ঢাকা ১০:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫

দখল-দূষণে বিপর্যস্ত জলাভূমি

  • আপডেট সময় : ০১:৫০:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • ১০৭ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ সংবাদদাতা : ঢাকার ঠিক মাঝখানে নয়নাভিরাম ‘হাতিরঝিলকে’ বলা হয় এই শহরের ফুসফস। কিন্তু এই জলাধারের পানির দিকে তাকালে একটি প্রশ্ন সকলের মনেই আসতে পারে, ‘ফুসফুস’-এর এই দশা কেন! নোংরা দুর্গন্ধ যুক্ত পানিতে ভরে আছে ফুসফুস। শুধু হাতিরঝিলই নয়, দেশের অধিকাংশ জলাভূমিরই একই দশা। কোথাও দখল, আবার কোথাও দূষণ বিপন্ন করছে জলাভূমিকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে জলাভূমির যতœ নেয় না কেউ। বিশ্বজুড়ে ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালন হয়। ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় ১৯৭১ সালে ইরানের রামসারে ‘রামসার কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ড অব ইন্টারন্যাশনাল ইমপোর্টেন্স ইস্পেশালি এজ ওয়াটারফল (হ্যাবিটেট) সই করে এক একে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জলাভূমি রক্ষার অঙ্গীকার করে। ক্রমান্বয়ে এই চুক্তিতে দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তি বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রসহ এখন বিশ্বের ১৫৮টি দেশ এই কনভেনশনে নিজেদের নাম লিখিয়েছে। বিশ্বজুড়ে ১৮ হাজার ২৮টি স্থান আন্তর্জাতিক জলাভূমির স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন এবং টাঙ্গুয়ার হাওড় রয়েছে সেই তালিকায়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘বর্তমানে জলাশয়ের সঙ্গে নদী ও সাগরের যে কানেকশন, তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। নদী ড্রেজিংয়ের নামে, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে, ফসল বৃদ্ধির নাম করে এসব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য সেটি নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি এর ফলে বড় বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও নেমে আসছে। যার অন্যতম বড় উদাহরণ, গত বছর সিলেটের হাওর অঞ্চলের বন্যা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে নদী মাতৃক বাংলাদেশে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে উজান থেকে নেমে আসা পানির পুরোটাই দেশের নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি জলাভূমিতে গিয়ে জমা হয়। সারা বছরেই সেচ কাজে এই পানি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু জলাভূমি যদি না থাকলে পানির প্রবাহ বিঘিœত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে বন্যা হতে দেখা যাচ্ছে।
শরীফ জামিল আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ, উজান থেকে পলি জমে এই দেশের জন্ম। এটা পুরাটাই জলাশয় ছিল। ভরাট হতে হতে নদী ও জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এসবের মধ্যে আগে কানেকশন ছিল। এই জলাশয়গুলো আমাদের দেশি মাছের প্রজনন কেন্দ্র। এই কানেকশন হারিয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের দেশি মাছ হারিয়ে যাবে, কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বন্যা বেড়ে যাবে, জলাবদ্ধতা বেড়ে যাবে, ভাঙন তৈরি হবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ করা হয়েছে। এরমধ্যে জলাশয় নিয়ে পরিকল্পনা থাকলেও সরকার হাঁটছে উল্টোপথে।’ বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অনন্য উদাহারণ হাওর। প্রতিটি হাওড় উদ্ভিদ, অর্থকরী ফসল ও জীব বৈচিত্রের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার। সাতটি জেলার ৪০টি থানায় মোট ৪৭টি ছোট বড় হাওর রয়েছে। যার মাঝে সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে অসংখ্য খাল নদী এবং প্রায় ৬৩০০টি বিল। কিন্তু এর সংখ্যা দ্রুত কমছে। মানুষ দারিদ্র্যের কারণে বুঝে না বুঝে ধ্বংস করছে প্রকৃতি ও পরিবেশকে। অন্যদিকে জলাভূমি ইজারাদার ও লগ্নি ব্যবসায়ীর হাতে ধ্বংস হচ্ছে জলাভূমি ও মৎস্য সম্পদ, নানাভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
বিশ্বঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা পাওয়া টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ। অভিযোগ রয়েছে পাহাড়ি ঢলে ওপার থেকে নেমে আসা বালির কারণে ভরাট হয়ে যাচ্ছে হাওরটি। জ্বালানি হিসেবে অবাধে কেটে নেওয়া হচ্ছে নলখাগড়া, চাইল্যাবন, হিজল-করচ গাছের ডালপালা। এতে হাওরের জীববৈচিত্র ধ্বংস হচ্ছে। রাতে এখানে ব্যাপকভাবে মাছ শিকার করা হয়। একই সঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওরে এখন সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। পর্যটকরা সচেতন না হওয়াতে যত্র তত্র পলিথিন ফেলে পরিবেশ ধ্বংস করছে।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের বলেন, ১০০ বছরের ডেল্টা প্ল্যানকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কারণ সরকার অন্তত ১০০ বছরের পরিকল্পনার কথা ভেবেছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের নদী, খাল বিল, জলাশয়গুলো ছিল ইন্টারকানেকটেড। মাছগুলো শুষ্ক মৌসুমে বিলে আসতো। বর্ষার সময় ডিম পেড়ে নদীতে চলে যেতো। ইন্টারকানেকশন নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লোকালয়ের অনেক এলাকা জলাবদ্ধতা থাকতেছে। জলাধার সংকুচিত হওয়ার ফলে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। পানির সংকট আমাদের অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে, শিল্পে পানি সংকট হচ্ছে। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উজানে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। আগে জলাশয় বেশি থাকায় পানি সেখানে গিয়ে জমা হতো। এখন জলাশয় কমে আসায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে যেকোনও পরিকল্পনা করার আগে প্রাকৃতিক জায়গাগুলো বিবেচনা করতে হবে। ডেল্টা প্ল্যান প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। না করলে সামনে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে।’
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের গর্ব সুন্দরবনের দিকে দৃষ্টি দিলেও একই পরিস্থিতি দেখা যাবে। এক সময় সুন্দরবনে ৪০০ প্রজাতির পাখি ছিল। এখন ১৩০ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে ২৭০টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে পৃথিবীতে ৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এরমধ্যে ৩৫ প্রজাতিই পাওয়া যায় সুন্দরবনে। কিন্তু প্রাকৃতিক ঝড় ঝঞ্ঝার পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদী ভাঙনে সুন্দরবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। এছাড়া অবৈধ বসতি স্থাপনের পাশাপাশি সুন্দরবন ঘিরে শিল্প গড়ে ওঠা এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটার ফলে সুন্দরবনের আয়তন ১৪০ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে। সব মিলিয়ে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে জল রয়েছে।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘আমাদের জলাশয়গুলোর সংখ্যা ক্রমশ কমে আসার বড় কারণ নদীগুলোকে আমরা বাঁধ দিয়ে কিছু অংশকে শুকনা করছি। এতে জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা উচিত, কোন জলাশয়কে শুষ্ক করবো আর কোনটাকে শুষ্ক করবো না। এটা সুষ্ঠুভাবে জনগণের সঙ্গে আলাপ করে করতে হবে। যেটা এখন করা হয় না। ডেল্টা প্ল্যান করাই হয়েছে পানিকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের পানি আইন অনুযায়ী জাতীয় কমিটি ও ডিসি কমিটির মাধ্যমে সচল করতে হবে। এই কমিটির মাধ্যমে তালিকা করতে হবে কোন জমি জলাশয়, আর কোন জমি জলাশয় না। ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন না করার সরকারের যে সিদ্ধান্ত আছে তা এখন বাস্তবায়নের জায়গায় নেই। সিদ্ধান্তের জায়গায় শুধু আছে। এট বাস্তবায়ন করার কথা জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় অফিসের। এটি যতক্ষণ পর্যন্ত করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জলাভূমি উদ্ধার করা সম্ভব না।
তিনি বলেন, এদিকে যতটুকু জলাশয় আছে তাও দূষণের শিকার। শহরের পাশের সবগুলো জলাশয় শিল্পদূষণের শিকার। এদিকে আগে জলাশয়গুলোতে শুষ্ক মৌসুমে ফসল হতো। এই দূষিত জলাশয়ে ফসলও উৎপাদন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ভরাটমুক্ত করা আর দূষণমুক্ত করাই একমাত্র সমাধান।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দখল-দূষণে বিপর্যস্ত জলাভূমি

আপডেট সময় : ০১:৫০:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

বিশেষ সংবাদদাতা : ঢাকার ঠিক মাঝখানে নয়নাভিরাম ‘হাতিরঝিলকে’ বলা হয় এই শহরের ফুসফস। কিন্তু এই জলাধারের পানির দিকে তাকালে একটি প্রশ্ন সকলের মনেই আসতে পারে, ‘ফুসফুস’-এর এই দশা কেন! নোংরা দুর্গন্ধ যুক্ত পানিতে ভরে আছে ফুসফুস। শুধু হাতিরঝিলই নয়, দেশের অধিকাংশ জলাভূমিরই একই দশা। কোথাও দখল, আবার কোথাও দূষণ বিপন্ন করছে জলাভূমিকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে জলাভূমির যতœ নেয় না কেউ। বিশ্বজুড়ে ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালন হয়। ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় ১৯৭১ সালে ইরানের রামসারে ‘রামসার কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ড অব ইন্টারন্যাশনাল ইমপোর্টেন্স ইস্পেশালি এজ ওয়াটারফল (হ্যাবিটেট) সই করে এক একে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জলাভূমি রক্ষার অঙ্গীকার করে। ক্রমান্বয়ে এই চুক্তিতে দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তি বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রসহ এখন বিশ্বের ১৫৮টি দেশ এই কনভেনশনে নিজেদের নাম লিখিয়েছে। বিশ্বজুড়ে ১৮ হাজার ২৮টি স্থান আন্তর্জাতিক জলাভূমির স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন এবং টাঙ্গুয়ার হাওড় রয়েছে সেই তালিকায়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘বর্তমানে জলাশয়ের সঙ্গে নদী ও সাগরের যে কানেকশন, তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। নদী ড্রেজিংয়ের নামে, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে, ফসল বৃদ্ধির নাম করে এসব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য সেটি নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি এর ফলে বড় বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও নেমে আসছে। যার অন্যতম বড় উদাহরণ, গত বছর সিলেটের হাওর অঞ্চলের বন্যা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে নদী মাতৃক বাংলাদেশে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে উজান থেকে নেমে আসা পানির পুরোটাই দেশের নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি জলাভূমিতে গিয়ে জমা হয়। সারা বছরেই সেচ কাজে এই পানি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু জলাভূমি যদি না থাকলে পানির প্রবাহ বিঘিœত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে বন্যা হতে দেখা যাচ্ছে।
শরীফ জামিল আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ, উজান থেকে পলি জমে এই দেশের জন্ম। এটা পুরাটাই জলাশয় ছিল। ভরাট হতে হতে নদী ও জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এসবের মধ্যে আগে কানেকশন ছিল। এই জলাশয়গুলো আমাদের দেশি মাছের প্রজনন কেন্দ্র। এই কানেকশন হারিয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের দেশি মাছ হারিয়ে যাবে, কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বন্যা বেড়ে যাবে, জলাবদ্ধতা বেড়ে যাবে, ভাঙন তৈরি হবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ করা হয়েছে। এরমধ্যে জলাশয় নিয়ে পরিকল্পনা থাকলেও সরকার হাঁটছে উল্টোপথে।’ বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অনন্য উদাহারণ হাওর। প্রতিটি হাওড় উদ্ভিদ, অর্থকরী ফসল ও জীব বৈচিত্রের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার। সাতটি জেলার ৪০টি থানায় মোট ৪৭টি ছোট বড় হাওর রয়েছে। যার মাঝে সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে অসংখ্য খাল নদী এবং প্রায় ৬৩০০টি বিল। কিন্তু এর সংখ্যা দ্রুত কমছে। মানুষ দারিদ্র্যের কারণে বুঝে না বুঝে ধ্বংস করছে প্রকৃতি ও পরিবেশকে। অন্যদিকে জলাভূমি ইজারাদার ও লগ্নি ব্যবসায়ীর হাতে ধ্বংস হচ্ছে জলাভূমি ও মৎস্য সম্পদ, নানাভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
বিশ্বঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা পাওয়া টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ। অভিযোগ রয়েছে পাহাড়ি ঢলে ওপার থেকে নেমে আসা বালির কারণে ভরাট হয়ে যাচ্ছে হাওরটি। জ্বালানি হিসেবে অবাধে কেটে নেওয়া হচ্ছে নলখাগড়া, চাইল্যাবন, হিজল-করচ গাছের ডালপালা। এতে হাওরের জীববৈচিত্র ধ্বংস হচ্ছে। রাতে এখানে ব্যাপকভাবে মাছ শিকার করা হয়। একই সঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওরে এখন সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। পর্যটকরা সচেতন না হওয়াতে যত্র তত্র পলিথিন ফেলে পরিবেশ ধ্বংস করছে।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের বলেন, ১০০ বছরের ডেল্টা প্ল্যানকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কারণ সরকার অন্তত ১০০ বছরের পরিকল্পনার কথা ভেবেছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের নদী, খাল বিল, জলাশয়গুলো ছিল ইন্টারকানেকটেড। মাছগুলো শুষ্ক মৌসুমে বিলে আসতো। বর্ষার সময় ডিম পেড়ে নদীতে চলে যেতো। ইন্টারকানেকশন নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লোকালয়ের অনেক এলাকা জলাবদ্ধতা থাকতেছে। জলাধার সংকুচিত হওয়ার ফলে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। পানির সংকট আমাদের অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে, শিল্পে পানি সংকট হচ্ছে। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উজানে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। আগে জলাশয় বেশি থাকায় পানি সেখানে গিয়ে জমা হতো। এখন জলাশয় কমে আসায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে যেকোনও পরিকল্পনা করার আগে প্রাকৃতিক জায়গাগুলো বিবেচনা করতে হবে। ডেল্টা প্ল্যান প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। না করলে সামনে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে।’
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের গর্ব সুন্দরবনের দিকে দৃষ্টি দিলেও একই পরিস্থিতি দেখা যাবে। এক সময় সুন্দরবনে ৪০০ প্রজাতির পাখি ছিল। এখন ১৩০ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে ২৭০টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে পৃথিবীতে ৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এরমধ্যে ৩৫ প্রজাতিই পাওয়া যায় সুন্দরবনে। কিন্তু প্রাকৃতিক ঝড় ঝঞ্ঝার পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদী ভাঙনে সুন্দরবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। এছাড়া অবৈধ বসতি স্থাপনের পাশাপাশি সুন্দরবন ঘিরে শিল্প গড়ে ওঠা এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটার ফলে সুন্দরবনের আয়তন ১৪০ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে। সব মিলিয়ে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে জল রয়েছে।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘আমাদের জলাশয়গুলোর সংখ্যা ক্রমশ কমে আসার বড় কারণ নদীগুলোকে আমরা বাঁধ দিয়ে কিছু অংশকে শুকনা করছি। এতে জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা উচিত, কোন জলাশয়কে শুষ্ক করবো আর কোনটাকে শুষ্ক করবো না। এটা সুষ্ঠুভাবে জনগণের সঙ্গে আলাপ করে করতে হবে। যেটা এখন করা হয় না। ডেল্টা প্ল্যান করাই হয়েছে পানিকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের পানি আইন অনুযায়ী জাতীয় কমিটি ও ডিসি কমিটির মাধ্যমে সচল করতে হবে। এই কমিটির মাধ্যমে তালিকা করতে হবে কোন জমি জলাশয়, আর কোন জমি জলাশয় না। ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন না করার সরকারের যে সিদ্ধান্ত আছে তা এখন বাস্তবায়নের জায়গায় নেই। সিদ্ধান্তের জায়গায় শুধু আছে। এট বাস্তবায়ন করার কথা জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় অফিসের। এটি যতক্ষণ পর্যন্ত করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জলাভূমি উদ্ধার করা সম্ভব না।
তিনি বলেন, এদিকে যতটুকু জলাশয় আছে তাও দূষণের শিকার। শহরের পাশের সবগুলো জলাশয় শিল্পদূষণের শিকার। এদিকে আগে জলাশয়গুলোতে শুষ্ক মৌসুমে ফসল হতো। এই দূষিত জলাশয়ে ফসলও উৎপাদন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ভরাটমুক্ত করা আর দূষণমুক্ত করাই একমাত্র সমাধান।