ঢাকা ০৭:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৩ মে ২০২৫
স্মৃতিচারণ====

দাউদের জীবনযাপন ছিল ওর নিজের মতো

  • আপডেট সময় : ০৮:৪৪:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ মে ২০২৫
  • ৫ বার পড়া হয়েছে

আফসান চৌধুরী
সকাল ৭টা-৮টার দিকে জার্মানি প্রবাসে নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার, আমাদের দাউদের মৃত্যুর খবর পেলাম। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। দাউদ আমার বন্ধু। আমি তো ওকে কবি-সাহিত্যিক হিসেবে দেখতাম না। বন্ধু হিসেবেই দেখি।
দাউদের ছোট ভাই জাহিদ হায়দার আমাকে কদিন ধরেই বলছিল যে মনটা শক্ত করুন। ডাক্তার বলে দিয়েছে, দাউদ আর ফেরত আসবে না। আমি তাই প্রস্তুত ছিলাম একরকম। কষ্টটা কম করে গেছে আশা করি। ওর জ্ঞান ফিরেছিল। কথা বলতে পারেনি।
দাউদ এত কথা বলত, এত এত কথা! আমরা এত আড্ডা-গল্প দিয়েছি। ১৯৬৯ সাল থেকে। হাসান ফেরদৌস আর দাউদ খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা একই পাড়ার। ঢাকার মালিবাগ মোড় এলাকার।
একসঙ্গে একটা পত্রিকা করতাম আমরা। পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিল হাসান ফেরদৌস। আমিও ছিলাম সম্পাদনা পর্ষদে। আরেকজন মারা গেছে আমাদের বন্ধু তৌফিক খান মজলিশ, সেও ছিল। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো কয়েকজন। যেমন ওয়াসি আহমেদ। তো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দাউদ চলে গেল। দুর্দান্ত কবিতা লিখত দাউদ। কবিতা লিখে কীভাবে বিখ্যাত হতে হয়, তা ও জানত। এ নিয়ে আমরা ওকে ঠাট্টাও করতাম। ওর প্রথম কবিতার বইটা যখন ছাপা হলো, সেই কবিতার বইয়ের জন্য পুরস্কার পেল। ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ও। পুরস্কার পাওয়ার পরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে একটা সংবর্ধনার ব্যবস্থা করি আমরা দাউদের জন্য। সেখানে লোকজন অনেক প্রশংসা করেছে। শওকত ওসমান অনেক দীর্ঘ এক আলোচনা করেছিলেন দাউদের কবিতা নিয়ে। এটা একটা বিরাট পাওয়া। তিনি আমাদের ‘স্যার’ ছিলেন ঢাকা কলেজে। পরবর্তী সময় দাউদ দৈনিক ‘সংবাদ’-এ যোগ দিল সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। সেই কম বয়সি দাউদ। সবার কাছে লেখার জন্য যোগাযোগ করত। আমিই খুব একটা লিখিনি।
দাউদ সজ্জন মানুষ ছিল। খুবই সজ্জন। এরপর সে লিখল তার সেই কবিতাটা— ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়’। ওটাই ওর কাল হলো। খুব বিখ্যাত হলো বটে। কিন্তু বিরাট ঝামেলাও শুরু হলো। আমরা তাও প্রতিবাদ করেছিলাম যে এ তো কবির লেখা, কবিতাই। আহমদ ছফা, ছফা ভাই আমাদের সঙ্গে শামিল ছিলেন সে সময়। গুণদা, নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন। কবি-সাহিত্যিকেরা মিলে একটা প্রচেষ্টা নিয়েছিল তখন।
দাউদকে পুলিশ গ্রেফতার করল। এখন যেমন আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার করা হয়, সে রকম নয়। প্রিভেনটিভ কাস্টডি। যাতে দাউদের ক্ষতি না হয়। দাউদের পরিবার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী সাহেবের পরিচিত ছিল। বৃহত্তর পাবনার লোক ওরা। তখন বলা হলো যে, নিরাপদ হয় দাউদ যদি দেশ ছেড়ে চলে যায়। দাউদ দেশ ছেড়ে চলে গেল। প্রথমে কলকাতায়, পরে নানা স্থান ঘুরে জার্মানি। তারপর তো আর দেখা হয় না। কিন্তু আমাদের যোগাযোগ ছিল। তখনকার দিনে তো যোগাযোগব্যবস্থা এখনকার মতো এত সুলভ ছিল না, এত কিছুও ছিল না। তারপরও ছিল যোগাযোগ।
একবার কলকাতায় গিয়েছিলাম। ১৯৭৮ সালের পরে। দাউদ তখন লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাসায় থাকত। ওইখানে নিয়ে গেল। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তার স্ত্রী বোধ হয় আমেরিকান ছিলেন। ওই সময় আরো অনেকের সঙ্গেই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল দাউদ। দাউদ আমাদের নাটক দেখাতেও নিয়ে গেল। আমরা গিয়ে নাটক দেখলাম। চা-কফি খেলাম। তারপর আরো কয়েকবার দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে। তখনই বুঝেছিলাম, ও খুব কষ্টে আছে। দেশে ফিরতে পারছে না, এইটাই হচ্ছে প্রধান কষ্ট। তবে রাজনৈতিক পরিবর্তন যখন হলো, পঁচাত্তরের পরে, দেশে এসেছিল কয়েকবার। আমার সঙ্গে যে সব সময় দেখা হয়েছে, তা না। শেষে তো নির্বাসনেই চলে গেল।
দাউদের জীবনযাপন ছিল ওর নিজের মতো। কখনো এখানে, কখনো ওখানে। কোথাও স্থির তো সে ছিল না। বিলেতে থাকল, আমেরিকায় থাকল। এরপর জার্মানিতে চলে গেল। হয়তো কোনো জায়গায় নিরাপদ বোধ করছিল না সে। আমার মনে আছে, গুন্টার গ্রাস যখন কলকাতায় এসেছিলেন, দাউদ তার সঙ্গে অনেক ঘুরেছে কলকাতায়। আমাকে গুন্টার গ্রাস বলেছিলেন যে ‘দাউদ এত সজ্জন, যা-ই চাই না কেন ও একটা ব্যবস্থা করে দেয়।’ এরপর দাউদ চলে গেল জার্মানি। হাসান ফেরদৌসের সঙ্গে হয়তো তার যোগাযোগটা বেশি ছিল। আমার সঙ্গে ফোনে, মাঝেমধ্যে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে কথা বলতাম। পুরোনো বন্ধুদের আড্ডা-ফাজলামো যেমন হয় আরকি। ওর সঙ্গে আর সিরিয়াস আলাপ কিসে!
জীবনে ওর অনেকগুলো আঘাত ছিল। একটা অ্যাকসিডেন্টের মধ্যে পড়ে গেল। সেই তার শরীর খারাপের শুরু। সম্প্রতি ওর ভাই জাহিদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শুনলাম যে ও ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিল। আগেও ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছে, দুবার নাকি তিনবার। সেই ক্যানসার তো ছিলই। একবার স্ট্রোক করে পড়ে গেল। তো এই বয়সে এসে আর টিকে থাকা কঠিন। কখনোই সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করত না দাউদ। থাকত একা। কে তাকে দেখাশোনা করবে? এই যে ১৩ তলা থেকে বারো তলা পর্যন্ত সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল! ডাক্তার ওকে জিজ্ঞেস করেছিল যে তোমাকে কি কেউ আক্রমণ করেছে? ওকে কে আক্রমণ করবে? লোকজন ওর ছবি পাঠাত আমার কাছে। হাসপাতালে শুয়ে আছে। বড্ড খারাপ লেগেছে তা দেখে! এই উচ্ছল বাচাল মানুষটা নীরব হয়ে গেছে। আমি হয়তো মনের দিক থেকে তখনই মেনে নিয়েছি যে দাউদ আর থাকবে না।
সকালবেলা শুনলাম যে দাউদ নেই। এই বয়সেও মানুষের এত কষ্ট হতে পারে, এটা আমি ভাবিনি। আমাদের বন্ধুবান্ধবের মধ্যে হাসান ফেরদৌস দেশের বাইরে। মনজুরুল হক জাপানে চলে গেল। ওয়াসির সঙ্গে তো আজকাল যোগাযোগও হয় না। আমি আছি নতুন বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের সঙ্গে।
উনিশশ’ উনসত্তরের আগে সাহিত্যের যে ধারাবাহিকতা ছিল, তার একটা অংশ দাউদ। দাউদ অনেক ভালো কবিতা লিখেছে। কিন্তু সেগুলোর কথা মানুষ বলে না। দাউদের ‘পাবলিক-পার্সোনালিটি’ বড় হয়ে গেল ওর কাব্য-ব্যক্তিত্বের চেয়ে।
দাউদের মৃত্যুতে কী আর বলি! পাঠক ওর কবিতা পড়লেই বুঝতে পারবেন, কেমন কবি ছিল আমার বন্ধু দাউদ হায়দার।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

রাজধানীর বাজারে দাম বেড়েছে মুরগির

স্মৃতিচারণ====

দাউদের জীবনযাপন ছিল ওর নিজের মতো

আপডেট সময় : ০৮:৪৪:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ মে ২০২৫

আফসান চৌধুরী
সকাল ৭টা-৮টার দিকে জার্মানি প্রবাসে নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার, আমাদের দাউদের মৃত্যুর খবর পেলাম। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। দাউদ আমার বন্ধু। আমি তো ওকে কবি-সাহিত্যিক হিসেবে দেখতাম না। বন্ধু হিসেবেই দেখি।
দাউদের ছোট ভাই জাহিদ হায়দার আমাকে কদিন ধরেই বলছিল যে মনটা শক্ত করুন। ডাক্তার বলে দিয়েছে, দাউদ আর ফেরত আসবে না। আমি তাই প্রস্তুত ছিলাম একরকম। কষ্টটা কম করে গেছে আশা করি। ওর জ্ঞান ফিরেছিল। কথা বলতে পারেনি।
দাউদ এত কথা বলত, এত এত কথা! আমরা এত আড্ডা-গল্প দিয়েছি। ১৯৬৯ সাল থেকে। হাসান ফেরদৌস আর দাউদ খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা একই পাড়ার। ঢাকার মালিবাগ মোড় এলাকার।
একসঙ্গে একটা পত্রিকা করতাম আমরা। পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিল হাসান ফেরদৌস। আমিও ছিলাম সম্পাদনা পর্ষদে। আরেকজন মারা গেছে আমাদের বন্ধু তৌফিক খান মজলিশ, সেও ছিল। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো কয়েকজন। যেমন ওয়াসি আহমেদ। তো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দাউদ চলে গেল। দুর্দান্ত কবিতা লিখত দাউদ। কবিতা লিখে কীভাবে বিখ্যাত হতে হয়, তা ও জানত। এ নিয়ে আমরা ওকে ঠাট্টাও করতাম। ওর প্রথম কবিতার বইটা যখন ছাপা হলো, সেই কবিতার বইয়ের জন্য পুরস্কার পেল। ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ও। পুরস্কার পাওয়ার পরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে একটা সংবর্ধনার ব্যবস্থা করি আমরা দাউদের জন্য। সেখানে লোকজন অনেক প্রশংসা করেছে। শওকত ওসমান অনেক দীর্ঘ এক আলোচনা করেছিলেন দাউদের কবিতা নিয়ে। এটা একটা বিরাট পাওয়া। তিনি আমাদের ‘স্যার’ ছিলেন ঢাকা কলেজে। পরবর্তী সময় দাউদ দৈনিক ‘সংবাদ’-এ যোগ দিল সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। সেই কম বয়সি দাউদ। সবার কাছে লেখার জন্য যোগাযোগ করত। আমিই খুব একটা লিখিনি।
দাউদ সজ্জন মানুষ ছিল। খুবই সজ্জন। এরপর সে লিখল তার সেই কবিতাটা— ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়’। ওটাই ওর কাল হলো। খুব বিখ্যাত হলো বটে। কিন্তু বিরাট ঝামেলাও শুরু হলো। আমরা তাও প্রতিবাদ করেছিলাম যে এ তো কবির লেখা, কবিতাই। আহমদ ছফা, ছফা ভাই আমাদের সঙ্গে শামিল ছিলেন সে সময়। গুণদা, নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন। কবি-সাহিত্যিকেরা মিলে একটা প্রচেষ্টা নিয়েছিল তখন।
দাউদকে পুলিশ গ্রেফতার করল। এখন যেমন আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার করা হয়, সে রকম নয়। প্রিভেনটিভ কাস্টডি। যাতে দাউদের ক্ষতি না হয়। দাউদের পরিবার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী সাহেবের পরিচিত ছিল। বৃহত্তর পাবনার লোক ওরা। তখন বলা হলো যে, নিরাপদ হয় দাউদ যদি দেশ ছেড়ে চলে যায়। দাউদ দেশ ছেড়ে চলে গেল। প্রথমে কলকাতায়, পরে নানা স্থান ঘুরে জার্মানি। তারপর তো আর দেখা হয় না। কিন্তু আমাদের যোগাযোগ ছিল। তখনকার দিনে তো যোগাযোগব্যবস্থা এখনকার মতো এত সুলভ ছিল না, এত কিছুও ছিল না। তারপরও ছিল যোগাযোগ।
একবার কলকাতায় গিয়েছিলাম। ১৯৭৮ সালের পরে। দাউদ তখন লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাসায় থাকত। ওইখানে নিয়ে গেল। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তার স্ত্রী বোধ হয় আমেরিকান ছিলেন। ওই সময় আরো অনেকের সঙ্গেই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল দাউদ। দাউদ আমাদের নাটক দেখাতেও নিয়ে গেল। আমরা গিয়ে নাটক দেখলাম। চা-কফি খেলাম। তারপর আরো কয়েকবার দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে। তখনই বুঝেছিলাম, ও খুব কষ্টে আছে। দেশে ফিরতে পারছে না, এইটাই হচ্ছে প্রধান কষ্ট। তবে রাজনৈতিক পরিবর্তন যখন হলো, পঁচাত্তরের পরে, দেশে এসেছিল কয়েকবার। আমার সঙ্গে যে সব সময় দেখা হয়েছে, তা না। শেষে তো নির্বাসনেই চলে গেল।
দাউদের জীবনযাপন ছিল ওর নিজের মতো। কখনো এখানে, কখনো ওখানে। কোথাও স্থির তো সে ছিল না। বিলেতে থাকল, আমেরিকায় থাকল। এরপর জার্মানিতে চলে গেল। হয়তো কোনো জায়গায় নিরাপদ বোধ করছিল না সে। আমার মনে আছে, গুন্টার গ্রাস যখন কলকাতায় এসেছিলেন, দাউদ তার সঙ্গে অনেক ঘুরেছে কলকাতায়। আমাকে গুন্টার গ্রাস বলেছিলেন যে ‘দাউদ এত সজ্জন, যা-ই চাই না কেন ও একটা ব্যবস্থা করে দেয়।’ এরপর দাউদ চলে গেল জার্মানি। হাসান ফেরদৌসের সঙ্গে হয়তো তার যোগাযোগটা বেশি ছিল। আমার সঙ্গে ফোনে, মাঝেমধ্যে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে কথা বলতাম। পুরোনো বন্ধুদের আড্ডা-ফাজলামো যেমন হয় আরকি। ওর সঙ্গে আর সিরিয়াস আলাপ কিসে!
জীবনে ওর অনেকগুলো আঘাত ছিল। একটা অ্যাকসিডেন্টের মধ্যে পড়ে গেল। সেই তার শরীর খারাপের শুরু। সম্প্রতি ওর ভাই জাহিদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শুনলাম যে ও ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিল। আগেও ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছে, দুবার নাকি তিনবার। সেই ক্যানসার তো ছিলই। একবার স্ট্রোক করে পড়ে গেল। তো এই বয়সে এসে আর টিকে থাকা কঠিন। কখনোই সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করত না দাউদ। থাকত একা। কে তাকে দেখাশোনা করবে? এই যে ১৩ তলা থেকে বারো তলা পর্যন্ত সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল! ডাক্তার ওকে জিজ্ঞেস করেছিল যে তোমাকে কি কেউ আক্রমণ করেছে? ওকে কে আক্রমণ করবে? লোকজন ওর ছবি পাঠাত আমার কাছে। হাসপাতালে শুয়ে আছে। বড্ড খারাপ লেগেছে তা দেখে! এই উচ্ছল বাচাল মানুষটা নীরব হয়ে গেছে। আমি হয়তো মনের দিক থেকে তখনই মেনে নিয়েছি যে দাউদ আর থাকবে না।
সকালবেলা শুনলাম যে দাউদ নেই। এই বয়সেও মানুষের এত কষ্ট হতে পারে, এটা আমি ভাবিনি। আমাদের বন্ধুবান্ধবের মধ্যে হাসান ফেরদৌস দেশের বাইরে। মনজুরুল হক জাপানে চলে গেল। ওয়াসির সঙ্গে তো আজকাল যোগাযোগও হয় না। আমি আছি নতুন বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের সঙ্গে।
উনিশশ’ উনসত্তরের আগে সাহিত্যের যে ধারাবাহিকতা ছিল, তার একটা অংশ দাউদ। দাউদ অনেক ভালো কবিতা লিখেছে। কিন্তু সেগুলোর কথা মানুষ বলে না। দাউদের ‘পাবলিক-পার্সোনালিটি’ বড় হয়ে গেল ওর কাব্য-ব্যক্তিত্বের চেয়ে।
দাউদের মৃত্যুতে কী আর বলি! পাঠক ওর কবিতা পড়লেই বুঝতে পারবেন, কেমন কবি ছিল আমার বন্ধু দাউদ হায়দার।