নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে করোনা পরিস্থিতির সকল হিসাব পাল্টে গেছে শেষ সপ্তাহে। ৮ জুলাই সকাল ৮টা থেকে ৯ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২১২ জন। দেশে মহামারিকালে একদিনে এত মৃত্যু এই প্রথম দেখলো বাংলাদেশ। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত মৃত্যু ১৬ হাজার পার হলো।
দেশে করোনা সংক্রমণ কতটা ভয়াবহ হয়েছে তা বোঝা যায় গত পাঁচদিনের মৃত্যুতে। এ সময় মারা গেছেন ৯৩৬ জন।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে মৃত্যু গত কয়েকদিরে তুলনায় কিছুটা কমেছে। উল্লেখিত সময়ে এক শিশুসহ মারা গেছেন ১৮৫ জন। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃত্যু ১৬ হাজার ১৮৯ জনের। এদিকে গত এক দিনে কম নমুনা পরীক্ষায় কমেছে শনাক্তের সংখ্যাও। উল্লেখিত সময়ে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৭৭২ জন।
গতকাল শনিবার বিকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ২৭ হাজার ৮৮৪টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হন ৮ হাজার ৭৭২ জন, যাতে শনাক্তের হার ৩১.৪৬ শতাংশ। শুক্রবার পরীক্ষা করা হয় ৩৬ হাজার ৫৮৬টি নমুনা, যাতে শনাক্ত হন১১ হাজার ৩২৪ জন। শনাক্তের হার ছিল ৩০.৯৫ শতাংশ। এ নিয়ে মোট শনাক্ত ১০ লাখ ৯ হাজার ৩১৫ জন। এ পর্যন্ত মোট পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও জানায়, গত এক দিনে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ১২১ জন পুরুষ এবং ৬৪ জন নারী। নতুন মৃতদের মধ্যে ৭০ জনই ঢাকার। এছাড়া চট্টগ্রামে ২০, রাজশাহীতে ১৩, খুলনায় ৫১, বরিশালে ১০, সিলেটে ৭, রংপুরে ১১ এবং ময়মনসিংহে ৩ জন মারা গেছেন।
বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ৯২ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। এছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছরের ৫১ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ২২ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ১৩ জন এবং ২১ থেকে ৩০ বছরের ৫ জন, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে একজন ও শূন্য থেকে ১০ বছরের একজন রয়েছেন। এ নিয়ে দেশে করোনার মৃত্যুর মোট সংখ্যা দাঁড়ালো ১৬ হাজার ১৮৯ জনে। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৫ হাজার ৭৫৭ জন এবং এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৮ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৯ জন। দেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবর আসে। কয়েক মাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ঊর্ধ্বগতিতে থাকার পর অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। চলতি বছরের শুরুতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন শনাক্তের হারও ৫ শতাংশের নিচে নেমেছিল। তবে গত মার্চ মাস থেকে মৃত্যু ও শনাক্ত আবার বাড়তে থাকে। জুলাই মাসে দৈনিক শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের উপরে আছে। মোট গড় হার ১৪ শতাংশের উপরে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদ- অনুযায়ী, কোনো দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। সে হিসেবে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেই বলা যায়।
বিশেষজ্ঞরা এটাকে বাংলাদেশে করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ বলছেন। করোনা সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করায় প্রথমে ২১ এপ্রিল ও পরে তা বাড়িয়ে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বিধিনিষেধ জারি করেছিল সরকার। এরপর সেটি ধাপে ধাপে বাড়িয়ে ১৬ জুলাই পর্যন্ত করা হয়েছে। এর মধ্যেই আবার ১ জুলাই থেকে এক সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউনের জারি করেছে সরকার, যা আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে।
সব হিসাব পাল্টে গেল শেষ পাঁচদিনের মৃত্যুতে : ৮ জুলাই সকাল ৮টা থেকে ৯ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২১২ জন। দেশে মহামারিকালে একদিনে এত মৃত্যু এই প্রথম দেখলো বাংলাদেশ। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত মৃত্যু ১৬ হাজার পার হলো।
দেশে করোনা সংক্রমণ কতটা ভয়াবহ হয়েছে তা বোঝা যায় গত পাঁচদিনের মৃত্যুতে। এ সময় মারা গেছেন ৯৩৬ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ৯ জুলাই ২১২ জন, ৮ জুলাই ১৯৯ জন, ৭ জুলাই ২০১ জন, ৬ জুলাই ১৬৩ ও ৫ জুলাই ১৬৪ জন।
হাজার মৃত্যু : ৪ জুলাই ১৫৩ জনের মৃত্যু হয়। সেদিন স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছিল, মোট মৃত্যু ১৫ হাজার ৬৫ জন। সে হিসাবে গত ছয় দিনে দেশে মহামারিকালে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এক হাজার মানুষের মৃত্যু হলো। এর আগে দ্রুততম হাজার পেরিয়েছিল আট দিনে। ওই সময়কালে মারা গেছেন এক হাজার ১২ জন। ২৭ জুন ১১৯ জন, ২৮ জুন ১০৪, ২৯ জুন ১১২, ৩০ জুন ১১৫, ১ জুলাই ১৪৩, ২ জুলাই ১৩২, ৩ জুলাই ১৩৪ ও ৪ জুলাই ১৫৩ জন। গেল বছরের মার্চ থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যু দুই হাজার ছাড়ায়। পরের হাজার রোগীর মৃত্যু হয় মাত্র ২৫ দিনে। তৃতীয় এক হাজার রোগীর মৃত্যু হয় ২৩ দিনে।
করোনায় মৃতের সংখ্যা চার হাজার পূর্ণ হয় পরের ২৮ দিনে। পাঁচ হাজার পূর্ণ হয় আরও ২৮ দিনে, ছয় হাজার পূর্ণ হতে সময় লাগে ৪৩ দিন, সাত হাজার ৩৮ দিনে ও আট হাজার পূর্ণ হয় পরের ৪২ দিনে। নয় হাজার পেরোনোর পরই বাড়তে থাকে গতি। এরপর মাত্র ১৫ দিনে মারা যায় আরও এক হাজার। তখন অর্থাৎ চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল মোট মৃত্যু ছাড়ায় দশ হাজার। এরপর ১০ থেকে ১১ হাজার; অর্থাৎ পরবর্তী এক হাজার রোগীর মৃত্যু হতে সময় লেগেছে মাত্র ১০ দিন। ১২ হাজার হয়েছে পরের ১৬ দিনে, ১৩ হাজার হয়েছে পরের ৩১ দিনে, ১৪ হাজার হয়েছে ১৫ দিনে। ১৪ থেকে ১৫ হাজার মৃত্যু হয় মাত্র আটদিনে। এবারে ৪ জুলাই থেকে এক হাজার মানুষের মৃত্যু হতে সময় নিল মাত্র পাঁচদিন।
শনাক্তের গতি : সর্বোচ্চ ২১২ মৃত্যুর দিনে নতুন করে ১১ হাজার ৩২৪ জনের সংক্রমণের কথাও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তাদের নিয়ে ১৬ মাসের মহামারিকালে করোনা রোগীর সংখ্যা ছাড়ালো ১০ লাখ। দেশে সরকারি হিসাবে এখন করোনা শনাক্ত হলেন ১০ লাখ ৫৪৩ জন। টানা চতুর্থ দিনের মতো শনাক্তের সংখ্যা ১১ হাজারের ওপরে। এর আগে গত ৮ জুলাই শনাক্ত হয় ১১ হাজার ৬৫১ জন। যা এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। এর আগে ৭ জুলাই ১১ হাজার ১৬২ জন ও ৬ জুলাই শনাক্ত হন ১১ হাজার ৫২৫ জন। গত ২৯ জুন দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়েছিল ৯ লাখ। সেই হিসেবে ১০ লাখ ছাড়াতে অর্থাৎ নতুন এক লাখ শনাক্ত হয়েছেন মাত্র ১০ দিনে। মৃত্যুর পাশাপাশি এক লাখ রোগী শনাক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও এটা সবচেয়ে কম সময়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গতবছরের ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্তের তিন মাস পর এক লাখ রোগী ছাড়ায় ১৮ জুন। তার একমাস পর ১৮ জুলাই শনাক্ত রোগী দুই লাখ ছাড়ায়। ২৬ আগস্ট তিন লাখ রোগী হতে সময় লাগে এক মাস ৯ দিন। তিন লাখ থেকে চার লাখ রোগী ছাড়ায় গত ২৬ অক্টোবর। পরবর্তী এক লাখ রোগী ৫৫ দিনে শনাক্ত হয়ে পাঁচ লাখ রোগী ছাড়ায় গত ২০ ডিসেম্বর। এরপর সংক্রমণের হার কিছুটা নি¤œমুখী হয়। ২৯ মার্চ এসে ছয় লাখ শনাক্ত হয়।
কিন্তু এ বছরের মধ্য-মার্চ থেকেই সংক্রমণ বাড়তে থাকে। ওই সময় এক লাখ শনাক্ত হয় মাত্র ১৬ দিনে। ৫ এপ্রিল সরকার বিধিনিষেধ দিলে সংক্রমণ কমে আসে। পরের এক লাখ শনাক্ত হয় ৪৭ দিনে। ঈদের পর ৮ থেকে ৯ লাখ রোগী হয় ২৯ দিনে (২৯ জুন)। করোনার এখনকার সবচেয়ে দ্রুত সংক্রমণশীল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে এক লাখ রোগী শনাক্ত হতে সময় নিল মাত্র ১০ দিন।
মানুষ কানেই নেয়নি : পাঁচ এপ্রিল থেকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিধিনিষেধ শিথিল হয়ে পড়ে। শহর ছেড়ে অনেকে গ্রামে যায়। যেখানে ছিল না স্বাস্থ্যবিধির বালাই। এ কারণে ঈদের পর সংক্রমণ ভয়াবহ আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
‘গত ঈদে মানুষের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও জনমানুষের স্রোত থামিয়ে রাখা যায়নি। বরং সে সময় মানুষ দলবেঁধে, হেঁটে, গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরেছিল।’ এতেও সংক্রমণ বেড়েছে বলে জানান কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিরোধ করতে পারিনি। যতদূর সমর্থ্য হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশে ঢোকার পর আমরা একে একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব বিধিবিধান মানার প্রয়োজন ছিল, সেসব কথা মানুষ কানেই নেয়নি।’
দেশে শিশুসহ আরও ১৮৫ মৃত্যু, পরীক্ষায় কমেছে শনাক্ত
ট্যাগস :
দেশে শিশুসহ আরও ১৮৫ মৃত্যু
জনপ্রিয় সংবাদ