নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের আর্থিক খাতের অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের অন্যতম হোতা প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) লোপাটের টাকা দিয়ে একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার তথ্য পাওয়া গেছে। লোপাট করা টাকার ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা শুধু তিনজন বান্ধবীর পেছনে খরচ করেছেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্যে উঠে এসেছে।
ঘনিষ্ঠ এই তিন বান্ধবীকে পি কে হালদারের ‘প্রেমিকা’ বলেও উল্লেখ করেছে দুদক। তারা হলেন- অবন্তিকা বড়াল, নাহিদা রুনাই ও শুভ্রা রানী ঘোষ। তারা তিনজনই এখন কারাগারে আছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে গ্রেপ্তার তার তিন বান্ধবীর জবানিতে মিলছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। এই তিন নারীকে বিলাসী জীবনে আকৃষ্ট করে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় কাটাতেন পি কে। বিনিময়ে তাদের কাউকে ফ্ল্যাট, গাড়ি, দামি উপহার ও অর্থ দিয়েছেন। অসংখ্যবার তাদেরকে নিয়ে গেছেন বিদেশ ভ্রমণে। তার প্রতিষ্ঠানে দিয়েছেন বড় পদের চাকরি। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে প্রকারেই হোক, অর্থ লোপাট আর প্রেমিকাদের নিয়ে ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকাই ছিল পি কে হালদারের অন্যমত নেশা। নারী সঙ্গ ছাড়া তিনি বিদেশ যেতেন না।
বান্ধবীদের মধ্যে নাহিদা রুনাইকে ১৫০ কোটি টাকা খরচ করে উপহার দিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও ফাস ফাইন্যান্স কোম্পানি। অবন্তিকাকে উপহার দিয়েছেন পিপলস লিজিং। আর এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাচার করেছেন ৩৬ কোটি টাকা। রুনাই চালাতেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও ফাস ফাইন্যান্স লিমিটেড। রুনাইয়ের অসীম ক্ষমতার উৎস ছিল পি কে হালদার। তাই অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কয়েক বছরে তার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৭২ কোটির টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। নাহিদা রুনাইকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ দিয়েছিলেন পি কে হালদার। তাকে নিয়ে ভারতে গেছেন ২২ বার। আর সিঙ্গাপুরে গেছেন ২৫ বার। তাকে ২০ কোটি টাকা দেয়ার তথ্যও পেয়েছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। এছাড়াও অবন্তিকার কর্তৃত্বে চলত পিপলস লিজিং। তাকে নিয়ে অসংখ্যবার সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড গেছে পি কে। অবন্তিকাকে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পাঁচ কোটি টাকায় ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে পি কে হালদারের অর্থপাচারের অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য বান্ধবীদের মধ্যে অনন্দিতাকে রাজধানীর উত্তরায় নয় তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে দিয়েছেন। সুস্মিতা সাহাকে দেওয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেনামি ঋণ, পাপিয়া ব্যানার্জি ও মমতাজের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা করে বেনামি ঋণ। আর দুর্নীতির আরেক সহযোগী ও বান্ধবী শুভ্রা রানী ঘোষকে অস্তিত্বহীন কোম্পানি ওয়াকামা ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান করেছেন পি কে। ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৮৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নাহিদা রুনাইকে গত বছরের ১৬ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর ১৩ জানুয়ারি নিজ ফ্ল্যাট থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন অবন্তিকা। শুভ্রা রানী ঘোষকে গ্রেপ্তার করা হয় গত বছরের ২২ মার্চ। ওই দিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরেছিলেন তিনি। এছাড়াও অসংখ্য নারীর সঙ্গে কোটি টাকা লোপাটের অন্যতম হোতা প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) সম্পর্ক রয়েছে বলেও জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
পি কে হালদারকে ফেরানোর বিষয়ে রুল শুনানি আজ : সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ ও পাচার করে পালিয়ে থাকা অবস্থায় ভারতে গ্রেপ্তার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার ওরফে পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রশ্নে হাইকোর্টের জারি করা রুলের শুনানি হবে আজ মঙ্গলবার।
গতকাল সোমবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ রুল শুনানির জন্য এই দিন ধার্য করেন। ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর জারি করা ওই রুলে পি কে হালদারকে দেশে আনতে এবং গ্রেপ্তারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়। এ বিষয়ে এত দিন শুনানি হয়নি।
ভারতে পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগর থেকে নাম বদলে আত্মগোপনে থাকা পি কে হালদারকে পাঁচ সহযোগীসহ গত শনিবার গ্রেপ্তার করে দেশটির অর্থ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী—ইডি। পরের দিন রবিবার সেখানকার আদালতের মাধ্যমে তাদের তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
সোমবার ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক ভারতে পি কে হালদারের গ্রেপ্তারের বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। পি কে হালদার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্ট বেঞ্চে রুল শনানির আবেদন করলে আদালত মঙ্গলবার দিন ঠিক করে দেয়। এ আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত বলেছেন অর্থপাচারকারী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আদালত আরও বলেন যে যতবড় রাঘব বোয়াল হোক না কেন, ছাড় দেওয়া হবে না। একইসঙ্গে এ ঘটনায় (গ্রেপ্তার) সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে আদালত।’
আদালতের বরাতে রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, ‘পি কে হালদারের গ্রেপ্তারের বিষয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, আমাদের মেসেজ ক্লিয়ার, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স। কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকারীকে প্রশ্রয় দেব না। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা এই বিষয়ে সিরিয়াস।’
পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা জটিল : আলোচিত রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পি কে হালদারকে ভারতে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পিকে হালদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি ৩৪টি মামলা করা হয়েছে। অভিযোগ ওঠার পরই দেশ থেকে পালিয়ে যান পিকে হালদার। পি কে হালদারকে দ্রুত দেশে ফেরত আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে দুদক। তার পাচার কার অর্থও ফেরত আনার চেষ্টা করছে সংস্থাটি। তবে তাকে বা পাচার করা অর্থ, কোনোটিই দ্রুত ফেরত আনা যাবে না বলেও মনে করছে সংস্থাটি।
গতকাল সোমবার পি কে হালদারের বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে জরুরি বৈঠক বসে দুদক। বৈঠক শেষে দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান সাংবাদিকদের বলেন, যে মামলায় চার্জশিট হয়েছে সে মামলায় পি কে হালদারের ওয়ারেন্ট অব অ্যারেস্ট ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। আমরা ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমাদের দিক থেকে প্রেসার থাকবে যে যত দ্রুত তাকে আমরা বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারি। এজন্য ভারতীয় সবার সঙ্গেই আমরা যোগাযোগ করবো। কতদিনের মধ্যে তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে এটা স্পেসেফিক বলা খুব কঠিন। ৪ মাস, ৬ মাস কত দিন লাগবে, কী পরিমাণ মামলা ভারতে হয়েছে, সেগুলোর বিচারে কতদিন লাগবে এটা বলা খুব কঠিন। তিনি আরও বলেন, নেপথ্যে যারা আছে তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে দুদক কোনো গড়িমসি করবে না। এটুকু নিশ্চিত যে মামলা করার মতো যদি পর্যাপ্ত তথ্য পাই মামলা করতে দুদক কোনো গড়িমসি করবে না। পি কে হালদার সংশ্লিষ্টতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এসকে সুর ও শাহ আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টাকা ফেরত আনার পদ্ধতি অনেক জটিল। আমরা আশাবাদী যে পি কে হালদাররের কাছ থেকে তথ্য পেলে মানিলন্ডারিং হয়ে যেসব সম্পদ দেশের বাইরে গেছে সেগুলো ফেরত আনা সম্ভব হবে।
পি কে হালদার আওয়ামী লীগের কেউ না: ওবায়দুল কাদের : সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, একাধিক অর্থ পাচার মামলার আসামি পি কে হালদার আওয়ামী লীগের কেউ না। তাঁর মতো লোকের জায়গা আওয়ামী লীগে হবে না। সোমবার দুপুরে মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
পি কে হালদারসহ অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করার যে কথা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তার সমালোচনা করেন ওবায়দুল কাদের। মির্জা ফখরুলের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ফখরুল সাহেব, আপনি কালো চশমা পরে বক্তব্য রাখছেন। অর্থ পাচারের আসামি বিএনপি নেত্রী ও আপনাদের মা, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এই তালিকার শীর্ষে আছেন। আওয়ামী লীগের কেউ অর্থ পাচার করলে শেখ হাসিনা কাউকে ছাড় দেন না। এর জ্বলন্ত উদাহরণ ফরিদপুর।’ মির্জা ফখরুলকে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোনো কথা বলবেন না। খুব বাড়াবাড়ি করছেন আপনি। প্রধানমন্ত্রীর নামটি উচ্চারণের সময়ও সম্মান দেখান না আপনি।’
তিন বান্ধবীর পেছনেই ৮০০ কোটি টাকা খরচ পি কে হালদারের
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ