ঢাকা ১১:২৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫

দুশ্চিন্তা ও আবেগ যেন আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ না করে

  • আপডেট সময় : ০৮:১৫:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫
  • ১৪ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

শাহানা হুদা রঞ্জনা

দিনকাল এমন হয়েছে যে, মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কারণে দুশ্চিন্তা ও অতিচিন্তা করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। চারদিকের অস্থিরতা মনকেও অস্থির করে তুলেছে। অবশ্য আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন- যারা আগে থেকেই যে কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়েই বেশি ভাবেন, বাড়তি কল্পনা করেন এবং দুশ্চিন্তা মগ্ন হন। আর এই ভাবনাগুলো অধিকাংশই নেতিবাচক অর্থাৎ খারাপ চিন্তা করা। কেউ কোথাও যাত্রা করছে শুনেই তাদের আশঙ্কা হয় ঠিকমতো পৌঁছাবে তো? পথে কোনো ঝামেলা হবে না তো?

কেউ কেউ এমন আছেন যারা তার প্রিয়জনকে বিমানে তুলে দিয়েই ফ্লাইট ট্র্যাকিং করতে শুরু করেন। এই যে বিমানযাত্রা নিয়ে তার অতিরিক্ত চিন্তা সেটিই হলো দুশ্চিন্তার বিপজ্জনক মাত্রা। অন্য কাজের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে এই ট্র্যাকিং করেই তিনি হয়তো ২১-২২ ঘণ্টা পার করে দিলেন।

কেউ কেউ আছেন যারা মিটিং বা কোথাও আড্ডা দেওয়ার পর মনে মনে ভাবতে থাকেন ‘আমি কি ভুল কিছু বলেছি?’ বা ‘আমার কথাটা কি তাদের খারাপ লেগেছে?’ মিটিংয়ে কিছু বলার পর সেই ব্যক্তি নিজেই ভাবতে থাকেন স্যার আমার কথাকে কীভাবে নিলেন? সহকর্মীরা হাসাহাসি করবে না তো? মিটিংয়ে কি আমার এই কথাটা বলা উচিত ছিল? সেখানে তিনি যা বলেছেন অথবা যা বলেননি, সেগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে অহেতুক ভাবতে থাকেন। ভাবতে থাকেন অন্য মানুষ কি তাকে বোরিং বা বিরক্তিকর ভাবছে? এসব ভাবতে গিয়ে তার ভবিষ্যৎ কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যারা কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করেন, বুঝতে হবে, সেই মানুষগুলোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের অক্ষমতা রয়েছে। অথবা তারা মনে করেন তাদের পছন্দ অন্যরা উপেক্ষা করতে পারেন। তাই কোন রেস্তোরাঁয় খেতে যাবেন বা কোন কাপড় কিনবেন, কোথায় বেড়াতে যাওয়াটা ভালো হবে- এসব ইস্যু নিয়ে অনেক বেশি ভাবতে থাকেন। নিজেদের ওপর আস্থাহীনতা থেকেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়; যা খুব ক্ষতিকর ফল বয়ে আনে। তবে চিন্তা করা কোনো নেতিবাচক বিষয় নয়।

যে কোনো কাজ করতে গেলেই মানুষকে ভেবে নিতে হয় কীভাবে কাজটি করবেন, কী কথা বলবেন, কীভাবে যোগাযোগ করবেন। কাজের আগে ও পরে একটা পরিকল্পনা দরকার হয়। কিন্তু অবশ্যই তা ‘অতি চিন্তা’ নয়। অতিরিক্ত চিন্তা করাটা অবশ্যই নেতিবাচক।

‘অতি চিন্তা’ বলতে মূলত বোঝায় কোন নির্দিষ্ট বিষয় বা পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক বেশি চিন্তা করা এবং দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্লেষণ করা। এরপর সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট করা। কেউ যখন যে কোনো বিষয়ে বাড়াবাড়ি রকমের চিন্তা করেন, তখন বুঝতে হবে তিনি আর অন্য কোনো কিছুতেই প্রয়োজনীয় চিন্তা করতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, অতি চিন্তা দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি ও অবসাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ‘বেশি চিন্তা’ করাটা মন আর শরীরের মধ্যে তৈরি করে ভারসাম্যহীনতা।

মানসিক অশান্তির অন্যতম কারণ হলো বর্তমানকে বাদ দিয়ে অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি বেশি ভাবা। মানুষ অহেতুক যতো বেশি চিন্তার পরিধি বাড়াবে, ততই জীবনে ঝামেলা বাড়বে। অতিরিক্ত চিন্তা করাটা কারো কারো অভ্যাসে পরিণত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অহেতুক দুশ্চিন্তা অনেকটা চক্রের মতো। যতই তাড়াতে চাইবেন, ততই আপনাকে জেঁকে ধরবে। একপর্যায়ে এটা মানসিক সমস্যার লক্ষণও হতে পারে।

কথায় আছে ‘অলস মস্তিষ্ক অদ্ভুত খেয়ালের লীলাভূমি’। মস্তিষ্ককে অলসভাবে বসিয়ে রাখা যাবে না। তাহলেই পড়ে যেতে হবে সন্দেহ ও অতিচিন্তার সেই ‘ব্ল্যাকহোলে’। আমাদের কাজ করতে হবে, বই পড়তে হবে, সিনেমা দেখে বা ঘুরে বেড়িয়ে নিজের মনোযোগ সচল রাখতে হবে; যেন কোনো নির্দিষ্ট একটা বিষয়ে বেশি ভাবনা চিন্তা না করে, নানাদিকে মনোসংযোগ করা যায়। বেশি চিন্তা মানুষের শারীরিক সমস্যাও সৃষ্টি করে। যেমন- ঘুমের সমস্যা, মাথাব্যথা, পেট খারাপ ইত্যাদি হতে পারে।

জীবনে ঠিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য ও সুস্থ থাকার জন্য অনেক সমস্যা বা সমস্যার নানান দিক নিয়ে না ভেবে, সুনির্দিষ্ট সমস্যা চিহ্নিত করে আমাদের ভাবতে হবে। অতিরিক্ত চিন্তা বা দুশ্চিন্তা যদি আমাদের প্রতিদিনকার জীবনকে প্রভাবিত করতে শুরু করে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

আমরা কেউ কেউ মানুষের কথা বা মন্তব্য নিয়ে ভেবে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করি এবং মানুষের সাধারণ কথাকেও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি। এতে আমাদের সময় ও এনার্জি দুই নষ্ট হয়। মন খারাপ হয়, আমরা বিষণ্ন বোধ করি। ভবিষ্যৎ, চাকরি, সংসার, প্রেম ও সম্পর্ক নিয়ে মানুষের এ রকম উৎকণ্ঠার শেষ নেই।

ওই অতি চিন্তা থেকে মনে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে। এই ধরনের চিন্তা প্রায়শই বাস্তব পরিস্থিতির চেয়ে বেশি হারে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করে। কেউ কেউ নিজের ছোটখাটো ভুল বা বদভ্যাস নিয়ে এত বেশি মুষড়ে পড়েন যে তার চিন্তাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি ধ্যান করার সময়ও চিন্তা জগৎ এলোমেলো হয়ে যায়।

আমরা লক্ষ্য করেছি অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা দ্বিধা এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে, যা জীবনকে প্রয়োজনের চাইতে জটিল করে তোলে। মানুষ ক্রমাগত সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে, সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় থাকে, সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা মানুষকে আটকে ফেলে এবং পিছিয়ে থাকার অনুভূতি দেয়।

নিজের মেজাজ যদি অন্যদের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে, তাহলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে, আর বিপদও দেখা দেয় তখুনই। গত কয়েক দশকে গবেষণায় দেখা গেছে যে, অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে।

মানুষ বিভিন্ন কারণে অতিরিক্ত চিন্তা করে; যা মনস্তাত্ত্বিক, জৈবিক ও পরিবেশগত সমন্বয়ের কারণে ঘটে। তবে গবেষণা বলে, অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা মস্তিষ্কে ডোপামিনের কার্যকারিতার সঙ্গে সম্পর্কিত। ডোপামিন একটি নিউরোট্রান্সমিটার; যা মানুষের শরীর তৈরি করে। এটি মানুষের মনে আনন্দ, অনুপ্রেরণা ও সন্তুষ্টির অনুভূতি তৈরি করে। মানুষ যখন কিছু অর্জন করে, তখন মস্তিষ্কে ডোপামিন আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে। এটি মস্তিষ্কের চারটি রাসায়নিকের মধ্যে একটি; যা মানুষের ইতিবাচক বা ‘ভালো বোধ’কে চালিত করে।

ডোপামিন কমে গেলে বা খুব বেড়ে যাওয়ার সাথে বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়া এবং সাইকোসিসসহ কিছু মানসিক রোগ যুক্ত। অত্যধিক ডোপামিন থাকা আক্রমণাত্মক হওয়া এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা হওয়ার সাথে যুক্ত। ডোপামিনের ভারসাম্যহীনতাও এডিএইচডি এবং আসক্তির সাথে সম্পর্কিত।

ডোপামিনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে মানুষ তাৎক্ষণিক সুখের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া, বিনোদন বা অন্য এডিকশনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই বিভ্রান্তি এমন একটি চক্র তৈরি করে, যেখানে প্রকৃত সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে মন অন্য সমস্যার দিকে সাড়া দেয়।

একাধিক গবেষণা বলছে, পুরুষরা নারীদের তুলনায় অতিরিক্ত চিন্তা করেন। সাংসারিক, পারিবারিক ও সামাজিক নানা চাপ, সন্তানের পড়াশোনা, কর্মস্থলের চাপ এগুলো নিয়ে ছেলেরা অতিরিক্ত চিন্তা করেন। এ ছাড়া অর্থসংকটে ভুগলে দুশ্চিন্তার মাত্রা যায় বেড়ে। ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী পুরুষরা একই বিষয়ে নেতিবাচক চিন্তা বারবার করেন। পুরুষদের এই অতিরিক্ত চিন্তার জন্য ভবিষ্যতে ভয়ংকর মূল্য দিতে হয়। অনেক সময় পুরুষ আত্মহত্যাও করতে পারেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ফিচারে দেখলাম চিকিৎসকরা মনে করেন, ‘ডোপামিন ডিটক্স’ মানুষকে অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তি দিতে পারে। মানুষের ব্রেইনের এই অতিচিন্তার প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন ধরনের কৌশল প্রয়োগ করে ঠিক করা সম্ভব। এই ডোপামিন ডিটক্স হলো এমন একটি প্রক্রিয়া; যেখানে কিছু সময়ের জন্য একই কাজ বা চিন্তা থেকে বিরত রাখা হয়। ফলে ডোপামিন হরমোন নিঃসারিত হয়ে আনন্দ বা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে আসক্তি কমানো এবং মনোযোগ ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।

ডোপামিন ডিটক্সতো কোনো ওষুধ নয়, কিছু সাধারণ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিগুলো হচ্ছে কাজের বাইরে অন্য বিনোদনমূলক কাজের সাথে যুক্ত হওয়া, গান শোনা, বেড়ানো, গল্প করা, মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানো, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা, গভীর নিশ্বাস নেওয়া, ধ্যান করা, শরীরচর্চা করা। ডোপামিন ডিটক্স মানসিক স্বচ্ছতা, মনোযোগ এবং অনুপ্রেরণা বাড়াতে সাহায্য করে।

ডোপামিন ডিটক্সের মূল লক্ষ্য হলো যে কোনো ধরনের আসক্তি থেকে মুক্তি দেওয়া। এই যে অতিচিন্তা, এটাও একধরনের আসক্তি। তাই অহেতুক ছোটখাটো যে কোনো সমস্যা বা চিন্তায় মনোযোগ না দিয়ে, সমাধানের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। বারবার একই বিষয়ে চিন্তা করাই হচ্ছে অহেতুক দুশ্চিন্তার লক্ষণ। চাপের মধ্যে থেকে মানুষ বিভিন্ন কারণে দুশ্চিন্তা করতে পারেন। শুধু লক্ষ রাখতে হবে যেন আবেগ ও দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। দুশ্চিন্তা ও আবেগ যেন আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ না করে।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দুশ্চিন্তা ও আবেগ যেন আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ না করে

আপডেট সময় : ০৮:১৫:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫

শাহানা হুদা রঞ্জনা

দিনকাল এমন হয়েছে যে, মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কারণে দুশ্চিন্তা ও অতিচিন্তা করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। চারদিকের অস্থিরতা মনকেও অস্থির করে তুলেছে। অবশ্য আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন- যারা আগে থেকেই যে কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়েই বেশি ভাবেন, বাড়তি কল্পনা করেন এবং দুশ্চিন্তা মগ্ন হন। আর এই ভাবনাগুলো অধিকাংশই নেতিবাচক অর্থাৎ খারাপ চিন্তা করা। কেউ কোথাও যাত্রা করছে শুনেই তাদের আশঙ্কা হয় ঠিকমতো পৌঁছাবে তো? পথে কোনো ঝামেলা হবে না তো?

কেউ কেউ এমন আছেন যারা তার প্রিয়জনকে বিমানে তুলে দিয়েই ফ্লাইট ট্র্যাকিং করতে শুরু করেন। এই যে বিমানযাত্রা নিয়ে তার অতিরিক্ত চিন্তা সেটিই হলো দুশ্চিন্তার বিপজ্জনক মাত্রা। অন্য কাজের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে এই ট্র্যাকিং করেই তিনি হয়তো ২১-২২ ঘণ্টা পার করে দিলেন।

কেউ কেউ আছেন যারা মিটিং বা কোথাও আড্ডা দেওয়ার পর মনে মনে ভাবতে থাকেন ‘আমি কি ভুল কিছু বলেছি?’ বা ‘আমার কথাটা কি তাদের খারাপ লেগেছে?’ মিটিংয়ে কিছু বলার পর সেই ব্যক্তি নিজেই ভাবতে থাকেন স্যার আমার কথাকে কীভাবে নিলেন? সহকর্মীরা হাসাহাসি করবে না তো? মিটিংয়ে কি আমার এই কথাটা বলা উচিত ছিল? সেখানে তিনি যা বলেছেন অথবা যা বলেননি, সেগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে অহেতুক ভাবতে থাকেন। ভাবতে থাকেন অন্য মানুষ কি তাকে বোরিং বা বিরক্তিকর ভাবছে? এসব ভাবতে গিয়ে তার ভবিষ্যৎ কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যারা কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করেন, বুঝতে হবে, সেই মানুষগুলোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের অক্ষমতা রয়েছে। অথবা তারা মনে করেন তাদের পছন্দ অন্যরা উপেক্ষা করতে পারেন। তাই কোন রেস্তোরাঁয় খেতে যাবেন বা কোন কাপড় কিনবেন, কোথায় বেড়াতে যাওয়াটা ভালো হবে- এসব ইস্যু নিয়ে অনেক বেশি ভাবতে থাকেন। নিজেদের ওপর আস্থাহীনতা থেকেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়; যা খুব ক্ষতিকর ফল বয়ে আনে। তবে চিন্তা করা কোনো নেতিবাচক বিষয় নয়।

যে কোনো কাজ করতে গেলেই মানুষকে ভেবে নিতে হয় কীভাবে কাজটি করবেন, কী কথা বলবেন, কীভাবে যোগাযোগ করবেন। কাজের আগে ও পরে একটা পরিকল্পনা দরকার হয়। কিন্তু অবশ্যই তা ‘অতি চিন্তা’ নয়। অতিরিক্ত চিন্তা করাটা অবশ্যই নেতিবাচক।

‘অতি চিন্তা’ বলতে মূলত বোঝায় কোন নির্দিষ্ট বিষয় বা পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক বেশি চিন্তা করা এবং দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্লেষণ করা। এরপর সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট করা। কেউ যখন যে কোনো বিষয়ে বাড়াবাড়ি রকমের চিন্তা করেন, তখন বুঝতে হবে তিনি আর অন্য কোনো কিছুতেই প্রয়োজনীয় চিন্তা করতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, অতি চিন্তা দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি ও অবসাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ‘বেশি চিন্তা’ করাটা মন আর শরীরের মধ্যে তৈরি করে ভারসাম্যহীনতা।

মানসিক অশান্তির অন্যতম কারণ হলো বর্তমানকে বাদ দিয়ে অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি বেশি ভাবা। মানুষ অহেতুক যতো বেশি চিন্তার পরিধি বাড়াবে, ততই জীবনে ঝামেলা বাড়বে। অতিরিক্ত চিন্তা করাটা কারো কারো অভ্যাসে পরিণত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অহেতুক দুশ্চিন্তা অনেকটা চক্রের মতো। যতই তাড়াতে চাইবেন, ততই আপনাকে জেঁকে ধরবে। একপর্যায়ে এটা মানসিক সমস্যার লক্ষণও হতে পারে।

কথায় আছে ‘অলস মস্তিষ্ক অদ্ভুত খেয়ালের লীলাভূমি’। মস্তিষ্ককে অলসভাবে বসিয়ে রাখা যাবে না। তাহলেই পড়ে যেতে হবে সন্দেহ ও অতিচিন্তার সেই ‘ব্ল্যাকহোলে’। আমাদের কাজ করতে হবে, বই পড়তে হবে, সিনেমা দেখে বা ঘুরে বেড়িয়ে নিজের মনোযোগ সচল রাখতে হবে; যেন কোনো নির্দিষ্ট একটা বিষয়ে বেশি ভাবনা চিন্তা না করে, নানাদিকে মনোসংযোগ করা যায়। বেশি চিন্তা মানুষের শারীরিক সমস্যাও সৃষ্টি করে। যেমন- ঘুমের সমস্যা, মাথাব্যথা, পেট খারাপ ইত্যাদি হতে পারে।

জীবনে ঠিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য ও সুস্থ থাকার জন্য অনেক সমস্যা বা সমস্যার নানান দিক নিয়ে না ভেবে, সুনির্দিষ্ট সমস্যা চিহ্নিত করে আমাদের ভাবতে হবে। অতিরিক্ত চিন্তা বা দুশ্চিন্তা যদি আমাদের প্রতিদিনকার জীবনকে প্রভাবিত করতে শুরু করে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

আমরা কেউ কেউ মানুষের কথা বা মন্তব্য নিয়ে ভেবে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করি এবং মানুষের সাধারণ কথাকেও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি। এতে আমাদের সময় ও এনার্জি দুই নষ্ট হয়। মন খারাপ হয়, আমরা বিষণ্ন বোধ করি। ভবিষ্যৎ, চাকরি, সংসার, প্রেম ও সম্পর্ক নিয়ে মানুষের এ রকম উৎকণ্ঠার শেষ নেই।

ওই অতি চিন্তা থেকে মনে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে। এই ধরনের চিন্তা প্রায়শই বাস্তব পরিস্থিতির চেয়ে বেশি হারে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করে। কেউ কেউ নিজের ছোটখাটো ভুল বা বদভ্যাস নিয়ে এত বেশি মুষড়ে পড়েন যে তার চিন্তাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি ধ্যান করার সময়ও চিন্তা জগৎ এলোমেলো হয়ে যায়।

আমরা লক্ষ্য করেছি অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা দ্বিধা এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে, যা জীবনকে প্রয়োজনের চাইতে জটিল করে তোলে। মানুষ ক্রমাগত সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে, সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় থাকে, সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা মানুষকে আটকে ফেলে এবং পিছিয়ে থাকার অনুভূতি দেয়।

নিজের মেজাজ যদি অন্যদের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে, তাহলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে, আর বিপদও দেখা দেয় তখুনই। গত কয়েক দশকে গবেষণায় দেখা গেছে যে, অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে।

মানুষ বিভিন্ন কারণে অতিরিক্ত চিন্তা করে; যা মনস্তাত্ত্বিক, জৈবিক ও পরিবেশগত সমন্বয়ের কারণে ঘটে। তবে গবেষণা বলে, অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা মস্তিষ্কে ডোপামিনের কার্যকারিতার সঙ্গে সম্পর্কিত। ডোপামিন একটি নিউরোট্রান্সমিটার; যা মানুষের শরীর তৈরি করে। এটি মানুষের মনে আনন্দ, অনুপ্রেরণা ও সন্তুষ্টির অনুভূতি তৈরি করে। মানুষ যখন কিছু অর্জন করে, তখন মস্তিষ্কে ডোপামিন আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে। এটি মস্তিষ্কের চারটি রাসায়নিকের মধ্যে একটি; যা মানুষের ইতিবাচক বা ‘ভালো বোধ’কে চালিত করে।

ডোপামিন কমে গেলে বা খুব বেড়ে যাওয়ার সাথে বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়া এবং সাইকোসিসসহ কিছু মানসিক রোগ যুক্ত। অত্যধিক ডোপামিন থাকা আক্রমণাত্মক হওয়া এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা হওয়ার সাথে যুক্ত। ডোপামিনের ভারসাম্যহীনতাও এডিএইচডি এবং আসক্তির সাথে সম্পর্কিত।

ডোপামিনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে মানুষ তাৎক্ষণিক সুখের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া, বিনোদন বা অন্য এডিকশনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই বিভ্রান্তি এমন একটি চক্র তৈরি করে, যেখানে প্রকৃত সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে মন অন্য সমস্যার দিকে সাড়া দেয়।

একাধিক গবেষণা বলছে, পুরুষরা নারীদের তুলনায় অতিরিক্ত চিন্তা করেন। সাংসারিক, পারিবারিক ও সামাজিক নানা চাপ, সন্তানের পড়াশোনা, কর্মস্থলের চাপ এগুলো নিয়ে ছেলেরা অতিরিক্ত চিন্তা করেন। এ ছাড়া অর্থসংকটে ভুগলে দুশ্চিন্তার মাত্রা যায় বেড়ে। ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী পুরুষরা একই বিষয়ে নেতিবাচক চিন্তা বারবার করেন। পুরুষদের এই অতিরিক্ত চিন্তার জন্য ভবিষ্যতে ভয়ংকর মূল্য দিতে হয়। অনেক সময় পুরুষ আত্মহত্যাও করতে পারেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ফিচারে দেখলাম চিকিৎসকরা মনে করেন, ‘ডোপামিন ডিটক্স’ মানুষকে অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তি দিতে পারে। মানুষের ব্রেইনের এই অতিচিন্তার প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন ধরনের কৌশল প্রয়োগ করে ঠিক করা সম্ভব। এই ডোপামিন ডিটক্স হলো এমন একটি প্রক্রিয়া; যেখানে কিছু সময়ের জন্য একই কাজ বা চিন্তা থেকে বিরত রাখা হয়। ফলে ডোপামিন হরমোন নিঃসারিত হয়ে আনন্দ বা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে আসক্তি কমানো এবং মনোযোগ ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।

ডোপামিন ডিটক্সতো কোনো ওষুধ নয়, কিছু সাধারণ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিগুলো হচ্ছে কাজের বাইরে অন্য বিনোদনমূলক কাজের সাথে যুক্ত হওয়া, গান শোনা, বেড়ানো, গল্প করা, মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানো, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা, গভীর নিশ্বাস নেওয়া, ধ্যান করা, শরীরচর্চা করা। ডোপামিন ডিটক্স মানসিক স্বচ্ছতা, মনোযোগ এবং অনুপ্রেরণা বাড়াতে সাহায্য করে।

ডোপামিন ডিটক্সের মূল লক্ষ্য হলো যে কোনো ধরনের আসক্তি থেকে মুক্তি দেওয়া। এই যে অতিচিন্তা, এটাও একধরনের আসক্তি। তাই অহেতুক ছোটখাটো যে কোনো সমস্যা বা চিন্তায় মনোযোগ না দিয়ে, সমাধানের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। বারবার একই বিষয়ে চিন্তা করাই হচ্ছে অহেতুক দুশ্চিন্তার লক্ষণ। চাপের মধ্যে থেকে মানুষ বিভিন্ন কারণে দুশ্চিন্তা করতে পারেন। শুধু লক্ষ রাখতে হবে যেন আবেগ ও দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। দুশ্চিন্তা ও আবেগ যেন আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ না করে।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ