চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকের অপসারিত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের কথা মনে আছে? বছর খানেক আগে যাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। জীবিকার তাগিদে এখন তিনি করছেন দোকানদারি। চট্টগ্রাম ষোলশহর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটি মাঝারি আকারের কনফেকশনারিতে ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন শরীফ। দোকানটা তার ভাইয়ের।
অথচ এক বছর আগেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা ছিলেন। রোহিঙ্গা এনআইডি জালিয়াতি, কক্সবাজারের বড় বড় প্রকল্পের দুর্নীতিসহ চাঞ্চল্যকর তথ্য বের করে এনেছিলেন তিনি। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলার পাশাপাশি কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছিলেন। পরে রাঘববোয়ালের রোষানলে পড়ে চাকরি হারানোর গল্পটা তো সবারই জানা।
সরেজমিনে ষোলশহর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখা যায়, দোকানদারিতে ব্যস্ত দুদকের অপসারিত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন। অন্যান্য কর্মচারীরা খরিদ্দার সামলাচ্ছেন, সেদিকে চোখ রাখতে হচ্ছে তাকে। আবার পণ্যের দাম নেওয়া, টাকাপয়সার হিসাব রাখতে হচ্ছে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সংসার-ভবিষ্যতের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি।
শরীফ বলেন, ‘দেখেন ভাই, আমার বউ-বাচ্চা আছে। মা অনেক দিন ধরে অসুস্থ। আমিও অসুস্থ। গত ৯ মাস আমার চাকরি নেই। দুর্নীতি যদি করতাম, তাহলে বসে বসে খেতে পারতাম। যেদিন থেকে বেতন বন্ধ, ওই দিন থেকে সংসারে টান পড়েছে। চাকরির জন্য সবার কাছে গেছি। বিডিজবসে আবেদন করেছি। কিন্তু দুদক সবখানে বলে দেওয়ায় কোথাও চাকরি হয়নি। তাই ভাইয়ের এই দোকানের ক্যাশে বসে সংসার সামলাচ্ছি।’
উপসহকারী পরিচালক হিসেবে শরীফ উদ্দিন প্রায় সাড়ে তিন বছর দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। সে সময় এনআইডি সার্ভার ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি ভোটার করার অভিযোগে ২০২১ সালের জুনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একজন পরিচালক, ৬ কর্মীসহ আরও ১০ জনের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেন। সেই মামলার পরপর ওই বছরের ১৬ জুন শরীফকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়। এর আট মাসের মাথায় চাকরি থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়।
শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘আমার কাজে খুশি হয়ে কয়েকবার সেরা কর্মকর্তার পুরস্কারও দেওয়া হয়। আমি সেসব বিষয় তদন্ত করেছি, যেগুলো দুদকের ঊর্ধ্বতনেরা আমাকে তদন্তের জন্য দিয়েছেন। তারা আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, তাই শত বাধার মধ্যেও তদন্তে যাদের নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়েছি।’
শরীফ ইসি কর্মকর্তা-কর্মচারী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইয়াবা চোরাকারবারি, রোহিঙ্গা, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি মামলা করেছিলেন।
সেগুলোর উল্লেখ করে শরীফ বলেন, ‘তদন্তের সময় বা মামলা করার পর আমাকে একটি বারও বলা হয়নি যে আমার এসব কাজ ভুল হয়েছে। মামলা করার আগে দুদকের অনুমোদন লাগত, তারাই তো মামলা করার অনুমতি দিয়েছে।’
চাকরি হারানোর খবর পাওয়ার দিন ওয়াশরুমে ঢুকে দেড় ঘণ্টা কেঁদেছিলেন বলে উল্লেখ করেন শরীফ। তিনি বলেন, ‘এতটাই ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম, মনে করেছিলাম মারাই যাব। মনে মনে বলতাম, হায় হায়! দেশের জন্য কাজ করে, এক টাকাও দুর্নীতির আশ্রয় না নিয়েও আমার চাকরিটা চলে গেল।’
চাকরি যাওয়ার আগে দুর্নীতিবাজেরা ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছিল বলে জানান শরীফ। তিনি বলেন, ফেসবুকে তারা লিখেছিলেন, ‘শরীফ তোর আর সময় নেই। জেলের ভাত খাওয়াব, চাকরিটাও খাব।’
সেসব ফেসবুক স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট ঊর্ধ্বতনদের জানিয়েও লাভ হয়নি বলে দাবি করেন শরীফ। তবে তিনি এখনো আশায় চাকরিটা ফিরে পাবেন। শরীফ দাবি করেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। গত ৯ মাস মানবেতর জীবন যাপন করছি। আশা করি চাকরিটা ফিরে পাবো।’
চাকরি হারানোর পর সেটি ফিরে পেতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আবেদন করেছিলেন শরীফ। কিন্তু দুদক মহাপরিচালক (প্রশাসন) জিয়াউদ্দীন আহমেদের সই করা এক আদেশে সেই আবেদন নাকচ করা হয়। এছাড়া গত ১৩ মার্চ চাকরি থেকে অপসারণের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে রিটও করেন। আবেদন করেন প্রধানমন্ত্রীর কাছেও।
দোকানদারি করছেন দুদকের সেই কর্মকর্তা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ