প্রত্যাশা ডেস্ক: দীর্ঘস্থায়ী সংস্কার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের মার্চ-২০২৫ অধিবেশনে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা উচিত বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সকালে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন এবং জবাবদিহির সূচনা করেছে। কিন্তু স্বেচ্ছাচারী গ্রেফতার ও প্রতিশোধমূলক সহিংসতার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতিগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সীমিত। তারা চলে যাওয়ার পরও দীর্ঘস্থায়ী সংস্কার নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের মার্চ-২০২৫ অধিবেশনে সরকারের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা উচিত। এইচআরডব্লিউর মতে, বাংলাদেশে পুলিশ প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা খাতের সংস্কারে উন্নয়ন সহযোগিদের বিনিয়োগ করা উচিত।
এইচআরডব্লিউর এশিয়া ডিরেক্টর ইলেইন পিয়ারসন বলেন, ‘অধিকারকে সম্মান জানানোর জন্য ভবিষ্যত গড়ে তোলার এক যুগান্তকারী সুযোগের সূচনা করে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রায় ১ হাজার বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এই জয় এবং অগ্রগতি হারিয়ে যেতে পারে যদি অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত ও কাঠামোগত সংস্কার তৈরি না করে।’
এইচআরডব্লিউর সুপারিশগুলি বাংলাদেশে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০ বছরেরও বেশি গবেষণা এবং ডকুমেন্টেশনের পাশাপাশি মানবাধিকার কর্মী, অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য এবং বর্তমান ও সাবেক আইন প্রয়োগকারী এবং সামরিক কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের আগে এইচআরডব্লিউর এশিয়া ডিরেক্টর এবং মূল প্রতিবেদনকারী জুলিয়া ব্লেকনার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ওই আলোচনায় তিনি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে দেওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার মতে এর ফলে জনগণ তাদের ইচ্ছামতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না।
জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, ‘জনগণ যদি মনে করে আওয়ামী লীগ খারাপ, তবে তারা ভোট দেবে না। কিন্তু রাজনৈতিক দলকে ভোটে অংশ নিতে না দেওয়াটা উদ্বেগজনক।’
এদিকে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার বিদায়ের কয়েকদিন পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আগে সংস্কার বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে ইউনূসের নেতৃত্বে একটি কমিশন নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতিবিরোধী অফিস এবং সংবিধানে সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত ছয়টি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সংস্কার বাস্তবায়ন শুরু করবে।
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহারের একটি প্যাটার্ন দেখা দিয়েছে। এবার তারা সাংবাদিকসহ আওয়ামী লীগের সাবেক সমর্থকদের লক্ষ্যবস্তু করেছে। পুলিশ আবার নির্বিচারে লোকেদের আটক করছে এবং অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করছে, যা পুলিশকে কার্যত যে কাউকে গ্রেফতারের জন্য ভয় দেখানো এবং হুমকি দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে প্রথম দুই মাসে হত্যা, দুর্নীতি বা অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে কয়েক হাজার মানুষের বিরুদ্ধে, প্রধানত আওয়ামী লীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে এক হাজারের বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের চার শতাধিক মন্ত্রী ও নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে অপব্যবহারের জন্য যাদের দায়িত্ব রয়েছে, তাদের জবাবদিহি করতে হবে। পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়া ব্যাপক অভিযোগ ন্যায়বিচারকে দুর্বল করে। জুলাই-আগস্টে নিহত দুই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, আওয়ামী লীগের বিরোধিতাকারী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা পুলিশ প্রতিবেদনে তাদের স্বাক্ষর করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা নিশ্চিত ছিলেন না কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন।
হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণের অভিযোগ রয়েছে এবং পুলিশ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হচ্ছে। নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের করা হয়।
সরকারের উচিত, জাতীয় তদন্ত কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) বিলুপ্ত করার জন্য কাজ করা। সংস্থাটি অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন এবং জোরপূর্বক গুমের জন্য দায়ী। প্রতিবেদনের অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়ায়, র্যাব প্রধান এ কে এম শহীদুর রহমান ইউনিটের গোপন আটক কেন্দ্রের কথা স্বীকার করেন এবং বলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকার ইউনিটটি ভেঙে দিতে চাইলে র্যাব সেটি মেনে নেবে।