তুষার আবদুল্লাহ : হলফ করে আমরা বলতে পারি, শহীদ রমিজ উদ্দীন স্কুল এন্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে, সারাদেশে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল বা ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই আন্দোলনের কিন্তু শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, বৃহত্তর অর্থে জনগণকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর উদ্দেশ্য ছিল না। যেভাবে পরিবহন চালক ও শ্রমিকরা পথে বেপরোয়া উঠেছিল, তার প্রতিবাদ করা এবং তাদের আইনের আওতায় আনা, সড়কে ট্রাফিক বাস্তবায়নই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। কিশোর কিশোরীদের সেই আন্দোলনকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক রঙ মেশাতে দেখলাম। সকল উদ্যান থেকেই যারা ফল কুড়াতে ভালোবাসে, তারা নেমে পড়লো এবং একটি সুন্দর আন্দোলনের হিংস্র সমাপনী আমরা দেখতে পেলাম। যে কারণে সড়কে পরিবহনের বেপরোয়া আচরণ কমেনি, বরং বেড়ে যায়। বেসরকারি শিক্ষার্থীদের নো-ভ্যাট আন্দোলন, কোটা আন্দোলনের পরিণতিও এমন করুণ। আমরা যদি গণজাগরণ মঞ্চের দিকে ফিরে তাকাই, দেখবো তার শুরুটা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীর উপযুক্ত বিচারের দাবিতে। পরে সেই মঞ্চ চলে আস্তিক ও নাস্তিকতার আন্দোলন ও রাজনৈতিক পক্ষ বিপক্ষের দখল লড়াই শুরু হয়ে যায় সেখানে। দেশের নাগরিক মাত্রই যে কোন অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়া বা অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার মত দিতে পারেন। প্রতিবাদ করতে পারেন। সরকারে দৃষ্টি কাড়তে, সরকারকে সক্রিয় করতে কোন কর্মসূচি নিতেই পারেন নিয়মতান্ত্রিক ভাবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে নাগরিকের সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ছে। অনিয়মের দিকে সরকারের নজর ফেরানোও সুনাগরিকের দায়িত্ব। কিন্তু সাধারণ ভাবে সকল সরকারের সময়েই আমরা দেখি যে কোন মৌলিক অধিকারের দাবির সময়ে এই তকমা দেওয়া হয় যে, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এই দাবি তোলা হয়েছে। এই তকমায় সীলমোহর বসিয়ে দিতে কার্পণ্য করে না বিরোধী রাজনৈতিক দল। নিজেরা নাগরিকদের দাবি নিয়ে পথে নামতে বরাবরই ব্যর্থ। কিন্তু নাগরিকেরা যখন নিজেরা মাঠে নেমে পড়ে, তখন ফসল তুলতে কুলা হাতে নামতে তারা ভুল করেন না। তখন দাবি, আন্দোলনের পরিণতি বুমেরাং অস্ত্র হয়ে নাগরিকদের বুকেই বিঁধে ।
সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকের সঙ্গে যে আচরণ হয়েছে সেটা দুঃখজনক। আমলা এবং সরকারের গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাই বলেছেন, ঘটনার রাতেই বিষয়টি মীমাংসা করে নেওয়া যেতো। মীমাংসা হয়নি। ঘটনাটি কাশিমপুর পর্যন্ত গড়িয়েছে । প্রতিবাদে গণমাধ্যমকর্মীরা সারাদেশেই সোচ্চার। গণমাধ্যমের সকল সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিভাজন থাকায় জোট বদ্ধ হতে না পারলেও, প্রতিবাদ এসেছে সকল দিক থেকেই । কিন্তু দিন যতো গড়াচ্ছে এই ঘটনা ও প্রতিবাদকে রাজনীতির চোখে দেখা গাঢ় হতে শুরু করেছে । বলা হচ্ছে সাংবাদিক ও সরকারকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র এটি। সাংবাদিকরা কখনওই কোন সরকারের মুখোমুখি অবস্থান নিতে পারে না। তাঁরা সরকারের সহযোগী। সরকারের ভুল ধরিয়ে দেওয়া, সরকারকে কোন দিকে কখন বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার, সাংবাদিকরা বরাবর সেই বিষয়ে কাজ করে যায়। কিন্তু এই কাজটি সহজ চোখে দেখা হয় না। এখন সাংবাদিকরা রোজিনা ইসলামের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহারের দাবির পাশাপাশি, স্বাভাবিক সাংবাদিকতা করার দাবি তুলেছেন। আমরা বলছি- সাংবাদিকতা অপরাধ নয়। কিন্তু সাংবাদিকতাকে অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র জয়ী হলে সাংবাদিকতা কঠিন হবে সহজ হবে দুর্নীতি। কোন কল্যাণ রাষ্ট্র বা জনবান্ধব সরকার, সাংবাদিকতাকে কঠিন করতে চাইতে পারে না। আমরা তাই বিশ্বাস রাখতে চাই সচিবালয়ের ঘটনাকে, যারা রঙধনুর সাত রঙ দিতে চাইছে, তাদের বিষয়ে সরকার সতর্ক থাকবেন। এবং দেশে স্বাভাবিক সাংবাদিকতার পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখতে উদার হবেন, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বার্থে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।