দয়ালু ও ভদ্রতার মধ্যে পার্থক্য: ইংরেজিতে যদি বলা হয় তবে ‘নাইস পার্সন’ আর ‘কাইন্ড পার্সন’য়ের মধ্যে পার্থক্যটা সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। নিজে কখন সদয় আচরণ করেছেন মনে করতে পারেন? হতে পারে সেটা বয়স্কদের সম্মান জানানো কিংবা অপরিচিত পথচারীর সাথে হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে দুঃখ প্রকাশ করা। “সদয় বা ভালো আচরণ হল অন্যের প্রতি বিনয়ী থাকা; তার মাঝে প্রীতিকর অনুভূতির জন্ম দেওয়া। আর এটা হয়ত নিজের ওপর তেমন প্রভাব ফেলে না। যতটা না প্রভাব ফেলে দয়ালু হলে”- সিএনএন ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এভাবেই ব্যাখ্যা করেন ক্যালফোর্নিয়া’র ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ডা. কার্লা মারি ম্যানলি। তিনি আরও বলেন, “কারও মাঝে প্রীতিকর অনুভূতির জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে সেই মানুষটার মাঝে এক ধরনের আশা তৈরি করছেন যে- আপনি একজন ভালো মানুষ বা ‘নাইস পার্সন’।”
তিনি মন্তব্য করেন- “ভালো হওয়া হতে পারে একটা সামাজিক কৌশল, যার মাধ্যমে অন্যের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা যায়।” ধরা যাক- নিজে না মানলেও একজনের পোশাকের প্রশংসা করলেন। এটা কী কারণে করলেন? নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে, নাকি সবাই প্রশংসা করছে বলে আপনিও বাধ্য হলেন? এই বিষয়ে ম্যাসাটুসেটস’য়ে অবস্থিত ‘ওয়েলনেস অ্যাট ব্রিগাম অ্যান্ড উইমেন’স হসপিটাল’য়ের পরিচালক ও সহযোগী মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ ডা. অ্যাশ ন্যাডকার্নি একই প্রতিবেদনে বলেন, “এক কথায় বলতে গেলে, দয়ালু হওয়া মানে প্রতিদানে কোনো কিছু আশা না করা। মানে করুণা বা সহানুভূতি ছাড়াই প্রকৃত উদ্বেগ কাজ করছে।” “পার্থক্যটা আসলে ইচ্ছের ওপর”-মন্তব্য করেন ভার্জিনিয়া’তে অবস্থিত ‘লংউড ইউনিভার্সিটি’র মনোবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ক্যাথরিন ফ্র্যানসেন। তিনি বলেন, “মনে রাখতে হবে অন্য একজন কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেটা সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে একজন দয়ালু মানুষ।” এই অধ্যাপক মনে করেন, ভালো আচরণের চাইতে দয়ালু আচরণের মাধ্যমে অন্যের সাথে গভীর যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। যত বেশি এটা করা হবে ততই অন্যের সাথে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
দয়ালু হলে যেভাবে দেহে প্রভাব পড়ে: যখন মানুষ দয়া বা হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ করে তখন ‘অক্সিটসিন’ হরমোন নিঃসরণ হয়। প্রচলিত অর্থে একে ভালোবাসা বা ‘লাভ হরমোন’ বলা হয়- জানান ডা. ন্যাডকার্নি।
‘অক্সিটসিন’য়ের প্রবাহের ফলে মস্তিষ্কের ‘এমিগডালা’ অংশের কার্যক্রম কমে; এই অংশই ভয় ও উদ্বিগ্নতার অনুভূতি তৈরিতে কাজ করে। “এটা মস্তিষ্কে ভয়ের অনুভূতিক কমিয়ে শক্তিশালীভাবে সামাজিক অনুভূতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে”- ব্যাখ্যা করেন ডা. ন্যাডকার্নি। যদি কাউকে সাহায্য করার পর নিজের মধ্যে ভালো অনুভূতির সৃষ্টি হয় বা মানসিক চাপ কমে তবে ধন্যবাদ দিন ‘অক্সিটসিন’ হরমোনের প্রভাবকে। কারণ এটা মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী হরমোন কর্টিসল’য়ের মাত্রা কমায়। এছাড়াও অক্সিটসিন হৃদপি- সুস্থ ও শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করে। এই হরমোন ‘নাইট্রিক অক্সাইড’য়ের নিঃসরণ ঘটায় যা ধমনী ও শিরা-উপশিরা বিস্তৃত করে, ফলাফল হিসেব রক্তচাপ কমে। ন্যাডকার্নি বলেন, “অক্সিটসিন’য়ের কাজ বহু আর আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। সামাজিক যোগাযোগ আর হৃদস্বাস্থ্যই ভালো করে না, এই হরমোন দীর্ঘকালিন প্রদাহ কমায়। ফলে ডায়াবেটিস ও বিষণ্নতায় ভোগার মতো অবস্থা তৈরি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।”
মস্তিষ্কে দয়ালু হওয়ার প্রভাব: কাউকে মন থেকে সাহায্য করার পর এক ধরনের উষ্ণ অনুভূতি বোধ করলে বুঝতে হবে মস্তিষ্কে ভালোবোধের রাসায়নিকগুলোর নিঃসরণ ঘটছে। ডা. ফ্র্যানসেন বলেন, “দয়ালু হলে সেরোটনিন’য়ের উৎপাদন বাড়ে। এই ‘নিউরোট্রান্সমিটার’য়ের সাথে মন-মেজাজ ও সুখ অনুভূতি জড়িত। এছাড়া ‘ডোপামিন’ হরমোনের নিঃসরণ হয়, যা দেয় পুরষ্কার পাওয়ার মতো আনন্দদায়ক অনুভূতি।” যে কারণে দয়ালু বা সদয় আচরণ করলে একে অন্যের প্রতি ভালোবোধ করে। এছাড়া ‘এন্ডোরফিন্স’ রাসায়নিকের নিঃসরণ হয়, যা কিনা প্রাকৃতিক ব্যথা উপশমের উপাদান হিসেবে কাজ করে। আর আমোদিত হওয়ার অনুভূতি দেয়। যে কারণে কারও প্রতি দয়ালু আচরণ করার পরও সে যদি নির্দয় হয় তাতেও খারাপ লাগা কাজ করে না।” দয়ালু হওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি কাজ করা যেতে পারে। যেমন- কোনো বন্ধু বাজে সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাকে সময় দেওয়া।
রক্তদান করা। দিনের শুরুতে শুভ সকাল জানানো। দোকানে বা লিফটে কারও জন্য দরজা খুলে ধরে থাকা। অভিভাবকদের চমকে দেওয়ার মতো কিছু করা। ইতিবাচক টেক্সট করা। হতে পারে কারও কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা। কারও প্রয়োজনে রান্না করে খাওয়ানো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দয়ালুভাব দেখাতে গিয়ে অদ্ভূত লাগতে পারে। আর সেটা ব্যক্তি ক্ষেত্রে পার্থক্যও হয়। তাই ডা. ম্যানলি বলেন, “যত বেশি দয়ালু হওয়ার চর্চা করা যাবে, ততই এই অদ্ভুত অনুভূতি কেটে যাবে। আর খুব শিগগিরই নিজের ভেতরে কতটা উপকার হচ্ছে সেটা টের পেতে শুরু করবেন।”