ঢাকা ১২:৪৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

তীব্র শীতে কাঁপছে দেশ

  • আপডেট সময় : ০৩:১২:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ জানুয়ারী ২০২৩
  • ১১১ বার পড়া হয়েছে

প্ত্যাশা ডেস্ক : শীতের তীব্রতায় দেশের সাধারণ মানুষের জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা পার্থক্য কমে যাওয়ায় বেড়েছে শীতের এই তীব্রতা। একই সঙ্গে বইছে হিমেল হাওয়া, সঙ্গে কুয়াশার দাপট। এই শীতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে বৃদ্ধ ও শিশুরা। শীতের কারণে দেশের হাসপাতালগুলোতে বেড়ে গেছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। এদিকে ফুটপাত ও বস্তিতে বসবাসকারী নি¤œবিত্তদের অবস্থাও করুণ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বেড়ে গেছে শীতের কাপড় কেনার পরিমাণ।
শিরশির করে বইছে উত্তরী হাওয়া, কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে সূর্য, পৌষের শেষার্ধে থার্মোমিটারের পারদ নেমে যাওয়ায় কাঁপছে রাজধানীসহ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল। ঘন কুয়াশার কারণে বুধবার বিকাল পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের অনেক এলাকায় সূর্যের দেখা মেলেনি। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে আসায় মাঝারি থেকে তীব্র শীত অব্যাহত থাকার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
গতকাল বুধবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনি¤œ ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানীতে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা দেশে সর্বত্র সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে।
গত কয়েক দিন ধরেই মৌলভীবাজারে জেঁকে বসেছে শীত। মৃদু শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে ঘন কুয়াশার কারণে দুপুর পর্যন্ত দেখা মিলছে না সূর্যের। কনকনে ঠা-ায় ক্ষেত-খামারের কাজ আর গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কর্মজীবী মানুষেরা।
শ্রীমঙ্গল সবুজবাগ এলাকার অর্জুন মালাকার বলেন, প্রচ- ঠা-ার মধ্যেও মাঠে কাজ করতে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ঘন কুয়াশার কারণে ক্ষেতের সবজি বাড়ছে না। প্রতি বছরের মত এবারও নির্ধারিত সময়ে মূলা চাষ করেছেন অর্জুন। তবে এখনো তার মূলা বড় না হওয়ার পেছনে কুয়াশাকে কারণ মনে করছেন তিনি। অন্যান্য সবজিতেও একই অবস্থা বলে জানান এই কৃষক। এদিকে রাত ৮টার পর থেকে ঘন কুয়াশার কারণে শ্রীমঙ্গলে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। শ্যামলী পরিবহনের বাসচালক মো. স্বপন মিয়া জানান, কুয়াশার কারণে গাড়ি ধীর গতিতে চালাতে হচ্ছে। দিনের বেলাতেও সড়কে লাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে। ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীত আরও কয়েকদিন চলতে পারে বলে আভাসি দিয়েছেন শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক মুজিবুর রহমান।
হিমালয়ের হিমে কাঁপছে কুড়িগ্রাম: দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের নয় উপজেলায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। হিমালয় থেকে আসা হিম হাওয়ায় কাবু নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী, শিশু ও বয়স্করা। দিনের অনেক সময় ঘন কুয়াশার কারণে রোদের দেখা না মেলায় খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চলে তাদের। কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার শাহীনুর রহমান সরদার জানান, হাসপাতালের ইনডোরে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। নতুন রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু আর বয়স্ক এবং বেশিরভাগই শীত ও ঠা-াজনিত রোগে ভুগছেন। দেশের উত্তরে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় বুধবার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস; আর কুড়িগ্রামের রাজারহাটে সর্বনি¤œ তাপামাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সাড়ে ছয়-ঘণ্টা বন্ধ ফেরি চলাচল: এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে যোগাযোগের নৌপথ পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা বন্ধ ছিল।
বিআইডব্লিউটিসির পাটুরিয়া ঘাট শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুস সালাম বলেন, ঘন কুয়াশার কারণে রাত ৩টা থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। সকাল ৯টা ২০ মিনিট থেকে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হয়। যাত্রী ও গাড়ির চাপ থাকায় ১৫টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার কারণে রাতেই ঘাটে আটকা পড়ে ছোট বড় প্রায় শতাধিক যানবাহন। এতে ভোগান্তিতে পড়েন চালক ও যাত্রীরা। দৌলতদিয়া ঘাটে যশোরের বেনাপোল থেকে ট্রাক নিয়ে আসা চালক আবজাল হোসেন বলেন, “রাত পৌনে ৩টার দিকে যখন ফেরিতে উঠি তখন দেখি খুবই কুয়াশা। চারপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটু পর জানতে পারি ফেরি চলাচল বন্ধ।”
বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, রাত ৩টায় কুয়াশার কারণে নদী পথ দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়। সে সময় নৌ-দুর্ঘটনা এড়াতে এই রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। “ফেরি বন্ধ থাকায় কিছু যানবাহন আটকা পড়ে। কুয়াশা কেটে যাওয়ায় সকাল সাড়ে ৯টায় পুনরায় ফেরি চলাচল শুরু হয়।”
পূর্বাভাস: বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। আকাশ আংশিক মেঘলাসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। সেইসঙ্গে আগামী তিন দিনে আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানান, সারাদেশে রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়ায় দেশের উত্তর, উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি হচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। বড় এলাকাজুড়ে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে। টানা কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা কামার প্রবণতার মধ্যে পৌষের মাঝামাঝিতে দেশের সর্বত্র শীত ও কুয়াশার দাপট বেড়েছে। জানুয়ারি মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়, চলতি মাসে ২-৩টি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে একটি মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে।
আবহাওয়াবিদরা জানান, দিনের তাপমাত্রা তুলনামুলক কম থাকার পাশাপাশি উত্তরী হাওয়ায় রাজধানীসহ অনেক এলাকায় কনকনে শীতের অনুভূতি হচ্ছে। আরও কয়েকদিন এমন আবহাওয়া থাকবে।
ভোগান্তি: রামপুরায় বসবাস করা কাজী মিলি বলেন, ‘নিজের গরম কাপড় পরে কাজে বের হয়ে তো যাচ্ছি। বাসায় কষ্ট পাচ্ছেন বৃদ্ধ মা-বাবা। ঘরগুলো সব বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। এলাকার অনেকেই গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে ঘর গরম রাখার চেষ্টা করছে, আবার অনেকেই রুম হিটার দিয়ে শীত নিবারণ করছে।’ মগবাজারের দরজি ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন বলেন, ‘কুয়াশা আর শীতের কারণে সকালে কেউই কাজে আসতে চাচ্ছে না। দোকানেও আর হিটার বসানো যাচ্ছে না। কর্মচারীদের ঠান্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছে। ঘন ঘন চা খেয়ে শীত নিবারণ করার চেষ্টা করছি।’
আবহাওয়াবিদ কী বলছেন: আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, রাতের তাপমাত্রা কমলে সাধারণ মানুষ বাসায় থাকার কারণে শীতের তীব্রতার প্রকোপ এতটা অনুভব করে না। কিন্তু দিনের বেলা তাপমাত্রা কমলে মানুষ কাজে যাওয়ার কারণে শীতের তীব্রতা বেশি অনুভব করছে। গত দুদিন কুয়াশার কারণে সূর্য না ওঠায় দিনের তাপমাত্রা হুট করেই অনেকটা কমে গেছে। তবে রাতের তাপমাত্রা আগের মতোই আছে। ফলে রাত ও দিনের তাপমাত্রার ব্যবধান কমে আসায় তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে। আগামী কয়েক দিন এই আবহাওয়া থাকতে পারে বলে তিনি জানান।
হাসপাতালের অবস্থা: দেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালগুলোতে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শীতের ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। নীলফামারী, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, নীলফামারী ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে আসন সংখ্যার দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগী বেশি। নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. গোলাম রসুল রাখি বলেন, ‘শীতের কারণে নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। পাশাপাশি যাদের হাঁপানি বা অ্যাজমা আছে তাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু ও বৃদ্ধরা। কুড়িগ্রামেও শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা। শয্যা-সংকটে ওয়ার্ডের মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা নিচ্ছে রোগীরা। প্রায় একই অবস্থা দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ হাসপাতালের।
নি¤œবিত্তদের কষ্ট: ঢাকায় শীতের তীব্রতা বাড়ায় ফুটপাতে, বস্তিতে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে নি¤œবিত্তদের। বাসাবাড়িতে কাজ করা মনোয়ারা জানান, রাতে পলিথিনের ঘর, টিনের ফুটো দিয়ে হিমেল বাতাস ঢুকে যায়। ঘর হয়ে থাকে বরফের মতো ঠান্ডা। এই অবসস্থায় সকালে উঠে কাজে আসতেও কষ্ট হয়। এদিকে কাজে এসেই প্রায় সারা দিনই ঠান্ডা পানিতেই কাজ করতে হচ্ছে। শীতের একই ধরনের কষ্টের কথা বলেন রিকশাচালক শহিদুল। তিনি বলেন, হাত-পা জমে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ রিকশা চালাতে পারছি না। সন্ধ্যার দিকে পাতা, কাগজ কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত কাটানোর চেষ্টা করছি।
হকারদের রমরমা ব্যবসা: রাজধানীর পুরানা পল্টন, গুলিস্তান আর বায়তুল মোকাররম এলাকা ঘুরে দেখা যায় অন্য এক চিত্র। শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় গরম কাপড় কেনার হিরিক পড়ে গেছে। একই সঙ্গে সুযোগ বুঝে দামও বাড়িয়ে দিয়েছে হকাররা। অভিযোগ করছেন অনেক ক্রেতাই। কাপড় কিনতে আসা হালিমা খাতুন বলেন, হুট করেই এবার শীতটা বেড়ে গেছে। আগের মতো আর অবস্থা নেই। গরম কাপড় কম ছিল, তাই নতুন কিছু কাপড় কিনতে হচ্ছে। এদিকে কাপড় কিনতে এসে দেখি আগের চেয়ে দাম অনেক বেশি চাইছে। একই অভিযোগ করেন মাহমুদ আলম। তিনি আরও বলেন, সংসার বড়। অল্পেই চালাই। অন্য খরচ বেড়েছে। তাই এবার গরম কাপড় তেমন একটা কিনিনি। এখন শীত বাড়ায় বাধ্য হয়েই কাপড় কিনতে হচ্ছে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

তীব্র শীতে কাঁপছে দেশ

আপডেট সময় : ০৩:১২:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ জানুয়ারী ২০২৩

প্ত্যাশা ডেস্ক : শীতের তীব্রতায় দেশের সাধারণ মানুষের জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা পার্থক্য কমে যাওয়ায় বেড়েছে শীতের এই তীব্রতা। একই সঙ্গে বইছে হিমেল হাওয়া, সঙ্গে কুয়াশার দাপট। এই শীতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে বৃদ্ধ ও শিশুরা। শীতের কারণে দেশের হাসপাতালগুলোতে বেড়ে গেছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। এদিকে ফুটপাত ও বস্তিতে বসবাসকারী নি¤œবিত্তদের অবস্থাও করুণ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বেড়ে গেছে শীতের কাপড় কেনার পরিমাণ।
শিরশির করে বইছে উত্তরী হাওয়া, কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে সূর্য, পৌষের শেষার্ধে থার্মোমিটারের পারদ নেমে যাওয়ায় কাঁপছে রাজধানীসহ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল। ঘন কুয়াশার কারণে বুধবার বিকাল পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের অনেক এলাকায় সূর্যের দেখা মেলেনি। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে আসায় মাঝারি থেকে তীব্র শীত অব্যাহত থাকার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
গতকাল বুধবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনি¤œ ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানীতে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা দেশে সর্বত্র সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে।
গত কয়েক দিন ধরেই মৌলভীবাজারে জেঁকে বসেছে শীত। মৃদু শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে ঘন কুয়াশার কারণে দুপুর পর্যন্ত দেখা মিলছে না সূর্যের। কনকনে ঠা-ায় ক্ষেত-খামারের কাজ আর গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কর্মজীবী মানুষেরা।
শ্রীমঙ্গল সবুজবাগ এলাকার অর্জুন মালাকার বলেন, প্রচ- ঠা-ার মধ্যেও মাঠে কাজ করতে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ঘন কুয়াশার কারণে ক্ষেতের সবজি বাড়ছে না। প্রতি বছরের মত এবারও নির্ধারিত সময়ে মূলা চাষ করেছেন অর্জুন। তবে এখনো তার মূলা বড় না হওয়ার পেছনে কুয়াশাকে কারণ মনে করছেন তিনি। অন্যান্য সবজিতেও একই অবস্থা বলে জানান এই কৃষক। এদিকে রাত ৮টার পর থেকে ঘন কুয়াশার কারণে শ্রীমঙ্গলে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। শ্যামলী পরিবহনের বাসচালক মো. স্বপন মিয়া জানান, কুয়াশার কারণে গাড়ি ধীর গতিতে চালাতে হচ্ছে। দিনের বেলাতেও সড়কে লাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে। ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীত আরও কয়েকদিন চলতে পারে বলে আভাসি দিয়েছেন শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক মুজিবুর রহমান।
হিমালয়ের হিমে কাঁপছে কুড়িগ্রাম: দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের নয় উপজেলায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। হিমালয় থেকে আসা হিম হাওয়ায় কাবু নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী, শিশু ও বয়স্করা। দিনের অনেক সময় ঘন কুয়াশার কারণে রোদের দেখা না মেলায় খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চলে তাদের। কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার শাহীনুর রহমান সরদার জানান, হাসপাতালের ইনডোরে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। নতুন রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু আর বয়স্ক এবং বেশিরভাগই শীত ও ঠা-াজনিত রোগে ভুগছেন। দেশের উত্তরে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় বুধবার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস; আর কুড়িগ্রামের রাজারহাটে সর্বনি¤œ তাপামাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সাড়ে ছয়-ঘণ্টা বন্ধ ফেরি চলাচল: এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে যোগাযোগের নৌপথ পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা বন্ধ ছিল।
বিআইডব্লিউটিসির পাটুরিয়া ঘাট শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুস সালাম বলেন, ঘন কুয়াশার কারণে রাত ৩টা থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। সকাল ৯টা ২০ মিনিট থেকে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হয়। যাত্রী ও গাড়ির চাপ থাকায় ১৫টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার কারণে রাতেই ঘাটে আটকা পড়ে ছোট বড় প্রায় শতাধিক যানবাহন। এতে ভোগান্তিতে পড়েন চালক ও যাত্রীরা। দৌলতদিয়া ঘাটে যশোরের বেনাপোল থেকে ট্রাক নিয়ে আসা চালক আবজাল হোসেন বলেন, “রাত পৌনে ৩টার দিকে যখন ফেরিতে উঠি তখন দেখি খুবই কুয়াশা। চারপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটু পর জানতে পারি ফেরি চলাচল বন্ধ।”
বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, রাত ৩টায় কুয়াশার কারণে নদী পথ দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়। সে সময় নৌ-দুর্ঘটনা এড়াতে এই রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। “ফেরি বন্ধ থাকায় কিছু যানবাহন আটকা পড়ে। কুয়াশা কেটে যাওয়ায় সকাল সাড়ে ৯টায় পুনরায় ফেরি চলাচল শুরু হয়।”
পূর্বাভাস: বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। আকাশ আংশিক মেঘলাসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। সেইসঙ্গে আগামী তিন দিনে আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানান, সারাদেশে রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়ায় দেশের উত্তর, উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি হচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। বড় এলাকাজুড়ে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে। টানা কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা কামার প্রবণতার মধ্যে পৌষের মাঝামাঝিতে দেশের সর্বত্র শীত ও কুয়াশার দাপট বেড়েছে। জানুয়ারি মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়, চলতি মাসে ২-৩টি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে একটি মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে।
আবহাওয়াবিদরা জানান, দিনের তাপমাত্রা তুলনামুলক কম থাকার পাশাপাশি উত্তরী হাওয়ায় রাজধানীসহ অনেক এলাকায় কনকনে শীতের অনুভূতি হচ্ছে। আরও কয়েকদিন এমন আবহাওয়া থাকবে।
ভোগান্তি: রামপুরায় বসবাস করা কাজী মিলি বলেন, ‘নিজের গরম কাপড় পরে কাজে বের হয়ে তো যাচ্ছি। বাসায় কষ্ট পাচ্ছেন বৃদ্ধ মা-বাবা। ঘরগুলো সব বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। এলাকার অনেকেই গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে ঘর গরম রাখার চেষ্টা করছে, আবার অনেকেই রুম হিটার দিয়ে শীত নিবারণ করছে।’ মগবাজারের দরজি ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন বলেন, ‘কুয়াশা আর শীতের কারণে সকালে কেউই কাজে আসতে চাচ্ছে না। দোকানেও আর হিটার বসানো যাচ্ছে না। কর্মচারীদের ঠান্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছে। ঘন ঘন চা খেয়ে শীত নিবারণ করার চেষ্টা করছি।’
আবহাওয়াবিদ কী বলছেন: আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, রাতের তাপমাত্রা কমলে সাধারণ মানুষ বাসায় থাকার কারণে শীতের তীব্রতার প্রকোপ এতটা অনুভব করে না। কিন্তু দিনের বেলা তাপমাত্রা কমলে মানুষ কাজে যাওয়ার কারণে শীতের তীব্রতা বেশি অনুভব করছে। গত দুদিন কুয়াশার কারণে সূর্য না ওঠায় দিনের তাপমাত্রা হুট করেই অনেকটা কমে গেছে। তবে রাতের তাপমাত্রা আগের মতোই আছে। ফলে রাত ও দিনের তাপমাত্রার ব্যবধান কমে আসায় তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে। আগামী কয়েক দিন এই আবহাওয়া থাকতে পারে বলে তিনি জানান।
হাসপাতালের অবস্থা: দেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালগুলোতে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শীতের ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। নীলফামারী, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, নীলফামারী ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে আসন সংখ্যার দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগী বেশি। নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. গোলাম রসুল রাখি বলেন, ‘শীতের কারণে নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। পাশাপাশি যাদের হাঁপানি বা অ্যাজমা আছে তাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু ও বৃদ্ধরা। কুড়িগ্রামেও শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা। শয্যা-সংকটে ওয়ার্ডের মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা নিচ্ছে রোগীরা। প্রায় একই অবস্থা দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ হাসপাতালের।
নি¤œবিত্তদের কষ্ট: ঢাকায় শীতের তীব্রতা বাড়ায় ফুটপাতে, বস্তিতে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে নি¤œবিত্তদের। বাসাবাড়িতে কাজ করা মনোয়ারা জানান, রাতে পলিথিনের ঘর, টিনের ফুটো দিয়ে হিমেল বাতাস ঢুকে যায়। ঘর হয়ে থাকে বরফের মতো ঠান্ডা। এই অবসস্থায় সকালে উঠে কাজে আসতেও কষ্ট হয়। এদিকে কাজে এসেই প্রায় সারা দিনই ঠান্ডা পানিতেই কাজ করতে হচ্ছে। শীতের একই ধরনের কষ্টের কথা বলেন রিকশাচালক শহিদুল। তিনি বলেন, হাত-পা জমে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ রিকশা চালাতে পারছি না। সন্ধ্যার দিকে পাতা, কাগজ কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত কাটানোর চেষ্টা করছি।
হকারদের রমরমা ব্যবসা: রাজধানীর পুরানা পল্টন, গুলিস্তান আর বায়তুল মোকাররম এলাকা ঘুরে দেখা যায় অন্য এক চিত্র। শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় গরম কাপড় কেনার হিরিক পড়ে গেছে। একই সঙ্গে সুযোগ বুঝে দামও বাড়িয়ে দিয়েছে হকাররা। অভিযোগ করছেন অনেক ক্রেতাই। কাপড় কিনতে আসা হালিমা খাতুন বলেন, হুট করেই এবার শীতটা বেড়ে গেছে। আগের মতো আর অবস্থা নেই। গরম কাপড় কম ছিল, তাই নতুন কিছু কাপড় কিনতে হচ্ছে। এদিকে কাপড় কিনতে এসে দেখি আগের চেয়ে দাম অনেক বেশি চাইছে। একই অভিযোগ করেন মাহমুদ আলম। তিনি আরও বলেন, সংসার বড়। অল্পেই চালাই। অন্য খরচ বেড়েছে। তাই এবার গরম কাপড় তেমন একটা কিনিনি। এখন শীত বাড়ায় বাধ্য হয়েই কাপড় কিনতে হচ্ছে।