শান্তা মারিয়া :করোনা মহামারির তৃতীয় প্রবাহে দেশ যখন নাজেহাল সেসময় এসেছে ঈদ উৎসব। লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। না করে তো উপায়ও ছিল না। কারণ ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের শীর্ষ থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অর্থনৈতিক কাজকর্ম পরিচালিত হয়। এ সময় যদি লকডাউন শিথিল না করা হয় তাহলে অর্থনীতি ধসে পড়ার আশংকা রয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকা-, বেচা-কেনা চলছে সেটা তো ভালো। কিন্তু এসব কিছুই কি সচেতনতার সঙ্গে করা সম্ভব নয়? লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যেভাবে ঘোরাঘুরির জন্য কারণে ও অকারণে ঘর থেকে বের হচ্ছে সেটা আবার না সংক্রমণকে বাড়িয়ে দেয়।
লকডাউন শিথিল হয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার সুবিধার জন্য। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে সেই সুবিধার অপব্যবহার করতে হবে। মানুষের চলাচলের ভাব গতি দেখে মনে হচ্ছে, করোনা যেন কথা দিয়েছে যে, ‘তোরা ঘুরে বেড়া, আমি তোদের ধরুম না’। করোনা যেহেতু কোন কথা দেয়নি তাই অকারণ ঘোরাঘুরি বাদ দেয়াই যুক্তিযুক্ত। আরেকটা বিষয়, কাজের জন্য অবশ্যই বাড়ির বাইরে বের হতে হবে। কিন্তু মাস্ক পরতে বাধা কোথায়?
এখনও অনেকে মাস্ক পরছে না। আবার অনেকের মাস্ক থুতনিতে বা কানে ঝুলছে। রাস্তায় কাউকে যথাযথভাবে মাস্ক পরা না দেখলেই পুলিশে ধরা উচিত। এ প্রসঙ্গে সেদিন এক সহকর্মী বললেন, ‘যতদিন দেশের মানুষ বুঝতে না পারবে যে, তাদের বাঁচানোর জন্যই লকডাউন, তাদের বাঁচানোর জন্যই মাস্ক পরার নিয়ম, তাদের বাঁচানোর জন্যই স্বাস্থ্যবিধি, ততোদিন এদেশে কোনটাই কার্যকর হবে না।’ বড় খাঁটি কথাটি বলেছেন। কারণ মানুষ যদি নিজে থেকে সচেতন না হয় তাহলে কোনভাবেই কোন স্বাস্থ্যবিধি তাদের মানানো যাবে না। যত কড়াকড়িই করা হোক তারা ফাঁকি দেয়ার পথ খুঁজে নেবেই নেবে।
জাগো নিউজেই দেখেছিলাম একটা খবর। কঠোর লকডাউনের মধ্যে একজন গাছপাকা কাঁঠাল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছেন আত্মীয় বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। এটা তার কাছে অপরাধ বলেই মনে হচ্ছে না। উল্টো মনে হচ্ছে ছুটির দিনের আমেজে ও ফুর্তিতে তিনি চলেছেন আত্মীয় বাড়ি। এটা কি পাকা কাঁঠাল আত্মীয়কে খাওয়ানোর সময়? সেই সচেতনতা এদের নেই। তিনি যে অযথা রাস্তায় বেরিয়ে সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন সেটা যতদিন বুঝতে না পারবেন ততোদিন পাকা আম, পাকা কাঁঠাল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি বন্ধ হবে না।
আরেকজনের খবরও একই সঙ্গে ছিল। এক ভদ্রমহিলার ভাইয়ের মেয়ে হয়েছে। তাই তিনি সদ্যোজাত শিশুকে দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছেন। ফুপুর এই আবেগ বোধগম্য। কিন্তু তিনি যে হাসপাতালে গিয়ে নিজের এবং প্রসূতি ও শিশুর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারেন সেটি তার মাথায় ঢোকেনি।
আমাদের অতি পরিচিত লেভেলেও একই ঘটনা ঘটছে। এক ভদ্রলোকের বন্ধুর মা মারা গেছেন করোনায়। ভদ্রলোক ও তার আরও কয়েকজন বন্ধু ছুটে গেছেন হাসপাতালে সেই মাতৃহারা বন্ধুকে সান্ত¡না দিতে। আপাত দৃষ্টিতে এর চেয়ে মহৎ আচরণ আর হয় না। কিন্তু ভেবে দেখুন এই ‘মহৎ প্রাণ’ বন্ধুরা তাদের নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য কি পরিমাণ বিপদ ডেকে আনছেন। আবার করেনার জন্য অতি নিকট আত্মীয়কে হাসপাতালে ফেলে পালানোর ঘটনাও ঘটেছে। দরকার ছুটে যাওয়া বা ফেলে পালানো নয়। বরং দরকার স্বাস্থ্যবিধি ও সাবধানতা মেনে চলা।
করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেই বেশি ছড়িয়েছে। এটাও ঘটেছে আমাদের অসচেতনতার জন্যই। কিছুতেই সীমান্ত পারাপার বন্ধ করা যায়নি শত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও। আপনা ভালো নাকি পাগলেও বোঝে। কিন্তু এদেশের অনেক মানুষ সেটাও বোঝে না। প্রত্যেকেরই ধারণা ‘আমি করোনা ছড়াচ্ছি না’। সে কারণেই বেশি করে ছড়াচ্ছে রোগটি। বাংলাদেশের মানুষের অক্ষর জ্ঞান থাকলেও, নাম সই করতে পারলেও এমনকি সর্বোচ্চ ডিগ্রি ধারণ করলেও সচেতনতার লেভেল খুব কম। ‘বস্তিতে হবে না’ ‘গরীব মানুষের হবে না’ এই ভুয়া কথাও ধোপে টেকেনি।
করোনা থেকে বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে এবং টিকা নিতে হবে। দেশের অর্ধেক বা তার বেশি জনগোষ্ঠিকে টিকার আওতায় যখন আনা সম্ভব হবে তখন দেশ থেকে করোনার ভয় কমবে। আর সরকারেরও বলিহারি। একটা বছর সময় হাতে পেয়েও এদেশে বিশেষায়িত করোনা ফিল্ড হাসপাতাল, আইসিইউর সংখ্যা বাড়ানো, বেড বাড়ানো, সকলের জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি সরকারের পক্ষে। তারমানে বলতে হবে সরকারের লেভেলেও সচেতনতার ভয়াবহ ঘাটতি রয়েছে। মনে করেছিল করোনা চলে গেছে। আর ফিরবে না। এই অবিবেচনার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে জীবন দিয়ে।
সমাজের একেবারে প্রান্তিক স্তর থেকে উচ্চস্তর অবধি, প্রশাসনের নি¤œ থেকে শীর্ষ পর্যন্ত, এবং দেশের সকল মানুষের মধ্যে সচেতনতা না বাড়লে করোনাকে পরাজিত করা যাবে না। ছোটবেলায় পড়া নীতি কবিতা মনে পড়ছে। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার লিখেছিলেন,
‘যতদিন ভবে, না হবে না হবে
তোমার অবস্থা আমার সম।
ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।’
এই কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, যতদিন সকলে সচেতন হয়ে নিজের গরজে স্বাস্থ্যবিধি না মানবেন, ততোদিন করোনায় প্রাণহানি বন্ধ করা যাবে না।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।