ঢাকা ০১:৪৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫
স্বাস্থ্য প্রতিদিন======

কমছে না ডেঙ্গু, বাড়ছে মৃত্যু, সমাধান কোথায়?

  • আপডেট সময় : ০৭:০০:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫
  • ১২ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগ্রহীত

ড. কবিরুল বাশার

বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়, এটি এক জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে। এক সময় বর্ষাকালেই সীমাবদ্ধ থাকা ডেঙ্গুর সংক্রমণ এখন অক্টোবর-নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেও বিস্তার করবে বলে মনে হচ্ছে। এবছরের পরিস্থিতি আরও জটিল ও উদ্বেগজনক।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ৩১ অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত দেশে মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৯,৮৬২ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন ২৭৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৬৮ জন রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন, ফলে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা হয়েছে ৬৬,৮০২ জন। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ এখনো কমছে না। পুরুষ রোগীর সংখ্যা ৬৫.২ শতাংশ, নারী রোগী ৩৪.৮ শতাংশ। আক্রান্তদের মধ্যে ১৬–২০ বছর বয়সী তরুণরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, এরপর ২১–২৫ বছর বয়সীদের অবস্থান। মৃত্যুর দিক থেকে দেখা যায়, পুরুষের মৃত্যু ৫৩.২ শতাংশ এবং নারীর মৃত্যু ৪৬.৮ শতাংশ।

১ নভেম্বর ২০২৫ সকাল ৮টা থেকে ২ অক্টোবর ২০২৫ সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৭১ হাজার ৬৭৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২৮৩ জনের [ঢাকা পোস্ট, ২ নভেম্বর ২০২৫]। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ০-৫ বছর ও ১১-১৫ বছর বয়সী শিশু ও কিশোরদের মধ্যে। সর্বাধিক মৃত্যু ঘটেছে ঢাকা বিভাগে, যা রাজধানীকেন্দ্রিক উচ্চ ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে বলা যায়, নভেম্বর মাসেও ডেঙ্গু কমছে না বরং পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে। এর মূল কারণগুলো একাধিক এবং সেগুলো পরস্পর-সম্পর্কিত।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া এখন আর পূর্বের নিয়মে চলে না। আগে যেখানে সেপ্টেম্বরের পর বৃষ্টির ধারা প্রায় বন্ধ হয়ে যেত, এখন দেখা যায় অক্টোবরের শেষ দিকেও হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে, যা এডিস মশার প্রজননের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ে; যেমন ফুলের টব, ড্রাম, প্লাস্টিকের পাত্র, পুরনো টায়ার, ছাদের নিচের গর্তে পানি ইত্যাদি। অক্টোবর-নভেম্বরে বৃষ্টিপাতের ফলে এসব স্থানে পুনরায় পানি জমে এবং মশার ডিম থেকে লার্ভা ও পিউপা হয়ে নতুন প্রজন্মের মশা জন্ম নিচ্ছে। তাই বৃষ্টি যত দেরিতে হয়, ডেঙ্গুর প্রজনন চক্র তত দীর্ঘায়িত হয়। এ ছাড়া তাপমাত্রাও এখন ডেঙ্গুর পক্ষে। ২০–৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এডিস মশার বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত, যা নভেম্বর মাসেও বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বিরাজ করে। ফলে বৃষ্টির সঙ্গে তাপমাত্রা মিলিয়ে এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়েছে ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রশাসনিক অদক্ষতা, অভিজ্ঞ ও দক্ষ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ না করা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধীরগতি। স্থানীয় সরকার বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওয়ার্ড পর্যায়ে মশা নিধন কর্মসূচি কেবল ‘দেখানোর জন্য’ চলে। ফগার মেশিনের কার্যকারিতা সীমিত এবং অনেক সময় এটি ভুল জায়গায় বা ভুল সময়ে ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রশাসনিক অদক্ষতা, অভিজ্ঞ ও দক্ষ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ না করা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধীরগতি। স্থানীয় সরকার বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে লার্ভা ধ্বংসের কার্যক্রমে কার্যকরী কীটনাশক, কীটনাশক প্রয়োগের সময়, ডোজ, প্রশিক্ষণ ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ফলস্বরূপ শহরের গলি, নির্মাণাধীন ভবন, বেজমেন্ট, ড্রেন, ফুলের টব ও ছাদের পানি জমা স্থানে এডিস মশা সহজেই প্রজনন করছে।

ডেঙ্গু মোকাবিলায় নাগরিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এডিস মশার ৮০ শতাংশ প্রজনন স্থানই মানুষের আবাসিক বা কর্মস্থল পরিবেশে অবস্থিত। তবুও অনেকেই এখনো বিশ্বাস করেন এটি ‘সরকারের দায়িত্ব’। বাসা বা অফিসের ছাদে, বারান্দায়, ফুলের টবে বা ড্রামে জমে থাকা পানি পরীক্ষা করার অভ্যাস এখনো গড়ে ওঠেনি। অনেকে মনে করেন, এক-দুই দিনের পানি জমে থাকলে ক্ষতি নেই, কিন্তু বাস্তবে এডিস মশা মাত্র ৫–৭ দিনে ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হয়ে যায়। জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারণা প্রায়শই স্বল্পমেয়াদি ও মৌসুমি। অথচ এটি হওয়া উচিত সারাবছরের কার্যক্রম। নাগরিকদের নিজ নিজ উদ্যোগে পানি জমা স্থান পরিষ্কার রাখা, নিয়মিত লার্ভা পরীক্ষা করা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে তথ্য জানানো, এই তিনটি দায়িত্ব এখন অপরিহার্য।

অনেকে মনে করেন শীত এলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ঢাকা শহরের বহুতল ভবনের বেজমেন্ট, পার্কিং স্থান, গাড়ি ধোয়ার জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের পানি জমা স্থান এবং অনেক এলাকায় পানির স্বল্পতার কারণে ড্রাম বা বালতিতে জমিয়ে রাখা পানি, এসব স্থানে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সারা বছর প্রজনন করতে পারে। এই পানির উৎসগুলোর সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক নেই, তাই শীতকালেও এডিস মশার প্রজনন চলতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের অনেক ভবনের নিচতলা ও বেজমেন্টে দিনের বেলায় প্রচুর এডিস মশা থাকে, যা শীতেও সক্রিয় থাকে। ফলে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গুর সংক্রমণ অব্যাহত থাকতে পারে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ হলো এডিস মশার লার্ভা কোথায় কোথায় জন্ম নিচ্ছে তা সঠিকভাবে জানা। এজন্য প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায় সারা বছরব্যাপী লার্ভা সার্ভিলেন্স কার্যক্রম চালু করা জরুরি। প্রতি ওয়ার্ডে নিয়মিত লার্ভা সার্ভে করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ও সময় চিহ্নিত করতে হবে। ডেটা ব্যবহার করে ‘হটস্পট ম্যাপিং’ করা গেলে কোথায় মশার ঘনত্ব বেশি এবং কোন এলাকায় দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন তা জানা যাবে। ফলে পরিকল্পনা হবে আরও বাস্তবসম্মত ও তথ্যনির্ভর।

বৃষ্টি এডিস মশার প্রজননের প্রধান সহায়ক। কারণ পরিষ্কার পানিতে এরা ডিম পাড়ে এবং মাত্র ৫–৭ দিনের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপ নেয়। তাই প্রতিটি বৃষ্টির পর সর্বোচ্চ তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষের লার্ভা ধ্বংস অভিযান পরিচালনা করা আবশ্যক। ফগার মেশিন নয় বরং উৎসস্থলে লার্ভিসাইড প্রয়োগ, জমে থাকা পানি অপসারণ এবং শুকনো পরিবেশ নিশ্চিত করাই হবে কার্যকর সমাধান। একইসঙ্গে প্রতিটি ভবন মালিক বা ব্যবস্থাপককে নিজ নিজ ভবনের আশেপাশের পানি জমা স্থানের দায়িত্ব নিতে হবে।

ডেঙ্গু দমন কেবল সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়, এটি একটি জনসম্পৃক্ত সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে বুঝতে হবে যে তাদের বাসাবাড়ির এক কোণায় জমে থাকা সামান্য পানি থেকেও ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটতে পারে। এজন্য সিটি কর্পোরেশন, এনজিও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণে নিয়মিত সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। ‘প্রতি শনিবার ১০ মিনিট’ নামের একটি ক্যাম্পেইন চালু করা যেতে পারে। যেখানে প্রত্যেক নাগরিক নিজ নিজ বাসা বা কর্মস্থল পরিষ্কার করবেন। ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র এটি শুরু করেছিল। তা আরও প্রসারিত করতে হবে। মিডিয়াতে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে জনমত তৈরি করা গেলে মানুষ আরও উদ্বুদ্ধ হবে।

ডেঙ্গু সচেতনতা শিশুদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে শৈশব থেকেই। স্কুলের পাঠ্যক্রমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও মশা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ছোট ছোট অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ডেঙ্গু সচেতনতা শিশুদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে শৈশব থেকেই। স্কুলের পাঠ্যক্রমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও মশা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ছোট ছোট অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কোর্সে কীটতত্ত্ব অন্তর্ভুক্ত করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বৈজ্ঞানিকভাবে বিষয়টি বুঝবে এবং সামাজিক নেতৃত্ব দিতে পারবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় এখনো দুর্বল। প্রতিটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু টাস্কফোর্স গঠন করে, সেখানে স্বাস্থ্যকর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা, সমাজসেবক ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এই টাস্কফোর্স মাসিক রিপোর্ট প্রস্তুত করবে, যা জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কাজের ওপর জবাবদিহিতা ও পুরস্কার-শাস্তির ব্যবস্থা থাকলে কার্যক্রম হবে আরও ফলপ্রসূ।

স্থানীয়ভাবে এডিস মশার জেনেটিক বৈচিত্র্য, ভাইরাসের সারোটাইপ পরিবর্তন, ওষুধ প্রতিরোধ এবং জলবায়ুগত সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা জোরদার করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি অর্থায়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আওতায় এনে ডেঙ্গু প্রতিরোধে দেশীয় সমাধান করতে হবে। ডেঙ্গুর মৌসুমে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য আলাদা ওয়ার্ড, পর্যাপ্ত বেড, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স নিশ্চিত করতে হবে। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়, ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট ও পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যেমন প্লেটলেট কাউন্টার, ইনফিউশন পাম্প ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রাইভেট ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের মধ্যে চিকিৎসা প্রটোকল অনুসরণের নির্দেশনা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে ভুল চিকিৎসা বা অতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগের ঝুঁকি কমে।

অবহেলিত বর্জ্য যেমন- পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিক বোতল, কাপ, ফুলের টব, ক্যান ইত্যাদি এডিস মশার আদর্শ প্রজননস্থল। নগর কর্তৃপক্ষকে তাই কঠোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করতে হবে। নতুন নির্মাণকাজে পানি জমা না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে বিল্ডিং কোডে নির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত। নগর পরিকল্পনায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি, ড্রেনেজ ক্লিনিং এবং বৃষ্টির পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে দ্রুতগতিতে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ডেঙ্গু সম্পর্কে সঠিক তথ্য ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধুমাত্র সংক্রমণ বাড়লে সংবাদ প্রকাশ নয়, বরং সারা বছরব্যাপী প্রতিরোধমূলক তথ্য প্রচার করতে হবে। ভুল ধারণা যেমন ‘ডেঙ্গু কেবল বর্ষাকালেই হয়’, এসব ধারণা ভাঙতে হবে সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে।

সবশেষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে কেবল স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প হিসেবে নয়, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় বাজেটে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে, প্রতিটি শহর ও পৌরসভাকে আগামী ৫ বছরের মধ্যে ‘ডেঙ্গুমুক্ত শহর’ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণে। ডেঙ্গু আজ কেবল একটি রোগ নয়, এটি বাংলাদেশের নগরজীবনের এক স্থায়ী বাস্তবতা। ভবিষ্যৎ করণীয়গুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে এডিস মশার প্রজনন কমানো এবং মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু তাতে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা, নাগরিক অংশগ্রহণ এবং প্রশাসনিক জবাবদিহিতা। এখনই সময়, ‘অবহেলা নয়’, এ মন্ত্রে সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসার।

লেখক: কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আজকের প্রত্যাশা/ কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

স্বাস্থ্য প্রতিদিন======

কমছে না ডেঙ্গু, বাড়ছে মৃত্যু, সমাধান কোথায়?

আপডেট সময় : ০৭:০০:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫

ড. কবিরুল বাশার

বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়, এটি এক জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে। এক সময় বর্ষাকালেই সীমাবদ্ধ থাকা ডেঙ্গুর সংক্রমণ এখন অক্টোবর-নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেও বিস্তার করবে বলে মনে হচ্ছে। এবছরের পরিস্থিতি আরও জটিল ও উদ্বেগজনক।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ৩১ অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত দেশে মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৯,৮৬২ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন ২৭৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৬৮ জন রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন, ফলে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা হয়েছে ৬৬,৮০২ জন। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ এখনো কমছে না। পুরুষ রোগীর সংখ্যা ৬৫.২ শতাংশ, নারী রোগী ৩৪.৮ শতাংশ। আক্রান্তদের মধ্যে ১৬–২০ বছর বয়সী তরুণরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, এরপর ২১–২৫ বছর বয়সীদের অবস্থান। মৃত্যুর দিক থেকে দেখা যায়, পুরুষের মৃত্যু ৫৩.২ শতাংশ এবং নারীর মৃত্যু ৪৬.৮ শতাংশ।

১ নভেম্বর ২০২৫ সকাল ৮টা থেকে ২ অক্টোবর ২০২৫ সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৭১ হাজার ৬৭৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২৮৩ জনের [ঢাকা পোস্ট, ২ নভেম্বর ২০২৫]। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ০-৫ বছর ও ১১-১৫ বছর বয়সী শিশু ও কিশোরদের মধ্যে। সর্বাধিক মৃত্যু ঘটেছে ঢাকা বিভাগে, যা রাজধানীকেন্দ্রিক উচ্চ ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে বলা যায়, নভেম্বর মাসেও ডেঙ্গু কমছে না বরং পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে। এর মূল কারণগুলো একাধিক এবং সেগুলো পরস্পর-সম্পর্কিত।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া এখন আর পূর্বের নিয়মে চলে না। আগে যেখানে সেপ্টেম্বরের পর বৃষ্টির ধারা প্রায় বন্ধ হয়ে যেত, এখন দেখা যায় অক্টোবরের শেষ দিকেও হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে, যা এডিস মশার প্রজননের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ে; যেমন ফুলের টব, ড্রাম, প্লাস্টিকের পাত্র, পুরনো টায়ার, ছাদের নিচের গর্তে পানি ইত্যাদি। অক্টোবর-নভেম্বরে বৃষ্টিপাতের ফলে এসব স্থানে পুনরায় পানি জমে এবং মশার ডিম থেকে লার্ভা ও পিউপা হয়ে নতুন প্রজন্মের মশা জন্ম নিচ্ছে। তাই বৃষ্টি যত দেরিতে হয়, ডেঙ্গুর প্রজনন চক্র তত দীর্ঘায়িত হয়। এ ছাড়া তাপমাত্রাও এখন ডেঙ্গুর পক্ষে। ২০–৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এডিস মশার বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত, যা নভেম্বর মাসেও বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বিরাজ করে। ফলে বৃষ্টির সঙ্গে তাপমাত্রা মিলিয়ে এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়েছে ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রশাসনিক অদক্ষতা, অভিজ্ঞ ও দক্ষ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ না করা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধীরগতি। স্থানীয় সরকার বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওয়ার্ড পর্যায়ে মশা নিধন কর্মসূচি কেবল ‘দেখানোর জন্য’ চলে। ফগার মেশিনের কার্যকারিতা সীমিত এবং অনেক সময় এটি ভুল জায়গায় বা ভুল সময়ে ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রশাসনিক অদক্ষতা, অভিজ্ঞ ও দক্ষ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ না করা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধীরগতি। স্থানীয় সরকার বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে লার্ভা ধ্বংসের কার্যক্রমে কার্যকরী কীটনাশক, কীটনাশক প্রয়োগের সময়, ডোজ, প্রশিক্ষণ ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ফলস্বরূপ শহরের গলি, নির্মাণাধীন ভবন, বেজমেন্ট, ড্রেন, ফুলের টব ও ছাদের পানি জমা স্থানে এডিস মশা সহজেই প্রজনন করছে।

ডেঙ্গু মোকাবিলায় নাগরিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এডিস মশার ৮০ শতাংশ প্রজনন স্থানই মানুষের আবাসিক বা কর্মস্থল পরিবেশে অবস্থিত। তবুও অনেকেই এখনো বিশ্বাস করেন এটি ‘সরকারের দায়িত্ব’। বাসা বা অফিসের ছাদে, বারান্দায়, ফুলের টবে বা ড্রামে জমে থাকা পানি পরীক্ষা করার অভ্যাস এখনো গড়ে ওঠেনি। অনেকে মনে করেন, এক-দুই দিনের পানি জমে থাকলে ক্ষতি নেই, কিন্তু বাস্তবে এডিস মশা মাত্র ৫–৭ দিনে ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হয়ে যায়। জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারণা প্রায়শই স্বল্পমেয়াদি ও মৌসুমি। অথচ এটি হওয়া উচিত সারাবছরের কার্যক্রম। নাগরিকদের নিজ নিজ উদ্যোগে পানি জমা স্থান পরিষ্কার রাখা, নিয়মিত লার্ভা পরীক্ষা করা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে তথ্য জানানো, এই তিনটি দায়িত্ব এখন অপরিহার্য।

অনেকে মনে করেন শীত এলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ঢাকা শহরের বহুতল ভবনের বেজমেন্ট, পার্কিং স্থান, গাড়ি ধোয়ার জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের পানি জমা স্থান এবং অনেক এলাকায় পানির স্বল্পতার কারণে ড্রাম বা বালতিতে জমিয়ে রাখা পানি, এসব স্থানে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সারা বছর প্রজনন করতে পারে। এই পানির উৎসগুলোর সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক নেই, তাই শীতকালেও এডিস মশার প্রজনন চলতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের অনেক ভবনের নিচতলা ও বেজমেন্টে দিনের বেলায় প্রচুর এডিস মশা থাকে, যা শীতেও সক্রিয় থাকে। ফলে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গুর সংক্রমণ অব্যাহত থাকতে পারে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ হলো এডিস মশার লার্ভা কোথায় কোথায় জন্ম নিচ্ছে তা সঠিকভাবে জানা। এজন্য প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায় সারা বছরব্যাপী লার্ভা সার্ভিলেন্স কার্যক্রম চালু করা জরুরি। প্রতি ওয়ার্ডে নিয়মিত লার্ভা সার্ভে করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ও সময় চিহ্নিত করতে হবে। ডেটা ব্যবহার করে ‘হটস্পট ম্যাপিং’ করা গেলে কোথায় মশার ঘনত্ব বেশি এবং কোন এলাকায় দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন তা জানা যাবে। ফলে পরিকল্পনা হবে আরও বাস্তবসম্মত ও তথ্যনির্ভর।

বৃষ্টি এডিস মশার প্রজননের প্রধান সহায়ক। কারণ পরিষ্কার পানিতে এরা ডিম পাড়ে এবং মাত্র ৫–৭ দিনের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপ নেয়। তাই প্রতিটি বৃষ্টির পর সর্বোচ্চ তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষের লার্ভা ধ্বংস অভিযান পরিচালনা করা আবশ্যক। ফগার মেশিন নয় বরং উৎসস্থলে লার্ভিসাইড প্রয়োগ, জমে থাকা পানি অপসারণ এবং শুকনো পরিবেশ নিশ্চিত করাই হবে কার্যকর সমাধান। একইসঙ্গে প্রতিটি ভবন মালিক বা ব্যবস্থাপককে নিজ নিজ ভবনের আশেপাশের পানি জমা স্থানের দায়িত্ব নিতে হবে।

ডেঙ্গু দমন কেবল সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়, এটি একটি জনসম্পৃক্ত সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে বুঝতে হবে যে তাদের বাসাবাড়ির এক কোণায় জমে থাকা সামান্য পানি থেকেও ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটতে পারে। এজন্য সিটি কর্পোরেশন, এনজিও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণে নিয়মিত সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। ‘প্রতি শনিবার ১০ মিনিট’ নামের একটি ক্যাম্পেইন চালু করা যেতে পারে। যেখানে প্রত্যেক নাগরিক নিজ নিজ বাসা বা কর্মস্থল পরিষ্কার করবেন। ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র এটি শুরু করেছিল। তা আরও প্রসারিত করতে হবে। মিডিয়াতে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে জনমত তৈরি করা গেলে মানুষ আরও উদ্বুদ্ধ হবে।

ডেঙ্গু সচেতনতা শিশুদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে শৈশব থেকেই। স্কুলের পাঠ্যক্রমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও মশা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ছোট ছোট অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ডেঙ্গু সচেতনতা শিশুদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে শৈশব থেকেই। স্কুলের পাঠ্যক্রমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও মশা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ছোট ছোট অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কোর্সে কীটতত্ত্ব অন্তর্ভুক্ত করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বৈজ্ঞানিকভাবে বিষয়টি বুঝবে এবং সামাজিক নেতৃত্ব দিতে পারবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় এখনো দুর্বল। প্রতিটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু টাস্কফোর্স গঠন করে, সেখানে স্বাস্থ্যকর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা, সমাজসেবক ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এই টাস্কফোর্স মাসিক রিপোর্ট প্রস্তুত করবে, যা জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কাজের ওপর জবাবদিহিতা ও পুরস্কার-শাস্তির ব্যবস্থা থাকলে কার্যক্রম হবে আরও ফলপ্রসূ।

স্থানীয়ভাবে এডিস মশার জেনেটিক বৈচিত্র্য, ভাইরাসের সারোটাইপ পরিবর্তন, ওষুধ প্রতিরোধ এবং জলবায়ুগত সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা জোরদার করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি অর্থায়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আওতায় এনে ডেঙ্গু প্রতিরোধে দেশীয় সমাধান করতে হবে। ডেঙ্গুর মৌসুমে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য আলাদা ওয়ার্ড, পর্যাপ্ত বেড, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স নিশ্চিত করতে হবে। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়, ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট ও পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যেমন প্লেটলেট কাউন্টার, ইনফিউশন পাম্প ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রাইভেট ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের মধ্যে চিকিৎসা প্রটোকল অনুসরণের নির্দেশনা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে ভুল চিকিৎসা বা অতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগের ঝুঁকি কমে।

অবহেলিত বর্জ্য যেমন- পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিক বোতল, কাপ, ফুলের টব, ক্যান ইত্যাদি এডিস মশার আদর্শ প্রজননস্থল। নগর কর্তৃপক্ষকে তাই কঠোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করতে হবে। নতুন নির্মাণকাজে পানি জমা না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে বিল্ডিং কোডে নির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত। নগর পরিকল্পনায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি, ড্রেনেজ ক্লিনিং এবং বৃষ্টির পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে দ্রুতগতিতে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ডেঙ্গু সম্পর্কে সঠিক তথ্য ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধুমাত্র সংক্রমণ বাড়লে সংবাদ প্রকাশ নয়, বরং সারা বছরব্যাপী প্রতিরোধমূলক তথ্য প্রচার করতে হবে। ভুল ধারণা যেমন ‘ডেঙ্গু কেবল বর্ষাকালেই হয়’, এসব ধারণা ভাঙতে হবে সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে।

সবশেষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে কেবল স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প হিসেবে নয়, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় বাজেটে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে, প্রতিটি শহর ও পৌরসভাকে আগামী ৫ বছরের মধ্যে ‘ডেঙ্গুমুক্ত শহর’ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণে। ডেঙ্গু আজ কেবল একটি রোগ নয়, এটি বাংলাদেশের নগরজীবনের এক স্থায়ী বাস্তবতা। ভবিষ্যৎ করণীয়গুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে এডিস মশার প্রজনন কমানো এবং মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু তাতে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা, নাগরিক অংশগ্রহণ এবং প্রশাসনিক জবাবদিহিতা। এখনই সময়, ‘অবহেলা নয়’, এ মন্ত্রে সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসার।

লেখক: কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আজকের প্রত্যাশা/ কেএমএএ