কুষ্টিয়া সংবাদদাতা: ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবসে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে প্রথম দিনের অনুষ্ঠানেই যেন মানুষের ঢল নামে। দাওয়াত নেই, পত্র নেই, তবুও সব পথ যেন এসে মিশে গেছে মরা কালী নদীর তীরে। শহরের সব রাস্তা যেন গিয়ে মিশেছে লালনের আখড়ায়। কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা ছেঁউড়িয়া। কিন্তু এখন সে রাস্তায় যেতে সময় লাগছে ঘণ্টার ওপরে। সাধু-গুরু বাউলেরা ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীদের ভিড়ই বেশি। একতারা, দোতারা, ঢোল ও বাঁশির সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে লালনভূমি ছেঁউড়িয়া।
আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে মরা কালী নদী প্রাঙ্গণে বসেছে ৫ দিনের গ্রামীণ মেলা। সেখানে নানা পসরা নিয়ে বসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে আগত ব্যবসায়ীরা।
এদিকে লালনের তিরোধান দিবসে সাঁইজির বিভিন্ন আধ্যাত্মিক, দেহতত্ত্ব ও ভাবতত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান লেখক ও গবেষক প্রফেসর গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। এসময় তিনি ‘মানুষে মানুষ রতন’ এই ভাবার্থের সঙ্গে লালন সাঁইজির ‘প্রকৃত মানব সম্পদ’ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নিজেকে আগে ঠিক করতে হবে যে, তুমি কাশি যাবে নাকি মক্কায় যাবে। দোটানায় পড়ে জীবন কর্মের ধর্ম ভুলে সঠিক সত্য পথ্য হারিয়ে দিশেহারা হলে চলবে না। তাই সবার আগে পথ ঠিক করো তারপর মত।’
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়ায় লালন মঞ্চে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় ও লালন একাডেমির আয়োজনে বাউল সম্রাট সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রথমবারের মতো সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় ও লালন একাডেমির আয়োজনে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবসের তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শুরু হয়। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার কথা ছিল সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর। কিন্তু তিনি বিশেষ কারণে আসতে না পারায় ভিডিও বার্তায় আগত সাধু-গুরু ও দর্শনার্থীদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন এবং সাধু ভক্ত লালন অনুসারী-দর্শনার্থীদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান। অন্যান্যের মধ্যে বিশিষ্ট লালন গবেষক কবি ও চিন্তক ফরহাদ মাজহার ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রফেসর আ আল মামুন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক রেজা উদ্দিন ষ্টালিন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক প্রফেসর গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক আরো বলেন, মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইকে যুগে যুগে বাউল সম্রাট উল্লেখ করে তার মানবতার কল্যাণের ফকিরিবাদ মতামতকে ক্ষতি করে আসছে। বাউল শব্দটি কোনো অর্থ বহন করে না। বরং ফকিরদের সঙ্গে যুক্ত করে ফকিরিবাদ খাটো করেছে। ফকির লালন সাঁই মানব সেবার ব্রত নিয়ে অসংখ্য গান লিখে গেছেন। তার এই অমর সৃষ্টি সঙ্গীতে কখনই বাউল শব্দ ছিল না। তার গান কোনো ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
এসি/আপ্র/১৮/১০/২০২৫