ইসলাম বাজার ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক গতিতে চলার নির্দেশনা দেয়। উৎপাদন ও সরবরাহ খরচ বিবেচনায় ন্যায্যমূল্যে বেচাকেনা করতে ইসলামে বাধা নেই। তবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম বা নিষিদ্ধ।
শরিয়তের দৃষ্টিতে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে কারও হস্তক্ষেপ করার অনুমোদন নেই। তবে মজুতদারি, মধ্যস্বত্ব ও সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে শাসকের দায়িত্ব হলো পণ্যের একটি দর নির্ধারণ করে দেওয়া। জনসাধারণের দুর্ভোগ কমাতে এবং বাজারের শৃঙ্খলা রক্ষায় সংঘবদ্ধ চক্রকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা উচিত।
হাদিসে বর্ণিত- হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.), দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দিন।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রব্যমূল্যের গতি নির্ধারণকারী। তিনিই একমাত্র সংকীর্ণতা ও প্রশস্ততা আনয়নকারী এবং তিনি রিজিকদাতা। আমি আল্লাহর সঙ্গে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে চাই, যেন তোমাদের কেউ আমার বিরুদ্ধে তার জানমালের ব্যাপারে জুলুমের অভিযোগ তুলতে না পারে’ (তিরমিজি)।
স্বাভাবিক অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করা বৈধ না হলেও ব্যবসায়ী যদি সিন্ডিকেটের কারসাজিতে অন্যায়ভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে সরকারকে অবশ্যই বাজার ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে।
ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘মূল্য নির্ধারণ করা ছাড়া যদি মানুষের কল্যাণ সাধন সম্ভব না হয়, তাহলে শাসক তাদের জন্য ন্যায়সংগত মূল্য নির্ধারণ করে দেবেন। কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা কারও প্রতি অন্যায় করা যাবে না। আর মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই যদি তাদের প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায় এবং কল্যাণ সাধিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান মূল্য নির্ধারণ করবেন না’ (আত-তুরুকুল হুকুমিইয়াহ ফিস-সিয়াসাতিশ শারইয়্যাহ)।
ইসলাম মূল্য বৃদ্ধির প্রধান প্রধান কারণ চিহ্নিত করে তা প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছে। যেমন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মজুতদারি। অধিক মুনাফার জন্য পণ্য গুদামজাত করে রাখা ইসলামে নিষিদ্ধ। বিশেষত তা যদি খাদ্যশস্য হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানের খাদ্যশস্য মজুত রাখে, আল্লাহ তার ওপর দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন’ (সুনানে আবি দাউদ)।
বাজারদর নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা অসাধু ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট। ইসলামের নির্দেশনা হলো, পণ্য উৎপাদনের পর তা স্বাধীনভাবে বাজারে প্রবেশ করবে। বাজারদর বৃদ্ধির জন্য তা আটকে রাখবে না।
হাদিসে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুত রাখে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা)।
কালোবাজারির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো যা সরাসরি প্রতারণা, জুলুম ও আর্থিক অসততার শামিল। আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ১৮৮ আয়াতে এরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা নিজেরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’
মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ভোক্তা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারে না। ইসলাম পণ্য উৎপাদনের পর তা বাজারজাতকরণ পর্যন্ত মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছে। হাদিসে বর্ণিত, হজরত আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের কাছ থেকে খাদ্য ক্রয় করতাম। এতে রাসুলুল্লাহ (সা.) খাদ্য বাজারে পৌঁছানোর আগে আমাদের তা ক্রয় করতে নিষেধ করলেন’ (সহিহ বুখারি)।
ইসলামের নীতি হলো পারস্পরিক কল্যাণকামিতা। ব্যবসায়ীদের জন্য যেমন সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো বৈধ হবে না, তেমনি রাষ্ট্র কর্তৃক অন্যায্য কোনো সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াও ঠিক হবে না। মহান আল্লাহ আমাদের তার দেওয়া বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করার তৌফিক দান করুন।
মো. শাহজাহান কবীর: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ