নেত্রকোনা সংবাদদাতা: সুদের টাকা দিতে না পারায় চেক ডিজঅনার মামলায় কারাগারে শিরিন আক্তার। সন্তানদের নিয়ে বিপাকে স্বামী মিল্টন মিয়া
নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় সমিতির নামে এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। সুদে-আসলে জমা টাকা পরিশোধ করতে না পেরে কেউ জেলে, আবার কারো গ্রাম ছাড়ার ঘটনাও ঘটেছে।
দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চললেও এ ব্যাপারে প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা, উপজেলা প্রশাসন ও কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাদন ব্যবসাকে কেন্দ্র করে কেন্দুয়া উপজেলার সান্দিকোনা বাজারে একটি নামসর্বস্ব সমিতি গড়ে উঠেছে। ওই সমিতির প্রধান সান্দিকোনা গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল আলম। গত কয়েক বছর ধরে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্ল্যাংক চেক বন্ধক নিয়ে দাদন ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পরিশোধ করতে না পারায় অনেকেই বিপাকে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। রফিকুলের অভিনব ফাঁদের দাদন ব্যবসায় বাদ পড়ছেন না তার আত্মীয়-স্বজনও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চার বছর আগে পারিবারিক প্রয়োজনে মামুদপুর গ্রামের বাসিন্দা মিল্টন মিয়ার স্ত্রী শিরিন আক্তার তার ভগিনীপতি রফিকুল আলমের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ নেন। ওই সময় রফিকুল শিরিনের কাছ থেকে স্বাক্ষরিত দুটি খালি চেকের পাতা নেন। কিছুদিন পর শিরিন ৬০ হাজার টাকা ফেরত দেন।
শিরিনের স্বামী মিল্টনের অভিযোগ, বাকি ৯০ হাজার টাকা ও চাহিদামতো সুদের টাকা দিতে না পারায় রফিকুল চেকটিতে ২১ লাখ টাকা লিখে চেক ডিজঅনার মামলা করেন। এছাড়া রফিকুল তার ছোট শ্যালিকা আইরিন আক্তারকে দিয়ে অপর একটি চেকে ২০ লাখ টাকার অঙ্ক বসিয়ে চেক ডিজঅনার মামলা করান। ওই মামলায় আদালত গত ৩০ সেপ্টেম্বর শিরিনকে এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
পরিবারের লোকজন জানান, শিরিন জেলে থাকায় তার প্রতিবন্ধী দুই ছেলেকে একটি ঘরের বারান্দায় আবদ্ধ করে রাখতে হচ্ছে। এছাড়া অপর তিন বছর ও পাঁচ বছরের দুই শিশুকে নিয়ে বিপাকে পড়ছেন শিরিনের স্বামী মিল্টন।
সম্প্রতি শিরিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, একটি আধপাকা ঘরের বারান্দায় তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে দুই প্রতিবন্ধী শিশুকে। আর অপর দুই শিশুকে বাবা মিল্টন গোসল করাচ্ছেন।
মিল্টন মিয়া বলেন, রফিকুল আলম চেক ডিজঅনারের ঘটনা সাজিয়ে শ্যালিকা আইরিনকে দিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন। শিরিনরা এক ভাই ও চার বোন। তাদের বাবা মারা যাওয়ায় সম্পত্তি বৃদ্ধ মা ও মানসিক ভারসাম্যহীন ভাইকে না দিয়ে বোনদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন রফিক। কিন্তু শিরিন তা মেনে না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে চেক ডিজঅনার মামলা করে দেন। তিনি এখন কারাগারে থাকায় প্রতিবন্ধী সন্তানদের নিয়ে খুবই কষ্টে আছি। আমি ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি।
শিরিনের বৃদ্ধা মা তাহেরা আক্তার (৭৮) কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার শিরিনকে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো হয়েছে। সে এত টাকা নেয়নি। আমার অন্য দুই মেয়ে সম্পত্তির লোভে পড়ে এ মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করছে। শিরিন জেলে থাকায় তার প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের কষ্ট হচ্ছে।
শুধু শিরিন নন, রফিকের সুদের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় একই গ্রামের শিবলী আক্তার (২৫) নামের এক নারী গত চার বছর ধরে গ্রাম ছেড়েছেন। মামলায় গ্রেফতারের ভয়ে সম্প্রতি তার মা মারা গেলেও দেখতে পারেননি।
শিবলীর ভাই রনি মিয়া বলেন, কয়েক বছর আগে রফিকুলের ‘রূপা’ নামের সমিতি থেকে ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ব্ল্যাংক চেক জমা দেওয়া হয়। কিন্তু সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় আমার বোনের বিরুদ্ধে ৮ লাখ টাকা ও ১৬ লাখ টাকার মামলা দিয়ে গ্রাম ছাড়া করা হয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ও মামলায় গ্রেফতার আতঙ্কে এমন আরো অনেকেই বাড়ি ছেড়েছেন বলে দাবি করেন রনি।
স্থানীয় মোজাফফরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ওই গ্রামের বাসিন্দা মো. কামরুজ্জামান বলেন, রফিকুল আলম সমিতির নামে দাদন ব্যবসা গড়ে তুলছেন। সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অনেকে ভয়ে এলাকাছাড়া। শুধু শিরিন ও শিবলীই নন, গ্রামের হেনু মিয়া ৫০ হাজার টাকা দাদন নিয়ে সুদে-আসলে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েও মুক্তি পায়নি। তার নামে মামলা করেও হয়রানি করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় শক্ত বিচার হওয়া উচিত।
জানতে চাইলে রফিকুল আলম ফোনে বলেন, আপনারা কেন এসব বিষয় নিয়ে আমাকে বিরক্ত করেন। আর কখনো ফোন করবেন না বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর একাধিকবার চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. ইউনুস রহমান বলেন, ‘রুরাল ইউনিক প্রগ্রেসিভ অ্যাসোসিয়েশন’ (রূপা) নামের কোনো সমিতি সমাজসেবা থেকে নিবন্ধন নেয়নি। দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হওয়ার কথা লোকমুখে শুনেছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমদাদুল হক তালুকদার বলেন, দাদন ব্যবসা বেআইনি। যদি কেউ প্রতারণার শিকার হয়ে থাকে, তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসি/আপ্র/১৫/১১/২০২৫



















