিবার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে অফিস ধরতে হয়েছে। পরীক্ষার্থীদেরও পড়তে হয়েছে দুর্ভোগে। ডিজেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে শুক্রবার থেকে এই ধর্মঘট ডেকেছে বাস-ট্রাক মালিক সমিতির নেতারা। পরিবহনহ ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে রোববার বিআরটিএ সভা ডেকেছে। সেই পর্যন্ত বাস-ট্রাক না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মালিকরা।
সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছে। কিন্তু এই দফায় অন্য কোনো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়নি। ঢাকার বেসরকারি কোম্পানিগুলোর অনেক বাস সিএনজিতে চললেও সেগুলোও সড়কে দেখা যাচ্ছে না। মহাখালীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আব্দুর রহমান। তিনি বললেন, “এখান থেকে আলিফ পরিবহন ছাড়ে। প্রতিদিনি তাতেই যাতায়াত করি। কিন্তু সিএনজিচালিত এই বাসও বন্ধ।
“সিএনজির দাম তো বাড়ায়নি। আমাদের জিম্মি করে ভাড়া বেশি নিতেই এই ধর্মঘট। সরকারও কিছু করছে না।”
অফিসগামী কিংবা জরুরি প্রয়োজনে যারা বেরিয়েছেন, তাদের মোটরসাইকেল, অটোরিকশা কিংবা রিকশায় বাড়তি ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে, গুণতে হচ্ছে বেশি ভাড়া। অনেকে হেঁটেও পথ ধরেন। রহমান সকাল সাড়ে ৮টায় মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ এলাকা থেকে চেষ্টা করছিলেন অটোরিকশা অথবা মোটর সাইকেলে ওঠার জন্য। কিন্তু ভাড়া বেশি হওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করেন। তিনি বলেন, “মোটর সাইকেল কম। অ্যাপে কাউকে পাচ্ছি না। ভাড়ায় যারা যেতে চাইছে তারা অনেক টাকা চাইছেন। এই যে আমার বেশি টাকা খরচ হচ্ছে, এটা কি সরকার দেবে, না কি আমার অফিস?”
সরকারি সংস্থা বিআরটিসির বাস রাস্তায় চলাচল করলেও তাতে প্রচুর ভিড়। উঠতে পারা যেন যুদ্ধ জয়। মোহম্মদপুর শিয়া জাপান-বাংলাদেশ গার্ডেন সিটির সামনে অপেক্ষারত মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। আলিফ পরিবহনের নিয়মিত যাত্রী মাহমুদ বলেন, “আমি এখান থেকে প্রতিদিন বাসে করে গুলশান-১ যাই। বাসা থেকে অফিস যেতে প্রতিদিন রিকশাভাড়াসহ ৫০-৬০ টাকার মতো খরচ পড়ে।
“আজ বাস নেই। সিএনজি চারশো টাকা চাইছে। মোটারসাইকেল আড়াইশোর নিচে যেতে চাইছে না। একজনকে অ্যাপে পেয়েছি। কিন্তু আসার পর বলছে অ্যাপ থেকে বেশি ভাড়া দিতে হবে। বাধ্য হয়ে উবার কার ডেকেছি। তাও ৩৫০ টাকা ভাড়া দেখাচ্ছে। উপায় নেই। অফিসে দেরি হলে আবার বেতন কাটবে। এসবতো কেউ দেখে না।”
তিনিও প্রশ্ন করেন, “ডিজেলের দাম বাড়াল, গ্যাসচালিত গাড়ি বন্ধ হল কেন? জবাব নেই। কী অপরাধ আমাদের যে বাড়তি খরচ করে অফিস করতে হবে।” শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন অফিসগামীরা না থাকলেও বেশ কয়েকটি নিয়োগ পরীক্ষা থাকায় পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।
রিকশা-অটোরিকশায় কয়েক গুণ বেশি ভাড়া : গণপরিবহন বন্ধ থাকার সুযোগ নিচ্ছে অটোরিকশা ও রিকশাগুলো। নিরুপায় হয়ে বেশি অর্থ খরচ করেই যাতায়াত করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ডিজেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শুক্রবার থেকে ধর্মঘট করছে বাস-ট্রাক মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। এতে শুক্রবারের পর শনিবারও জনভোগান্তি দেখা গেল রাজধানীর সড়কে।
শনিবার সকালে মেরুল বাড্ডা থেকে হাজিপাড়ায় বেটার লাইফ হাসপাতালে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে এসেছিলেন শরিফুল গাজী। রিকশা ভাড়া দিয়েছেন দেড়শ টাকা। শরিফুল বলেন, “সিএনজি পাচ্ছিলাম না। যাও দু-একটা পাইছি, ভাড়া চাইল আড়াইশ টাকা। পরে রিকশায় আসলাম।”
তিনি বলেন, “রাস্তায় প্রচুর রিকসা। কিন্তু ভাড়া নিচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি। মেরুল বাড্ডা থেকে এইখানে (বেটার লাইফ হাসপাতাল) ভাড়া বড় জোর ৮০ টাকা।”
শনিবার সরকারি অফিস-আদালত বন্ধ থাকার কারণে স্বাভাবিক দিনের চেয়ে মানুষের চলাচল অনেকটাই কম ছিল। আর গণপরিবহন বন্ধ থাকার কারণে রাস্তায় যানজট নেই বললেই চলে। তারপরও স্বাভাবিক দিনের চাইতে বেশি ভাড়া হাঁকছেন সিএনজি অটোরিকশার চালকরা। মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে মহাখালী যেতে অটোরিকশা চালক নূর ইসলাম ভাড়া চাইলেন ৩৮০ টাক। সাড়ে তিনশর নিচে যাবেন না। রাস্তায় যানজট নেই, তারপরও ভাড়া বেশি চাইছেন কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সবদিন কি আর বেশি চাই? আইজকা একটু বেশি লাগবোই।”
কেন ‘বেশি লাগবোই’ তার সদুত্তর দিতে না পারলেও উদাহরণ দিলেন, “এই মাত্র চাইরশ টাকা দিয়া বনানী গেছে।”
রাস্তায় গণরিবহন না থাকায় প্রাইভেটকার, বাইক, অটোরিকশার চেয়ে দাপট বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশার। অনেকে দূরের গন্তব্যেও চলাচল করছিল রিকশায়। তবে বাড়তি ভাড়া দিয়ে।
১৮০ টাকা ভাড়া দিয়ে রামপুরা থেকে সদরঘাট যেতে দেখা গেছে লাবিব আর রাকিব নমের দুই ভাইকে। চারশ টাকার নিচে অটোরিকশা না পেয়ে রিকশায় সওয়ার হন তারা। রিকসার চালক সুরুজ মিয়ার ভাষ্য, “মেইন রোড দিয়া এই রিকশা রিকস (রিস্ক) নিয়া চালাইতে হয়। পুলিশে ধরলে জরিমানা করে। বাড়তি টাকা দেওয়া লাগতে পারে। এই কারণে ভাড়া কয়েক টাকা বেশি। খুব তো বেশি না!”
রাইড শেয়ারিং অ্যাপ উবার বা পাঠাওয়ের কয়েকজন চালকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও এসব পরিবহনের ভাড়ার কোনো হেরফের হয়নি। উবারের বাইকচালক আসিফ কায়সার বলেন, “উবারের নীতিমালা অনুযায়ী ভাড়া একই আছে। তবে যানজট না থাকায় দুদিন ধরে উল্টো ওয়েটিং চার্জ পাচ্ছি না।”
তবে অ্যাপে না চালিয়ে যারা চুক্তিতে বাইকে যাত্রী পরিবহন করছেন, তারা বেশি ভাড়া চাইছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবির মুখে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে রোববার বিআরটিএ বৈঠক ডেকেছে। তার আগে সঙ্কট অবসানের কোনো ইঙ্গিত মিলছে না।
স্থবির চট্টগ্রাম বন্দর : জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য পরিবহন বন্ধ রয়েছে। ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে শনিবার বন্দরে কোনো কন্টেইনার আনা নেওয়া করা যায়নি বলে বন্দর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে; শঙ্কা তৈরি হয়েছে কন্টেইনার জট তৈরির। ধর্মঘট দীর্ঘায়িত হলে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হয়ে নিজেরা ক্ষতির সম্মুখীন তো হবেনই, সঙ্গে ভোক্তারাও এর শিকার হবেন বলে ব্যবসায়ীদের শংকা।
বুধবার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির পর শুক্রবার থেকে যানবাহন না চালানোর ঘোষণা দেন মালিক-শ্রমিকরা। সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও শুক্রবার গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহন বন্ধ ছিল। শনিবার সকাল থেকে এর প্রভাব পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরেও। পণ্য পরিবহনের জন্য সকাল ৬টার পর কোনো ট্রাক-লরি বন্দরে প্রবেশ করেনি ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, “ধর্মঘটের কারণে সকাল থেকে কোনো ডেলিভারি হচ্ছে না; বেসরকারি ডিপো থেকে কোনো কন্টেইনারও বন্দরে আসছে না। ধর্মঘট চলতে থাকলে সামনে কন্টেইনার জট দেখা দিতে পারে।”
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বন্দরে কন্টেইনার ধারণক্ষমতা গড়ে ৪৯ হাজার টিইইউএস (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনারকে একক ধরে)। শনিবার সকালে আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে কন্টেইনার ছিল ৩৬ হাজারের মতো। বন্দর কর্মকর্তা ওমর ফারুক জানান, শনিবার বন্দর থেকে ডেলিভারি হবার কথা ১৫০০ টিইইউএস কন্টেইনার। কিন্তু গাড়ি না আসায় দুপুর পর্যন্ত কোনো ডেলিভারি হয়নি। শুক্র-শনিবারে কন্টেইনার ডেলিভারি কম হয়ে থাকে। সাধারণ সময়ে কন্টেইনার ডেলিভারি হয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজারের মতো। সাধারণত চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে আসা জাহাজ থেকে আমদানি পণ্যের কন্টেইনার নামানো এবং অফডকগুলো থেকে আসা রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার জাহাজে ওঠানো হয়ে থাকে। সাধারণ সময়ে বন্দরে প্রতিদিন গড়ে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং (ওঠা-নামা) হয়ে থাকে সাত থেকে আট হাজার টিইইউএস। ধর্মঘটের কারণে ডেলিভারি না হওয়ায় হ্যান্ডলিংও কমে এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিগুলোতে বর্তমানে জাহাজ রয়েছে ১৬টি। এর মধ্যে নয়টি কন্টেইনারবাহী, চারটি সারবাহী, দুটি সিমেন্ট ক্লিংকার এবং দুটি খাদ্যপণ্য বোঝাই। এছাড়া বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে অবস্থানরত ৪৪টি মাদার ভ্যাসেলে কাজ চলছে। বন্দরে আসা জাহাজ থেকে কন্টেইনার নামানোর পর বাইরে অফডকে (বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো) নিয়ে পণ্য খালাস করা হয়ে থাকে। এছাড়া অফডক থেকে রপ্তানিপণ্যবাহী কন্টেইনার বন্দরে আসে এবং জাহাজে বোঝাই হয়ে থাকে। বন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি ডিপোগুলো থেকে রপ্তানিপণ্যের কন্টেইনার আসছে না। বেশকয়েকটি জাহাজ খালি বসে আছে। এতে করে জাহাজের মাশুলও বাড়ছে।
বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, “ধর্মঘট আরও কয়েকদিন চললে বন্দরের ক্যাপাসিটি কমবে এবং অপারেশনাল কার্যক্রমে ধীর গতি আসবে, জাহাজের গড় অবস্থানকালও বেড়ে যাবে।”
বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোর মালিকদের প্রতিষ্ঠান বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন শিকদার বলেন, “চট্টগ্রামের ১৯টি ডিপো থেকে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজারের মতো কন্টেইনার বন্দরে যাওয়া-আসা করতো, যা ধর্মঘটের কারণে কমে গেছে।”
শনিবার অফডকগুলো থেকে একটি কন্টেইনারবাহী গাড়ি বন্দরে যায়নি বা সেখান থেকে আসেনি জানিয়ে তিনি বলেন, “ডিপোগুলোতে কন্টেইনার ধারণক্ষমতা ৭৮ হাজার ৭০০ টিইইউএস। আজকে রয়েছে ৫২ হাজারের মতো। এমন পরিস্থিতে তিন-চারদিন হয়তো চালানো যাবে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বন্দরের ওপর চাপ বাড়বে, কন্টেইনার জট হবে।”
দেশের তৈরি পোশাকখাতের অধিকাংশ রপ্তানিপণ্য চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে বিভিন্ন দেশে যায়। পরিবহন সংকটের কারণে বন্দরে পণ্য পাঠানো প্রায় বন্ধ থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষতির কথা তুলে ধরে বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের রপ্তানিমুখী কন্টেইনার বন্দরে যেতে পারছে না। যেসব জাহাজ পণ্য নেয়ার জন্য বন্দরে অপেক্ষা করছে সেসব খালি ফিরে যাবে। জাহাজ অপেক্ষমান থাকলে মাশুল বাড়বে। এর চাপ পড়বে বব্যসায়ীদের ওপর। তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ এর কারণে তৈরি পোশাক খাতে ব্যবসার যে ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে উঠছিলাম। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের সুনামও বেড়েছে। এমন সময়ে পরিবহন ধর্মঘট আমাদের জন্য আত্মঘাতী। ব্যবসার স্বার্থে, দেশের স্বার্থে ধর্মঘটীদের নিয়ে বসে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা উচিত।”
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “পণ্য পরিবহন বন্ধ মানে বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ। বন্দরে খালি জাহাজ বসে থাকলে সেটার ডেমারেজ ব্যবসায়ীদের ওপর পড়ছে। এটার প্রভাব স্বাভাবিকভাবে ভোক্তার ওপর গিয়েই পড়বে। এটা কোনভাবেই ঠিক না।”
তিনি বলেন, “জ্বালানি তেলের দাম হুট করে বাড়ানো যেমন ঠিক না। তেমনি কোন আল্টিমেটাম না দিয়ে পরিবহন মালিকদের ধর্মঘট ডাকা উচিত নয়। দেশের স্বার্থে এ ধর্মঘটের দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।”
আজ থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলবে বাস : চট্টগ্রাম মহানগরীতে রবিবার থেকে বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন বাস মালিক সমিতি। আজ রোববার সকাল ৬টা থেকে বাস চলবে বলে জানিয়েছে সমিতি। শনিবার দুপুরে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন বাস মালিক সমিতির সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল। তিনি বলেন, ‘আমরা মালিকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমাদের সমিতির অধীন যে বাসগুলো আছে তা আগামীকাল সকাল থেকে চলাচল করবে।’