অধ্যক্ষ মো. নাজমুল হুদা : জন্মসূত্রে মানুষের মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। শিক্ষিত অশিক্ষিত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মাঝে দেশপ্রেমের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ইসলামে দেশপ্রেমের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহানবী (সা.) হিজরতের সময় মদিনায় গমনকালে চলার পথে বারে বারে জন্মভূমি মক্কার দিকে তাকাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি আক্ষেপের সুরে বলছিলেন- হে আমার প্রিয় মক্কা ভূমি! যদি ইসলামবিরোধীরা আমার প্রতি অত্যাচার না করতো তাহলে আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। মানুষতো দূরের কথা প্রাণীকূলের মাঝেও কমবেশি জন্মস্থানের প্রতি আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। অথচ একশ্রেণির মানুষ মাতৃভূমির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে না বা মাতৃভূমিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ভালোবাসে না। পৃথিবীতে যে জাতির মাঝে দেশপ্রেম যত বেশি সে জাতি তত বেশি উন্নত। দেশপ্রেমের অভাব হেতু মানুষেরা দেশের সম্পদকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে না।
আমরা জানি, দুর্নীতির অন্যতম কারণ দেশপ্রেমের অভাব। একজন সচেতন মানুষ যেমন কোনোভাবেই তার নিজের সংসারের ক্ষতি সাধিত করতে চায় না, ঠিক তেমনি একজন দেশপ্রেমিক ব্যক্তি কোনো অবস্থাতেই নিজের দেশের অনিষ্ঠ সাধন বা সম্পদের ধ্বংস কামনা করে না। আমরা জানি, সুশৃঙ্খল সংসার গঠনে যেমন পরিবার প্রধান বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, ঠিক তেমনি উন্নত রাষ্ট্র বা জাতি গঠনে জাতীয় নেতৃবৃন্দের আচরণ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সংসার পরিচালনায় সাধারণত পিতামাতা পরিবারের মডেল বা অনুকরণীয় হিসেবে বিবেচিত হন, ঠিক তেমনি দেশ পরিচালনায় বা পুনর্গঠনে জাতীয় নেতৃবৃন্দ মডেল হিসেবে বিবেচিত হন। সাধারণত দেশের আপামর জনসাধারণ তাদের কর্মপরিচালনায় জাতীয় নেতৃবৃন্দকে অনুসরণ করে থাকে। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রসমূহের জাতীয় নেতৃবৃন্দের জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই যে, সে সকল নেতৃবৃন্দ দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে বিবেচিত ছিলেন।
মহাবনী (সা.), খোলাফায়ে রাশেদা ও পূর্ব যুগের অনেক খলিফার চরিত্রে দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ নিদর্শন বিরাজিত ছিল। বর্তমানে আমাদের দেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দের চরিত্রের মাঝে দেশপ্রেমের যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এসকল জাতীয় নেতৃবৃন্দের অনেকেই ব্যক্তি ও পারিবারিক সুবিধার দিকে তাকিয়ে দেশ পরিচালনা করে থাকেন। সে কারণে আমাদের দেশের সাধারণত মানুষের মাঝে এই চেতনা বিরাজ করে যে, সরকারি সম্পদের সুরক্ষার প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শনের তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। সরকারি সম্পদ বিনষ্ট করলে আমার কী ক্ষতি? প্রকৃত পক্ষে সরকারের নিজস্ব কোনো সম্পদ নেই। সরকারের সম্পদ মানেই জনগণের সম্পদ বা দেশের সম্পদ। সে কারণে নিজের সম্পদের থেকে সরকারি সম্পদের গুরুত্ব অনেক বেশি। চেতনার দুর্বলতার কারণে আমাদের দেশে চাকরির ক্ষেত্রে অনেক সময় কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন দফতরে সরকারি সম্পত্তি বা তহবিল তছরুফ বা আত্মসাৎ করে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা কোনো গ্লানি অনুভব করেন না। অথচ সেসকল ব্যক্তির যদি দেশপ্রেমের চেতনা থাকত তাহলে তারা কোনো অবস্থাতেই সরকারি সম্পত্তি তছরুফ করতে পারতেন না।
একটি দেশের ব্যবসা ও শিল্প অর্থনীতির চালিকাশক্তির অন্যতম স্তম্ভ। যেকোনো দেশের ব্যবসা পরিচালনায় ব্যবসায়ীদের মাঝে ও শিল্প প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তাদের মাঝে দেশপ্রেমের চেতনা না থাকলে সে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পে কাক্সিক্ষত মাত্রায় সফলতা অর্জিত হয় না। ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিক্রিয়ায় দেশে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। জনগণের সার্বিক ক্রয়ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে। অপরদিকে রাজনীতি হলো মানব সেবার সর্বত্তম মাধ্যম। রাজনীতির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে জনগণের সেবা করা যায়। মূলত রাজনীতির অর্থই হলো মানবতার সেবা। আমরা জানি, রাজনীতি করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশপ্রেম অর্জন করা। দেশপ্রেমহীন ব্যক্তির দ্বারা কখনো মানবতা ও দেশের সেবা করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে রাজনীতিবিদদের মাঝে প্রচণ্ড দেশ প্রেমের নিদর্শন পাওয়া যায়।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর রাজনীতিবিদরা সর্বতভাবে দেশের জনগণের সার্বিক সেবা করে থাকেন। তারা দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের দেশকে পৃথিবীর সর্বোন্নত দেশে পরিনত করার জন্য সদা সচেষ্ট। বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন কৌশলে তারা বিদেশ হতে সম্পদ আহরণ করে নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। অন্যদিকে আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিবিদ নিজের দেশের সম্পদ বিভিন্নভাবে লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করে বিদেশের অগ্রগতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রেখে চলেছেন। মূলত তাদের নিজেদের দেশের প্রতি ভালোবাসার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যে কারণে আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিবিদ ও ব্যাংক লুটেরা শিল্পপতি দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশের ব্যাংকে অর্থ গচ্ছিত রাখছেন। যে অর্থ দিয়ে পরোক্ষভাবে বিদেশি রাষ্ট্রের অর্তনীতিকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। এসব লুণ্ঠনকারী সম্প্রদায় দেশের অর্থ লুণ্ঠন করে বিদেশে স্বনামে বেনামে বিভিন্ন প্রকার ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যার মাধ্যমে বিদেশিরা উপকৃত হচ্ছে। অপরদিকে আমাদের দেশের অর্থনীতি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। এমনকি এসকল লুণ্ঠনকারী সম্প্রদায় বিদেশ ভূমিতে বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য উন্নতমানের প্রাসাদ বা বাড়ি তৈরি করছেন। উন্নতমানের গাড়ি ক্রয় করে বিদেশের সে সকল বাড়িতে ব্যবহার করছেন।
সবিশেষ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এসব লুণ্ঠনকারী নিজেদের সন্তান সন্ততিদের দেশের আবহে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রদান না করে বিদেশি ধাঁচে শিক্ষা গ্রহণ করাচ্ছেন। এমনকি এসকল লুণ্ঠনকারীর সন্তান সন্ততিরা কালেভদ্রে মাতৃভূমিতে আত্মীয় বাড়িতে বেড়ানোর মতো ঘুরতে আসেন। অথচ এ শ্রেণির মানুষের মাঝ থেকেই আমাদের দেশে অধিকাংশ রাজনীতি বিদের বিকাশ ঘটেছে। আমাদের দেশের অসচেতন জনসাধারণ পূর্বাপর চিন্তা না করে ভালো মন্দ না বুঝে ভোটের মৌসুমে এসকল লুটেরা রাজনীতিবিদের নিকট তাদের ভোটাধিকার বিক্রয় করে থাকেন। প্রতিক্রিয়ায় এসকল রাজনীতিবিদ ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এদেশের রাজনীতি পরিচালনা করে থাকেন। যে কারণে এসকল রাজনীতিবিদের নিকট দেশপ্রেম থেকে নিজের স্বার্থ অর্জন করা সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। আমরা জানি, মহানবী (সা.) বিজাতীয়দের কৃষ্টিকালচার ও আদর্শ পরিহার করে নিজেদের কৃষ্টিকালচার অনুসরণ করতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। মহানবী ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে এমনকি উমাইয়া আব্বাসীয় খেলাফত আমলেও মুসলিম জাতি নিজেস্ব স্বকীয় পদ্ধতিতে দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। উসমানীয় খেলাফতের শেষের দিকে খলিফাগণ ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। যে কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে খেলাফতের নাম নিশানা পৃথিবীতে হতে মুছে যায়।
ব্রিটিশ ভারতের অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা মহনদাস করমচাঁদ গান্ধি দেশ প্রেমের অত্যুজ্বল নিদর্শন ছিলেন। তিনি কোনো অবস্থাতেই বিজাতীয় কোনো দ্রব্য ব্যবহার করতেন না। পারিবারিকভাবে তৈরি এক ধরনের গামছা তিনি পরতেন। খালি গায়ে গলায় একটি পৈতা দিয়ে তিনি পোশাকের প্রয়োজনীয়তা মেটাতেন। বিদেশি জুতার পরিবর্তে তিনি কাঠের পাদুকা বা খড়ম ব্যবহার করতেন। এ ধরনের পোশাক পরেই তিনি ইংল্যান্ডের রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যোগদান করেছিলেন। তিনি দেশপ্রেমে এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লবণ তিনি গ্রহণ করতেন না। লবণাক্ত পানি আগুনে জ্বাল দিয়ে তিনি লবণ তৈরির ব্যবস্থা করেছিলেন।
অনেকে মনে করতে পারেন, বর্তমান যুগে এ ধরনের দৃষ্টান্ত অনুসরণের সুযোগ আছে কি? অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যায়ক্রমে যে সকল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন তা দেশপ্রেমের উদাহরণ। যেমন তিনি আমেরিকার অর্থনৈতিক তহবিলকে শক্তিশালী করার জন্য বিদেশে সাহায্যের অর্থ হ্রাস করেছেন। বিদেশি অভিভাসীদের আমেরিকায় স্থিতি হওয়াকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইন প্রণয়ন করেছেন। যেন তার দেশের মানুষ শ্রমের ক্ষেত্রে অধিক সুবিধা পায়। বিদেশে যুদ্ধরত আমেরিকার সৈন্য বাহিনীকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। বিদেশের যুদ্ধরত রাষ্ট্র যেমন ইউক্রেন ও ইসরায়েলের আর্থিক ও সমরিক সহায়তা তিনি কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপরে শুল্কহার বৃদ্ধি করেছেন। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের জন্য তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিবিদ নিজের দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশকে পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সহায়তা করছেন। আমরা দেশপ্রেমী জনগণ আগামীতে এ ধরনের দেশবিরোধী ব্যক্তি ও শক্তিকে চিহ্নিত করে প্রতিহত করার চেষ্টা করতে পারি। তাহলে দেশের সার্বিক মঙ্গল হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট