নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে করোনা শনাক্তের নি¤œহার সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীনতা সৃষ্টি করেছে। স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে এ হেলাফেলা ভাবাচ্ছে জনস্বাস্থ্যবিদদের। তাঁরা বলছেন, এমনটা চলতে থাকলে সংক্রমণের এ ধীরগতি অব্যাহত থাকবে না। আবার নতুন বা তৃতীয় ঢেউ আসাটাও বিচিত্র নয়। আর তা এলে শুধু স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নয়, আর্থসামাজিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়বে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি বেশি ভাবিয়ে তুলছে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যবিদদের। গত প্রায় দুই সপ্তাহজুড়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শনাক্তের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। দার্জিলিং বা জলপাইগুড়ির মতো পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন বিভিন্ন জেলায় শনাক্তের হার বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে শনাক্তের হার ও মৃত্যু বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়। আমাদের দীর্ঘ সীমান্ত আছে। তাই সীমান্তে সাধারণ যে নজরদারি এখন আছে, তা বাড়াতে হবে। সীমান্ত এলাকায় অপ্রাতিষ্ঠানিক যাতায়াতের দিকে বেশি নজর দিতে হবে।’
গত বুধবার পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রকাশিত বুলেটিন অনুযায়ী, সেই রাজ্যে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ৯৭৬। এ সময় মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। কলকাতায় ২৭২ জন ও উত্তর ২৪ পরগনায় ১৫৯ জন শনাক্ত হন। পাশাপাশি হাওড়ায় ৭৯ জন, হুগলিতে ৭৩, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৭৯, নদিয়ায় ৪৫, দার্জিলিংয়ে ৩২, জলপাইগুড়িতে ২৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এ প্রবণতা বাড়ছে বলেও বুলেটিনে উল্লেখ করা হয়। দুর্গাপূজার পর থেকেই সংক্রমণের উর্ধ্বগতি এ রাজ্যে।
বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড় জেলার সীমান্ত লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের জেলা দার্জিলিংয়ে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে। পঞ্চগড়সংলগ্ন আরেক জেলা জলপাইগুড়িতে সংক্রমণ বাড়ার দিকে। পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমণ বাড়লে বাংলাদেশে শঙ্কার নানা কারণ রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দুটি অঞ্চলের অভিন্ন স্থল সীমান্ত বিশাল। দুটি দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপকহারে যাওয়া–আসা আছে।
এটা বৈধ এবং অনানুষ্ঠানিক-দুই ভাবেই ব্যাপকহারে হয়। বৈধভাবে যারা আসছে, তাদের একধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়েই ঢুকতে হয়। তবে সীমান্ত পার হয়ে যারা আসছে তাদের করোনার নেগেটিভ সনদ প্রদর্শন, তাপমাত্রা দেখার যে রীতি চালু আছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি সরকার নিয়োজিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দলের (সিলেট বিভাগ) সদস্য। তিনি বলছিলেন, অনেক আক্রান্ত ব্যক্তি আছে, যাদের অনেক সময় কোনো লক্ষণ বোঝা যায় না। তারা ঠিকই দেশের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে।
ডা. ফয়সাল সে ক্ষেত্রে সীমান্তে আসা ব্যক্তিদের নজরদারি বাড়ানো এবং সেই সঙ্গে কোয়ারেন্টিন আরও জোরদার করার পক্ষপাতী।
এ তো গেল বৈধভাবে আসা ব্যক্তিদের কথা। দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অনানুষ্ঠানিক যাতায়াত হয় অনেক, এমনটা মনে করেন মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, এই চলাচল নজরদারির বাইরে যারা থাকে, তারাই সংক্রমণ ছড়াতে বড় ভূমিকা রাখে।
জনস্বাস্থবিদেরা এ প্রসঙ্গে ডেলটা ভেরিয়েন্ট বা ধরনের সংক্রমণ এবং এর ব্যাপকতার উল্লেখ করেন। গত বছরের অক্টোবরে ভারতে ধরনটি প্রথম শনাক্ত করা হয়। এটি করোনার আগের স্ট্রেইনের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক। বাংলাদেশে গত ৮ মে প্রথম ডেলটা ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়। সে সময় স্বাস্থ্য বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানান, ভারত থেকে বেনাপোল দিয়ে আসা আটজনের নমুনা পরীক্ষার পর তাঁদের ছয়জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
ডেলটা সীমান্তসংলগ্ন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলায় অনেক বেশি ছড়ায়। জুনে বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের যে নমুনা সংগ্রহ করা হয় তাদের ৮০ শতাংশের দেহে ডেলটা ধরন মেলে। আইইডিসিআর এবং ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস (আইদেশি) করোনার ৫০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা যায়, ৫০টি নমুনার মধ্যে ৪০টি বা ৮০ শতাংশ ডেলটা ভেরিয়েন্ট, ৮টি বা ১৬ শতাংশ বিটা ভেরিয়েন্ট। এর মাধ্যমে দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গত মে মাস থেকে বাড়তে থাকা করোনার সংক্রমণ আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলে। জুলাইয়ে শনাক্তের হার ৩২ ছাড়িয়ে যায়।
সীমান্তের অনানুষ্ঠানিক যাতায়াতকারীরা পশ্চিমবঙ্গে বাড়তে থাকা এলাকাগুলো থেকে সংক্রমিত হয়ে আসতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তবে এসব যাতায়াতকারীদের ‘অপরাধী’ চিহ্নিত না করে বরং সামাজিকভাবে সচেতন করার পক্ষে মত দেন মুশতাক হোসেন। তাঁর কথা, তাদের ওপর আইনি বাধ্যবাধকতা বেশি জোরদার করা হলে তারা আরও গোপনীয়তা অবলম্বন করতে পারে। তখন পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সীমান্ত এলাকায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিলে সামাজিকভাবে সচেতনতা বাড়াতে পারে। স্থানীয় লোকজনকে বোঝাতে হবে এবং তাদের আস্থার জায়গায় নিয়ে আসতে হবে।
সীমান্ত এলাকায় সেই তৎপরতা কতটুকু। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং জেলার সীমান্তের বাংলাদেশি জেলা পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন মো. ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জেলার মাসিক সভায় সীমান্তের বিষয় নিয়ে কথা বলি। যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার তা এখনো চলছে।’
তবে ফজলুর রহমান বলেন, ‘সীমান্তে মানুষকে সচেতন করার মতো কাজগুলো অতীতের সব সময় করেছি, কাজও হয়েছে। সাম্প্রতিক সময় করা হয়নি। তবে এটা আমাদের করতে হবে।’
পশ্চিমবঙ্গের করোনা সংক্রমণ বাড়লেও বাংলাদেশে শনাক্তের হার এখন ২-এর মধ্যে আছে। গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১৬৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়, মৃত্যু হয় ৮ জনের। নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ১ দশমিক ২৫। শনাক্তের এ নি¤œহার কিছু মানুষের মধ্যে উদাসীনতা তৈরি করেছে। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করছে বলে মনে করেন কোভিড-১৯-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা। তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষ সংক্রমণের নি¤œহার দেখে উদাসীন হয়ে পড়ছে। নিজের চোখে দেখেছি, বিয়ে–জন্মদিনের মতো অনুষ্ঠানে অনেক লোক হচ্ছে। আর সেখানে অনেকেই মাস্ক পরছে না। পড়লেও থুতনির নিচে নামিয়ে রেখেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে উদাসীনতা বাড়ছে। এটা আমাদের জাতীয় কমিটির সদস্যদের পর্যবেক্ষণ। এর ফলে আগামী দিনে সংক্রমণ বাড়ার একটি আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।’
কম সংক্রমণ থেকে ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। ভারতের কেরালা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া—এসবের উদাহরণ। তাই বাংলাদেশে করোনার নি¤œহারে কোনো স্বস্তির অবকাশ নেই বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরাসবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘করোনার সংক্রমণের নি¤œগতিতে আপ্লুত হওয়ার কিছু নেই। ভাইরাস তো আমাদের দেশ বা বিশ্বের কোনো অঞ্চল থেকেই নেই হয়ে যায়নি। টিকাদানের পাশাপাশি মাস্ক পরা, হাত ধোয়া বা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার নিয়ম তো মানতে হবেই। কিন্তু এসব বিষয়ে ঢিলেমি দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন পরিসরে।’
করোনাকালে আরোপিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার খামতি যে হচ্ছে তা বিশেষজ্ঞদের গোচরে এসেছে। অধ্যাপক সহিদুল্লা জানান, এসব বিষয় নিয়ে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে জাতীয় কমিটি বসবে। আর তাদের এসব উদ্বেগের কথা সরকারকে জানাবে। যাতে স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ির বিষয়টি আবারও প্রচার হয় এবং বাস্তবায়িত হয়।
দেশে দেড় বছরে সর্বনি¤œ শনাক্ত : দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের সংখ্যা দিন দিন কমছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয় ১৬৬ জনের। যা গত দেড় বছরে সর্বনি¤œ। এর আগে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ১৩৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর বাড়তে থাকে শনাক্তের সংখ্যা। একসময় দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা হাজার ছাড়ায়। চলতি বছর ২৮ জুলাই সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়। সবশেষ গতকাল শনিবার (৩০ অক্টোবর) শনাক্তের সংখ্যা নেমে হয় ১৬৬ জন।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে করোনায় আরও আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৮৬২ জনে। এদিকে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা হয়েছে ১৫ লাখ ৬৯ হাজার ৩২৮ জন। শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত করোনা পরিস্থিতি সংক্রান্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় সরকারি-বেসরকারি ৮৩৩টি ল্যাবরেটরিতে ১৩ হাজার ১০৫ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে পরীক্ষা করা হয় ১৩ হাজার ২৪০ জনের নমুনা। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। দেশে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর থেকে রোগী শনাক্তের মোট হার ১৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সেরে উঠেছেন ১৮১ জন। এ নিয়ে মহামারি শুরুর পর করোনা থেকে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৩৩ হাজার ১৪৭ জনে। সুস্থতার হার ৯৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ওই বছরের ১৮ মার্চ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়। যা ছিল দেশে এ ভাইরাসে প্রথম মৃত্যু।
দেড় বছরে সর্বনিম্ন শনাক্ত তবুও যে শঙ্কায় বাংলাদেশ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ