কৃষি ও কৃষক ডেস্ক : করোনার কারণে টানা দুই বছর লাভের মুখ দেখেননি কৃষকরা। তারা এখন ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার আশায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই মধ্যে গাছ থেকে নামানো শুরু হয়েছে মাদরাজি ও মোজাফফরি লিচু। বেচাকেনাও জমে উঠেছে। লিচুর রাজ্যখ্যাত দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, মাদরাজি, বোম্বাই ও মোজাফফরি আগাম জাতের লিচু আহরণের সময়কাল ২০ মের পর থেকে। বেদানা জাতের লিচু আহরণের সময় জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। আর নাবি জাতের লিচু হচ্ছে চায়না-৩ ও কাঁঠালি। এসব লিচু আহরণের সময় জুনের শেষ সপ্তাহ। এরই মধ্যে গাছে গাছে টসটসে লিচু লাল রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে গাছ থেকে লিচু পাড়া শুরু হয়। পাড়া হচ্ছে মাদরাজি ও মোজাফফরি লিচু। দিনাজপুর গোর-এ শহীদ বড় ময়দানে বসেছে লিচুর অস্থায়ী বাজার।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো: খালেদুর রহমান জানান, গত বছর দিনাজপুর জেলায় পাঁচ হাজার ৪৮১ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ করা হয়। ফলন হয়েছিল ২৮ হাজার মেট্রিকটন। এবার পাঁচ হাজার ৬১০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর লিচু বিক্রি হয়েছে ৫৭৫ কোটি টাকার। এবার তা বেড়ে ৬১৬ কোটি টাকা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
দিনাজপুর সদরের মাশিমপুর ও বিরল উপজেলার মাধবমাটি গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, এই দুই গ্রামে উৎপাদিত মাদরাজি, বেদানা, বোম্বাই, চায়না-৩, কাঁঠালিসহ সব লিচু রসগোল্লা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এরই মধ্যে মাদরাজি ও মোজাফফরি লিচু বাজারে উঠতে শুরু করেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে লিচু পুরোপুরি লাল রং ধারণ করলেই বেদেনা, বোম্বাই লিচু পুরোদমে ভাঙা শুরু হবে। চায়না-৩ ও কাঁঠালি লিচু আসবে সবার পরে।
মাশিমপুর গ্রামের কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কয়েক বছর ধরে লিচুর আবাদ করছি। কিন্তু গত দুই বছর করোনার কারণে লিচুতে কিছুটা লোকসান হয়েছিল। কিন্তু এ বছর ফলন দেখে খুব ভালো লাগছে। এ বছর দামও ভালো পাবো বলে আমি আশা করছি। ’
লিচু ব্যবসায়ী লিটন জানান, দিনাজপুর থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার যানবাহন যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এ ছাড়া কুরিয়ার এবং ট্রেনেও লিচু যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন বাজারে। স্থানীয়ভাবে বেচাকেনা তো আছেই। সব মিলিয়ে প্রতিদিন লিচুর বাজারে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। বোম্বাই, বেদানা ও চায়না-৩ লিচু বাজারে এলে এই লেনদেন ১৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মো: ইয়াসিন আলী জানান, এবার জেলায় ৯২৪ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা সাত হাজার ৮৯৭ মেট্রিকটন। আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে গুরুদাসপুরে ৪১০ হেক্টর জমিতে তিন হাজার ৬৯০ মেট্রিকটন লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, যার বাজারমূল্য ৫৫ কোটি টাকা।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, রাজশাহীতে ৫১৯ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা তিন হাজার ১৪৪ মেট্রিক টন। এসব লিচুর বাজারদর ধরা হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, জেলায় এবার চার হাজার ৭৩১ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় বাণিজ্যিক আকারে বাগান দুই হাজার ৮০০ হেক্টর এবং বিচ্ছিন্নভাবে বসতবাড়িতে ৫৫০ হেক্টরে লিচুর আবাদ হয়েছে। লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ৪০০ মেট্রিকটন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, ঈশ্বরদীতে এবার লিচু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৪ কোটি টাকা। তবে দাম হ্রাস-বৃদ্ধি হলে লক্ষ্যমাত্রাও কম অথবা বেশি হতে পারে।
এদিকে লিচুর মৌসুম শুরু হলেই নাটোরের গুরুদাসপুর, বনপাড়া, আহম্মদপুরসহ পাইকারি বাজারগুলো বেশ জমে ওঠে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইতোমধ্যে গাছ থেকে লিচু নামানো শেষ পর্যায়ে পৌঁছালেও পাইকারি আড়তগুলোতে লিচু স্তূপাকারে রেখে বেচাকেনা চলছে সমান তালে। আর কয়েকদিন পরেই শেষ হবে লিচু বেচাকেনার মৌসুম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার লিচুর উৎপাদন বেশি হলেও আকারে একটু ছোট হয়েছে। তাই দামও অনেকটা কম। গত বছর প্রতি হাজার লিচু রকমভেদে বিক্রি হয়েছে ২,২০০ টাকা থেকে ২,৪০০ টাকায়। সেখানে এবার আড়তগুলোতে পাইকারি দরে প্রতি হাজার লিচু বিক্রি হচ্ছে রকমভেদে ১,২০০ থেকে ১,৭০০ টাকা দরে। অর্থাৎ প্রতি হাজার লিচুতে এবার গড়ে ৫০০ টাকা করে কম দাম পাচ্ছেন কৃষক ও সংশ্লিষ্ট বিক্রেতারা। এতে লিচুচাষিরা আর্থিক বিবেচনায় অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
অপর দিকে কৃষি বিভাগ বলছে, চলতি মৌসুমে নাটোর জেলায় লিচুর উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তাতে কৃষকরা আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হচ্ছেন। তাদের মতে জেলায় মোট লিচুর উৎপাদন হয়েছে সাত হাজার ৮৯৭ মেট্রিকটন। আর কেজি হিসাবে মোট লিচুর উৎপাদন দাঁড়ায় ৭৫ লাখ দুই হাজার ১৫০ কেজি। বাজারদর ৪০০ টাকা হিসাবে যার মূল্য দাঁড়ায় ৩০০ কোটি টাকা।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৯২৪ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। উৎপাদন ধরা হয়েছে সাত হাজার ৮৯৭ মেট্রিকটন বা ৭৫ লাখ দুই হাজার ১৫০ কেজি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় আবাদ হয়েছে ১৬০ হেক্টর ও উৎপাদন হয়েছে এক হাজার ৪২০ মেট্রিকটন, নলডাঙ্গা উপজেলায় আবাদ হয়েছে ১৫ হেক্টর ও উৎপাদন হয়েছে ৯০ মেট্রিকটন, সিংড়া উপজেলায় আবাদ ৯৮ হেক্টর ও উৎপাদন ৭৮৪ মেট্রিকটন, গুরুদাসপুর উপজেলায় আবাদ ৪১০ হেক্টর ও উৎপাদন তিন হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন, বড়াইগ্রাম উপজেলায় আবাদ ৪০ হেক্টর ও উৎপাদন ৩২০ মেট্রিক টন, লালপুর উপজেলায় আবাদ ১০৫ হেক্টর ও উৎপাদন ৮২৫ মেট্রিকটন এবং বাগাতিপাড়া উপজেলায় আবাদ হয়েছে ৯৬ হেক্টর জমিতে ও উৎপাদন হয়েছে ৭৬৮ মেট্রিকটন।
কৃষি বিভাগ জানায়, জেলায় সবচেয়ে বেশি লিচু উৎপাদন হয় গুরুদাসপুর উপজেলায়। গত বছরের চেয়ে এবার সেখানে ১০ হেক্টর বেশি আবাদ হয়েছে। এখানে মোজাফ্ফর, বোম্বে ও চায়না-৩ জাতের লিচু চাষ বেশি হয়ে থাকে। আর এই উপজেলার নাজিরপুরের লিচুর কদরও রয়েছে দেশজুড়ে। এ জন্য এলাকার কানুমোল্লার বড়তলা, ঝাউপাড়া বিন্যাবাড়ি ও বেড়গঙ্গারামপুর মিলে গড়ে উঠেছে ছোট বড় ১৭টি লিচুর আড়ত।
প্রতিদিন এ আড়তগুলো থেকে গড়ে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকার লিচু যায় রাজধানীসহ সারা দেশে। প্রতিদিন বেলা ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এসব আড়তের কর্মকা-। মে মাসের শুরু থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে এসব আড়ত। মৌসুমি এসব আড়তে প্রতিদিন আড়াই শ’ থেকে তিন শ’ জন শ্রমিক কাজ করে টাকা আয় করেন। এছাড়া জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া, আহম্মদপুর, শহরের স্টেশন বাজার, বাগাতিপাড়ার মালঞ্চিসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট বড় আড়ত রয়েছে।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মো: হারুনুর রশীদ বলেন, গুরুদাসপুরে এবার ২০৫টি বাগানে ৪১০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে, যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন হাজার ৬৯০ মেট্রিকটন। এখানকার লিচু সুস্বাদু হওয়ায় বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা কিনে নিয়ে যান এবং রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করেন। এবার গুরুদাসপুর উপজেলা থেকে ১৪০ কোটি ২২ লাখ টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে সরেজমিন গুরুদাসপুরের নাজিরপুর ইউনিয়নের বেড়গঙ্গারামপুর বটতলা লিচুর মোকামে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি হাজার লিচু রকমভেদে ১,২০০ থেকে ১,৭০০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। বাগান থেকে আনা লিচু উন্মুক্ত ডাকে কিনছেন পাইকার-ফড়িয়ারা। কেনা লিচুগুলো আড়তে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। শ্রমিকরা এসব লিচু দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য প্যাকেট করছেন।
এছাড়া সাধারণ ফড়িয়ারা ফলের পসরা সাজিয়ে সড়কের দুই পাশ কিংবা আড়তের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লিচু বিক্রি করছেন। এখানে লিচুর আমদানি বেশি এবং দামে অন্যান্য এলাকার তুলনায় একটু কম হওয়ায় শহর ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে অনেকেই আসছেন লিচু কিনতে।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল আলীম ও সোলায়মান আলী জানান, অনুকূল আবহাওয়া এবং উচ্চ তাপমাত্রায় চলতি মৌসুমে লিচুর ফলন ভালো হয়েছে। তবে আকারে একটু ছোট হওয়ার কারণে এবার দাম একটু কম হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এবার প্রতি হাজারে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কম পাওয়া যাচ্ছে।
তারা আরো জানান, জেলার সবগুলো উপজেলাতে কমবেশি লিচু উৎপাদিত হয়। তবে গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম- এই দুই উপজেলার রয়না ভরট, জালশুকা, জোয়াড়ি, গোয়ালফা, আগ্রান, গুরুদাসপুর, নাজিরপুর, বিয়াঘাট, নারায়ণপুর, বেড়গঙ্গারামপুর ও শাহাপুর কালীনগর এলাকা লিচুগ্রাম নামে খ্যাত। আর আগাম ফলন ও ভালো দাম পাওয়ার আশায় গুরুদাসপুরের নাজিরপুর এলাকায় বেশির ভাগ চাষি মোজাফ্ফর জাতের লিচু বাগান করেছেন। লিচু সুন্দর, মিষ্টি ও সুস্বাদু হওয়ায় চাহিদাও রয়েছে দেশজুড়ে।
স্থানীয় আড়তদার ও মেহেদি ফল ভা-ারের মালিক মো: আব্দুল মান্নান বলেন, লিচুর উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে গুরুদাসপুরে ছোট বড় ১৭টি আড়ত গড়ে উঠেছে। এবারো প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ ট্রাক লিচু যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
তবে এবার লিচুর উৎপাদন বেশি হলেও দাম গত বছরের তুলনায় কম। পাইকার বা ক্রেতাদের আনাগোনাও কম বলে দাবি করেন তিনি। একই কথা জানান আল্লাহর দোয়া ফলভা-ারের মালিক সেলিম হোসেন, ভাই ভাই ফলভা-ারের মালিক বজলুর রশীদ ও আব্দুল গফুর।
ঢাকা থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী আমিনুল ও সোহাগ রানা বলেন, গত ১০ বছর ধরে এসব আড়ত থেকে লিচু কিনে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করছি। এখানকার যাতায়াতব্যবস্থা ভালো। লিচুর রঙ, আকার এবং স্বাদও বেশ ভালো। এখানকার লিচুর বেশ কদর রয়েছে। তাই প্রতি বছরের মতো এবারো লিচু কিনে ঢাকায় পাঠাচ্ছেন। এ পর্যন্ত তারা চার ট্রাক লিচু ঢাকায় পাঠিয়েছেন।
স্থানীয় লিচু আড়ত কমিটির সভাপতি মো: সাখাওয়াত হোসেন বলেন, চলতি মৌসুমে লিচুর হাট ঘিরে ১৭টি আড়তের ইজারামূল্য ডাকা হয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। প্রায় ১৫ বছর ধরে এখানে লিচু বেচাকেনা চলছে। ক্রেতা, বিক্রেতা ও কৃষকদের সার্বিক নিরাপত্তা দেয়া হয়। কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে বিষয়ে আড়ত কমিটির পক্ষ থেকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। পাশাপাশি মৌসুমজুড়ে থানা পুলিশও নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ ড. ইয়াছিন আলী বলেন, এই জেলায় মোজাফ্ফর জাতের লিচুর চাষ বেশি হয়। এ ছাড়া বোম্বে ও চায়না-৩ জাতের লিচু চাষ হয়ে থাকে। এবার লিচুর উৎপাদন বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় দাম কিছুটা কম হলেও উৎপাদন বাড়ায় কৃষকরা লাভবান হবেন। বাগান থেকে লিচু নামানো প্রায় শেষ, বিক্রিও অনেকটা শেষ পর্যায়ে। আশা করা যাচ্ছে, এবার জেলায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে।
রাজশাহীতে আমের রাজ্যে লিচুর আধিপত্য : দেশজুড়ে আমের রাজ্য হিসেবে সুপরিচিত রাজশাহী। এবার মৌসুমের প্রথমদিকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গাছ থেকে ঝরেছে মুকুল, গুটি ও অপরিপক্ক আম। অন্যদিকে লিচুর মৌসুমে অনুকূল আবহাওয়ায় এবছর রাজশাহীতে লিচুর ব্যাপক ফলন হয়েছে। এ কারণে রাজশাহীর হাটে-বাজারে আমের বদলে রঙিন ও রসালো লিচুর আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। গত কয়েকসপ্তাহ যাবত রাজশাহীর সাহেব বাজার, শালবাগান, খড়খড়ি, বানেশ্বর, লক্ষীপুর, কোর্ট বাজার ও রাজশাহীর বাস টার্মিনালের ফল বাজারসহ অন্যান্য হাট-বাজার সরেজমিনে পরিদর্শন করে এমনটাই দেখা গেছে। হাট-বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চলতি মাসের প্রথমদিকে রাজশাহীতে বাজারে ওঠে আঠি জাতের লিচু। এসব আঠি জাতের লিচু আকারে ছোট, তুলনামূলক কম মাংসল ও বিচির আকার বড় হয়ে থাকে। স্বাদের দিক থেকে কিছুটা টক-মিষ্টি। মৌসুমের শুরুতে বাজারে আসায় দামও ছিল বেশ চড়া। মৌসুমের প্রথমে এসব লিচু বাজারভেদে বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। তবে ধীরে ধীরে দাম কমে বিক্রি হতে থাকে ১৮০ থেকে ২২০ টাকায়। তবে চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে উঠতে শুরু করে বোম্বে জাতের সুস্বাদু লিচু। এসব লিচুর আকার বেশ বড় এবং এ জাতের লিচুর বিচিও বেশ ছোট হয়ে থাকে। যার কারণে মাংসল অংশটিও অনেক বেশি। সপ্তাহজুড়ে বাজার ঘুরে দেখা গেছে দামের তারতম্য।
মাগুরায় ৭০ কোটি টাকার লিচু বিক্রির আশা : মাগুরার লিচু বছরের পর বছর ধরে ফলপ্রেমীদের তৃপ্তি মিটিয়ে আসছে। এ জেলার লিচুর খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবছর মাগুরায় লিচুর বাম্পার ফলন ও ন্যায্য দাম পেয়ে খুশি চাষিরা। লিচু সব বয়সীদের মুখরোচক ফল হওয়ায় বিষমুক্ত লিচু সরবরাহে আশা জাগাচ্ছেন মাগুরার চাষিরা।
মাগুরায় লিচু চাষে সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় বিস্তৃর্ণ অঞ্চলজুড়ে শতশত লিচু বাগান করা হয়েছে। এসব লিচু বাগান দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। জেলার সদর উপজেলার হাজরাপুর, ইছাখাদা, মির্জাপুর, হাজিপুর, মিঠাপুর, নড়িহাটি, শিবরামপুর ও শ্রীপুর উপজেলার প্রায় ৪০ গ্রামে হচ্ছে লিচু চাষ। আকারে বড় আর সুস্বাদু হওয়ায় দেশজুড়ে এই লিচুর চাহিদা রয়েছে। লিচু পাকতে শুরু করায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কিনতে আসছেন পাইকাররা। এবছর প্রতি হাজার দেশি লিচু ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা এবং মোজাফ্ফরি ও বোম্বাই ২৫০০ থেকে ২৮০০ টাকা দরে বাগান থেকে পাইকাররা কিনছেন। লিচুর ব্যাপক ফলন হলেও সার কীটনাশক থেকে শুরু করে গাছ থেকে লিচু সংগ্রহ করে পাইকাররা ট্রাক বোঝাই করা পর্যন্ত শ্রমিক খরচ প্রতি বছরের তুলনায় এ বছর দ্বিগুণ হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, এবার জেলায় ৬৩৯ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লিচুর ফলন হয়েছে আশানুরূপ। জেলায় হাজরাপুরী, মোজাফ্ফরী, বোম্বায়, চায়না-৩ সহ বিভিন্ন জাতের লিচুর এবার ভালো ফলন হয়েছে। তবে বাজারে গুঞ্জন আছে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা অপরিপক্ক লিচু খেয়ে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে ফুল আসা থেকে শুরু করে ফল ধারণ ও ফল পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত দেখভাল করছে কৃষি বিভাগ। বিশেষ করে লিচুতে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগের পর অপেক্ষমান সময় মেনে লিচু বাজারজাত করলে সেই লিচুতে কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না, এমন পরামর্শ দিয়ে কৃষকদের উৎসাহিত করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলায় উৎপাদিত লিচু ৭০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন কৃষি বিভাগ। মাগুরা সদরের শিবরামপুরের লিচু চাষি ফেরদৌস আহম্মেদ দিদার জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর তার বাগানে লিচুর ভালো ফলন হয়েছে। তবে সার কীটনাশক বেশি দাম ও চড়া দামে শ্রমিক নেওয়ায় লাভের পরিমাণ কিছুটা কম হচ্ছে।
দেশে লিচুর বাম্পার ফলন
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ