ঢাকা ১১:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

তিষ্ঠ ক্ষণকাল

  • আপডেট সময় : ১০:১৮:৪০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২২
  • ৬৯ বার পড়া হয়েছে

তাপস রায় : ‘খালের ধারে প্রকা- বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।’ আকাশের দেবতাকে নিয়ে এ কালের হারু ঘোষ খুব একটা ভাবেন না। ভাগ্যদেবতার প্রতিও তার বিশ্বাস স্থির নয়। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়বেন, এটাই তার পণ। যুগে যুগে তিনি বছরের প্রথম দিনটিকেই পয়মন্ত মনে করে এসেছেন। সেদিন থেকেই ‘ভালো হয়ে যাওয়া’র প্রতিজ্ঞা তার চিরকালের।
ওদিকে অলক্ষে বসে মুচকি হাসেন ভাগ্যদেবতা। তিনি ঠিক জানেন, হারু ঘোষ বাম হাত কানে ঠেকিয়ে ডান হাত প্রসারিত করে ‘যারে যাবে যদি যা’ বছর-বিদায়ী সংগীত যতই গান, কালের পরিক্রমায় এই গান নতুন বছরের শেষে তাঁকে আবারও গাইতে হবে। দাঁতে জিব কেটে ‘খোদার কসম, এ বছর ভালো হয়ে যাবই’ বলবেন তিনি আরেকবার; প্রয়োজনে তার পরের বছর বর্ষবরণেও!
আমরা বাংলা বর্ষকে যত আয়োজনে বরণ করি, ইংরেজি বছরকে সেভাবে করি না। জানুয়ারিকে আহ্বানের জন্য বাংলায় একটা গান পর্যন্ত নেই! অথচ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো।’ শুধু কি তা–ই, একবার গুরুদেব বাসন্তি রঙের সিল্কের জোব্বা পরে বসে আছেন। তাঁকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে রানী চন্দ এই অপরূপ সাজের কারণ জানতে চাইলেন।
গুরুদেব বললেন, ‘আমি যদি বসন্তকে আহ্বান না করি তো কে করবে? বসন্তকে তাই আহ্বান করছি। আমাকেই সবাইকে ডেকে আনতে হয়। এই দেখো না, বর্ষাকে ডাকি, তবে সে আসে। আবার থামাতেও হয় শেষে আমাকেই।’
ইশ্! রবীন্দ্রনাথ এই শহরে কখনো ইংরেজি বর্ষবরণ দেখতে আসেননি। এলে এটুকু নিশ্চিত, বর্ষবরণের রাতে আতশবাজির ধামাকা উদ্যাপন থামাতে স্তম্ভিত, কম্পিতচিত্তে একটা গান অন্তত তিনি লিখতেন।
যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকেরা নতুনের জয়গান গেয়েছেন। নতুন মানে সম্ভাবনা (যতক্ষণ পর্যন্ত ‘সম্ভব না’ মনে হচ্ছে)। নতুন মানে পরিকল্পনা (যতক্ষণ পর্যন্ত কল্পনার পরি উড়ে না যাচ্ছে)। নতুন মানে ভুল শুধরে অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুযোগ। যদিও বিজ্ঞজনেরা বলেন, অভিজ্ঞতা হলো সেই চিরুনি যা অর্জনের পর মাথায় চুল আর অবশিষ্ট থাকে না। তাতে কী! চিরুনি তো আছে। সমাজে এই চিরুনির আলাদা মূল্যও আছে। বিকোয় বিস্তর। সুতরাং আশাহত হওয়ার কারণ নেই।
পুরোনো ঠিক তার উল্টো। অতীতে ফিরে তাকালে সুখস্মৃতির চেয়ে দুঃখটাই কাঁটা হয়ে বাজে বেশি। জীবন তখন জঞ্জালসম। ফিরে ফিরে মনে হয়, ভুলের কী জালটাই না বিছিয়ে রাখা ছিল বছরজুড়ে! সেই ভুলগুলো ভুলে যেতে, বছরের ব্যর্থতা ঢাকতে, পুরোনোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতেই কি বর্ষবরণের এত আয়োজন?
নিউ ইয়ার পার্টির আয়োজন করেছেন কায়সার সাহেব। আমন্ত্রিত লোকজন সবাই এসেছেন। পার্টি জমে উঠেছে। হঠাৎ অপরিচিত এক লোক পার্টিতে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে সবাই অবাক! সেদিকে অবশ্য অনাহুতের খেয়াল নেই। তাঁর দুচোখে বিস্ময়। ঢুকেই এটা-সেটা মুখে দিতে শুরু করেছেন। একসময় আর চুপ থাকতে না পেরে কায়সার সাহেব এগিয়ে গেলেন, ‘এক্সকিউজ মি, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।’
‘ওহ, এত আয়োজন দেখে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম,’ অনাহূত বললেন। ‘আসল কথাটাই আপনাকে বলা হয়নি।’
কী কথা?
হ্যাঁ, সে কথাই আমার আগে বলা উচিত ছিল।
ঠিক আছে, বলুন।
না মানে, এখন বলা কি ঠিক হবে? লোকটি ততক্ষণে পানীয়ের গ্লাস তুলে নিয়েছেন। আপনি বলতে পারেন। কায়সার সাহেব ধৈর্য হারাচ্ছেন। আমি আসলে বলতে এসেছিলাম, বাইরে আপনার অতিথিদের গাড়ি রাখার গ্যারেজে আগুন লেগেছে।
এ বছর বর্ষবরণের রাতে ‘আনন্দের ফানুসে আগুন’ এমন শিরোনাম উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে। একই রাতে আতশবাজির শব্দে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠা চার মাসের শিশু উমায়েরের মৃত্যু অনেককে কাঁদিয়েছে। উমায়েরের শ্বাসকষ্ট ছিল। সে শ্বাস নিতে পারছিল না। তার পরিবার বারবার হয়তো ভাবছিল, রাত কেটে কখন সকাল হবে?
সকাল দেখে যদি দিন বলা যায়, তবে নববর্ষের প্রথম প্রহর দেখে বছরের বাকি দিন অনুমান করা যেতে পারে। স্মরণে আসে সেই পুরোনো কৌতুক: রূপকথার সব গল্পই কি ‘একদা এক রাজ্যে এক রাজা ছিল’—এভাবে শুরু হয়? ছাত্রের প্রশ্নে শিক্ষক বলছেন, ‘না, আমি যদি নির্বাচনে জয়ী হই’—এভাবেও শুরু হতে পারে। কিন্তু এই করোনাকালে কায়মনোবাক্যে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ প্রার্থনা করছেন, ‘একদা এ পৃথিবীতে করোনা ছিল’—রূপকথার গল্প এভাবে শুরু হোক।
দুই হাজার বাইশ এই কৃতিত্ব নিতে পারে। তার সবে শুরু। সে কি জানে না আমাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে! আমাদের কর্ম সারা। সে কি চায় না মানুষ তাকে স্মরণে রাখুক? কালের গহ্বর থেকে উঠে এসে সে ক্যালেন্ডারের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। তার আয়ু মাত্র এক বছর! ক্যালেন্ডারের শেষ আশ্রয় বইয়ের মলাট অথবা মুড়ির ঠোঙায়। বছরের আশ্রয় কালের গর্ভে। সেখানে হারিয়ে না গিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেওয়ার এমন সুযোগ দুই হাজার বাইশ নিশ্চয়ই হারাতে চাইবে না। করোনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসুক। আকাশের দেবতাও এত দিনে নিশ্চয়ই কটাক্ষ হেনে ক্লান্ত। করজোড়ে বলি, তিষ্ঠ ক্ষণকাল।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আয়নাঘরের পরতে পরতে নির্যাতনের চিহ্ন

তিষ্ঠ ক্ষণকাল

আপডেট সময় : ১০:১৮:৪০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২২

তাপস রায় : ‘খালের ধারে প্রকা- বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।’ আকাশের দেবতাকে নিয়ে এ কালের হারু ঘোষ খুব একটা ভাবেন না। ভাগ্যদেবতার প্রতিও তার বিশ্বাস স্থির নয়। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়বেন, এটাই তার পণ। যুগে যুগে তিনি বছরের প্রথম দিনটিকেই পয়মন্ত মনে করে এসেছেন। সেদিন থেকেই ‘ভালো হয়ে যাওয়া’র প্রতিজ্ঞা তার চিরকালের।
ওদিকে অলক্ষে বসে মুচকি হাসেন ভাগ্যদেবতা। তিনি ঠিক জানেন, হারু ঘোষ বাম হাত কানে ঠেকিয়ে ডান হাত প্রসারিত করে ‘যারে যাবে যদি যা’ বছর-বিদায়ী সংগীত যতই গান, কালের পরিক্রমায় এই গান নতুন বছরের শেষে তাঁকে আবারও গাইতে হবে। দাঁতে জিব কেটে ‘খোদার কসম, এ বছর ভালো হয়ে যাবই’ বলবেন তিনি আরেকবার; প্রয়োজনে তার পরের বছর বর্ষবরণেও!
আমরা বাংলা বর্ষকে যত আয়োজনে বরণ করি, ইংরেজি বছরকে সেভাবে করি না। জানুয়ারিকে আহ্বানের জন্য বাংলায় একটা গান পর্যন্ত নেই! অথচ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো।’ শুধু কি তা–ই, একবার গুরুদেব বাসন্তি রঙের সিল্কের জোব্বা পরে বসে আছেন। তাঁকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে রানী চন্দ এই অপরূপ সাজের কারণ জানতে চাইলেন।
গুরুদেব বললেন, ‘আমি যদি বসন্তকে আহ্বান না করি তো কে করবে? বসন্তকে তাই আহ্বান করছি। আমাকেই সবাইকে ডেকে আনতে হয়। এই দেখো না, বর্ষাকে ডাকি, তবে সে আসে। আবার থামাতেও হয় শেষে আমাকেই।’
ইশ্! রবীন্দ্রনাথ এই শহরে কখনো ইংরেজি বর্ষবরণ দেখতে আসেননি। এলে এটুকু নিশ্চিত, বর্ষবরণের রাতে আতশবাজির ধামাকা উদ্যাপন থামাতে স্তম্ভিত, কম্পিতচিত্তে একটা গান অন্তত তিনি লিখতেন।
যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকেরা নতুনের জয়গান গেয়েছেন। নতুন মানে সম্ভাবনা (যতক্ষণ পর্যন্ত ‘সম্ভব না’ মনে হচ্ছে)। নতুন মানে পরিকল্পনা (যতক্ষণ পর্যন্ত কল্পনার পরি উড়ে না যাচ্ছে)। নতুন মানে ভুল শুধরে অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুযোগ। যদিও বিজ্ঞজনেরা বলেন, অভিজ্ঞতা হলো সেই চিরুনি যা অর্জনের পর মাথায় চুল আর অবশিষ্ট থাকে না। তাতে কী! চিরুনি তো আছে। সমাজে এই চিরুনির আলাদা মূল্যও আছে। বিকোয় বিস্তর। সুতরাং আশাহত হওয়ার কারণ নেই।
পুরোনো ঠিক তার উল্টো। অতীতে ফিরে তাকালে সুখস্মৃতির চেয়ে দুঃখটাই কাঁটা হয়ে বাজে বেশি। জীবন তখন জঞ্জালসম। ফিরে ফিরে মনে হয়, ভুলের কী জালটাই না বিছিয়ে রাখা ছিল বছরজুড়ে! সেই ভুলগুলো ভুলে যেতে, বছরের ব্যর্থতা ঢাকতে, পুরোনোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতেই কি বর্ষবরণের এত আয়োজন?
নিউ ইয়ার পার্টির আয়োজন করেছেন কায়সার সাহেব। আমন্ত্রিত লোকজন সবাই এসেছেন। পার্টি জমে উঠেছে। হঠাৎ অপরিচিত এক লোক পার্টিতে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে সবাই অবাক! সেদিকে অবশ্য অনাহুতের খেয়াল নেই। তাঁর দুচোখে বিস্ময়। ঢুকেই এটা-সেটা মুখে দিতে শুরু করেছেন। একসময় আর চুপ থাকতে না পেরে কায়সার সাহেব এগিয়ে গেলেন, ‘এক্সকিউজ মি, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।’
‘ওহ, এত আয়োজন দেখে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম,’ অনাহূত বললেন। ‘আসল কথাটাই আপনাকে বলা হয়নি।’
কী কথা?
হ্যাঁ, সে কথাই আমার আগে বলা উচিত ছিল।
ঠিক আছে, বলুন।
না মানে, এখন বলা কি ঠিক হবে? লোকটি ততক্ষণে পানীয়ের গ্লাস তুলে নিয়েছেন। আপনি বলতে পারেন। কায়সার সাহেব ধৈর্য হারাচ্ছেন। আমি আসলে বলতে এসেছিলাম, বাইরে আপনার অতিথিদের গাড়ি রাখার গ্যারেজে আগুন লেগেছে।
এ বছর বর্ষবরণের রাতে ‘আনন্দের ফানুসে আগুন’ এমন শিরোনাম উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে। একই রাতে আতশবাজির শব্দে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠা চার মাসের শিশু উমায়েরের মৃত্যু অনেককে কাঁদিয়েছে। উমায়েরের শ্বাসকষ্ট ছিল। সে শ্বাস নিতে পারছিল না। তার পরিবার বারবার হয়তো ভাবছিল, রাত কেটে কখন সকাল হবে?
সকাল দেখে যদি দিন বলা যায়, তবে নববর্ষের প্রথম প্রহর দেখে বছরের বাকি দিন অনুমান করা যেতে পারে। স্মরণে আসে সেই পুরোনো কৌতুক: রূপকথার সব গল্পই কি ‘একদা এক রাজ্যে এক রাজা ছিল’—এভাবে শুরু হয়? ছাত্রের প্রশ্নে শিক্ষক বলছেন, ‘না, আমি যদি নির্বাচনে জয়ী হই’—এভাবেও শুরু হতে পারে। কিন্তু এই করোনাকালে কায়মনোবাক্যে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ প্রার্থনা করছেন, ‘একদা এ পৃথিবীতে করোনা ছিল’—রূপকথার গল্প এভাবে শুরু হোক।
দুই হাজার বাইশ এই কৃতিত্ব নিতে পারে। তার সবে শুরু। সে কি জানে না আমাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে! আমাদের কর্ম সারা। সে কি চায় না মানুষ তাকে স্মরণে রাখুক? কালের গহ্বর থেকে উঠে এসে সে ক্যালেন্ডারের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। তার আয়ু মাত্র এক বছর! ক্যালেন্ডারের শেষ আশ্রয় বইয়ের মলাট অথবা মুড়ির ঠোঙায়। বছরের আশ্রয় কালের গর্ভে। সেখানে হারিয়ে না গিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেওয়ার এমন সুযোগ দুই হাজার বাইশ নিশ্চয়ই হারাতে চাইবে না। করোনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসুক। আকাশের দেবতাও এত দিনে নিশ্চয়ই কটাক্ষ হেনে ক্লান্ত। করজোড়ে বলি, তিষ্ঠ ক্ষণকাল।