ঢাকা ১২:৪৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫

তিন বছর পর দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

  • আপডেট সময় : ০৩:০০:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • ১২৭ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লি পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিন বছর পর তার এ দ্বিপক্ষীয় সফরে বাণিজ্য, জ্বালানি, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সহযোগিতার পাশাপাশি দুই দেশের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো আলোচ্যসূচিতে প্রাধান্য পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীরা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় নয়া দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান ভারতের রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা বিক্রম জারদোশ এবং ভারতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার মুহাম্মদ ইমরান। বিমানবন্দরে শেখ হাসিনার জন্য ছিল লাল গালিচা, একটি সাংস্কৃতিক দলের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সফরে ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং উপ-রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করবেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন। বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে সাতটি চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সঙ্কটের এই কালে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা হতে পারে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। এর বাইরে ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানেও যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন ভারতের শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি। এই সফর নিয়ে গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, জনযোগাযোগ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, নদীর অববাহিকাভিত্তিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত সুরক্ষা, নিরাপত্তা সহযোগিতা, মাদক চোরাচালান ও মানবপাচার রোধ গুরুত্ব পাবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়।
“বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ক গভীরতর হওয়াসহ সার্বিকভাবে এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে নতুন নতুন উদ্যোগ গৃহীত হবে। “এই সফর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ও বিদ্যমান গতিশীল সম্পর্ককে আরও সুসংহত করবে বলে আশা করা যায়।”
শেখ হাসিনার এই সফর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বহুমুখী সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী।
সোমবার ভারতের স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ভিভিআইপি চার্টার্ড ফ্লাইটটি নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান ভারতের রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা বিক্রম, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুহাম্মদ ইমরান ও বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। প্রধানমন্ত্রীকে লালগালিচা অভ্যর্থনা জানানোর মুহূর্তের কিছু ছবি টুইটারে পোস্ট করে অরিন্দম বাগচী লেখেন, এই সফর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান বহুমুখী সম্পর্ককে আরও দৃঢ়তর করবে। কোভিড-১৯ মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট বিশ্ব অর্থনীতিতে টেনে এনেছে মন্দা। যার জের খাদ্য-পোশাক থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ-জ্বালানি পর্যন্ত সবক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিবেশীসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের সহযোগিতার দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে ভুক্তভোগী দেশগুলোকে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর এ সফরকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
ঢাকার কূটনীতিকরা আশা করছেন, এ সফরে দুদেশের মধ্যে এমন কিছু পারস্পরিক সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বা নীতি নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এ সফরে সরকারপ্রধান পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পাশাপাশি যেসব শীর্ষ বৈঠক হবে, সেখানে উভয়পক্ষের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সব বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে। যার মধ্যে থাকবে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সহযোগিতা, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, উন্নয়ন সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এবং মানুষে মানুষে যোগাযোগের বিষয়ও। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদির পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান অস্থিতিশীলতা ও ক্ষতিগ্রস্ত সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়েও আলোচনা হবে বৈঠকে। সূত্র মতে, ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিতে সর্বাগ্রে থাকে বাংলাদেশ। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতেও সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সবার আগে বিবেচনা করে নয়াদিল্লি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তারই কিছু দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে।
সফর সূচি : সোমবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন জয়শঙ্কর। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী যান নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায়। সেখান থেকে ফেরার পর বৈঠক করেন আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানির সঙ্গে। পরে রাতে বাংলাদেশ হাই কমিশনে হাই কমিশনারের দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজ মঙ্গলবার সকালেই ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানাবেন নরেন্দ্র মোদী। সেখানে শেখ হাসিনা গান স্যালুট গ্রহণ করবেন এবং আনুষ্ঠানিক গার্ড অব অনার পরিদর্শন করবেন। এরপর রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে শেখ হাসিনা যাবেন হায়দ্রাবাদ হাউজে। সেখানে মোদীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করবেন তিনি। তারা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন। এরপর দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে। কর্মসূচি শেষে সেখানে মোদীর দেওয়া মধ্যাহ্ন ভোজে যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। বিকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং উপ রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে দেখা করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
আগামীকাল বুধবার সকালে ভারতের উন্নয়নমন্ত্রী কিষাণ রেড্ডি দেখা করবেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। এরপর বাংলাদেশ-ভারত ব্যবসায়ী ফোরামের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্টুডেন্ট স্কলারশিপ’ প্রধান অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। ঢাকা ফেরার আগে বৃহস্পতিবার বিমানে জয়পুর যাবেন শেখ হাসিনা; সেখান থেকে যাবেন আজমির শরিফ জিয়ারত করতে।
প্রোটোকল মেনেই দিল্লিতে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিল্লি বিমানবন্দরে কেন ভারতের একজন প্রতিমন্ত্রী স্বাগত জানালেন, তা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় হইচই শুরু হলেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, প্রোটোকল অনুযায়ী একজন সফররত সরকারপ্রধানকে যে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়ার কথা, সেটাই কিন্তু শেখ হাসিনাকে দেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে শেখ হাসিনার আগের বারের দিল্লি সফরেও (অক্টোবর ২০১৯) বিমানবন্দরে যাননি, সেটাও তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ‘ফলে এমন নয় যে এবারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অভ্যর্থনায় কোনও ত্রুটি হয়েছে বা প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে না গিয়ে অতিথিকে কোনও অমর্যাদা করেছেন।’ বলছেন সাউথ ব্লকে প্রোটোকল বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা।
নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার দিল্লি এসেছিলেন ২০১৭ সালের এপ্রিলে। সেই রাষ্ট্রীয় সফরেও বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীকে-আর তিনি ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় নগর উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ও সংগীতশিল্পী বাবুল সুপ্রিয়। আসানসোল আসন থেকে জিতে তখন বিজেপির এমপি ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়ে যান শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে। সেটা অনেকটাই ব্যক্তিগত হৃদ্যতার খাতিরে, তবে রুটিন অনুযায়ী অভ্যর্থনার দায়িত্ব পালন করেন বাবুল সুপ্রিয়ই।
‘দুই প্রধানমন্ত্রীর আমলে সেটা ছিল দিল্লিতে শেখ হাসিনার প্রথম সফর, তার একটা অন্যরকম ব্যঞ্জনা ছিল বলেই প্রোটোকল ভেঙে একটা ব্যতিক্রম স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি’- বলছিলেন ওই কর্মকর্তা।
তার আড়াই বছর পর শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের অক্টোবরে যখন আবার দিল্লিতে আসেন, তখন বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানানোর দায়িত্ব পান আরেকজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত বিজেপি এমপি দেবশ্রী চৌধুরী। সেবার কিন্তু নরেন্দ্র মোদি নিজে আর বিমানবন্দরে আসেননি। প্রোটোকলের রীতি অনুযায়ী এবারও একজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তিনি হলেন ভারতের কেন্দ্রীয় রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা বিক্রম জারদোশ। তিনি সুরাট থেকে নির্বাচিত বিজেপির এমপি। ‘গত দুবার যে মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তারা দুজনেই ছিলেন বাঙালি। আর এবারে একজন গুজরাটি মন্ত্রী তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। পার্থক্য যদি বলেন- তা শুধু এটুকুই।’ হাসতে হাসতে যোগ করছেন ভারতীয় ওই কর্মকর্তা।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

তিন বছর পর দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

আপডেট সময় : ০৩:০০:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

প্রত্যাশা ডেস্ক : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লি পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিন বছর পর তার এ দ্বিপক্ষীয় সফরে বাণিজ্য, জ্বালানি, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সহযোগিতার পাশাপাশি দুই দেশের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো আলোচ্যসূচিতে প্রাধান্য পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীরা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় নয়া দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান ভারতের রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা বিক্রম জারদোশ এবং ভারতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার মুহাম্মদ ইমরান। বিমানবন্দরে শেখ হাসিনার জন্য ছিল লাল গালিচা, একটি সাংস্কৃতিক দলের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সফরে ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং উপ-রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করবেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন। বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে সাতটি চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সঙ্কটের এই কালে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা হতে পারে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। এর বাইরে ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানেও যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন ভারতের শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি। এই সফর নিয়ে গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, জনযোগাযোগ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, নদীর অববাহিকাভিত্তিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত সুরক্ষা, নিরাপত্তা সহযোগিতা, মাদক চোরাচালান ও মানবপাচার রোধ গুরুত্ব পাবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়।
“বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ক গভীরতর হওয়াসহ সার্বিকভাবে এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে নতুন নতুন উদ্যোগ গৃহীত হবে। “এই সফর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ও বিদ্যমান গতিশীল সম্পর্ককে আরও সুসংহত করবে বলে আশা করা যায়।”
শেখ হাসিনার এই সফর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বহুমুখী সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী।
সোমবার ভারতের স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ভিভিআইপি চার্টার্ড ফ্লাইটটি নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান ভারতের রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা বিক্রম, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুহাম্মদ ইমরান ও বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। প্রধানমন্ত্রীকে লালগালিচা অভ্যর্থনা জানানোর মুহূর্তের কিছু ছবি টুইটারে পোস্ট করে অরিন্দম বাগচী লেখেন, এই সফর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান বহুমুখী সম্পর্ককে আরও দৃঢ়তর করবে। কোভিড-১৯ মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট বিশ্ব অর্থনীতিতে টেনে এনেছে মন্দা। যার জের খাদ্য-পোশাক থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ-জ্বালানি পর্যন্ত সবক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিবেশীসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের সহযোগিতার দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে ভুক্তভোগী দেশগুলোকে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর এ সফরকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
ঢাকার কূটনীতিকরা আশা করছেন, এ সফরে দুদেশের মধ্যে এমন কিছু পারস্পরিক সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বা নীতি নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এ সফরে সরকারপ্রধান পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পাশাপাশি যেসব শীর্ষ বৈঠক হবে, সেখানে উভয়পক্ষের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সব বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে। যার মধ্যে থাকবে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সহযোগিতা, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, উন্নয়ন সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এবং মানুষে মানুষে যোগাযোগের বিষয়ও। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদির পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান অস্থিতিশীলতা ও ক্ষতিগ্রস্ত সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়েও আলোচনা হবে বৈঠকে। সূত্র মতে, ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিতে সর্বাগ্রে থাকে বাংলাদেশ। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতেও সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সবার আগে বিবেচনা করে নয়াদিল্লি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তারই কিছু দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে।
সফর সূচি : সোমবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন জয়শঙ্কর। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী যান নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায়। সেখান থেকে ফেরার পর বৈঠক করেন আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানির সঙ্গে। পরে রাতে বাংলাদেশ হাই কমিশনে হাই কমিশনারের দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজ মঙ্গলবার সকালেই ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানাবেন নরেন্দ্র মোদী। সেখানে শেখ হাসিনা গান স্যালুট গ্রহণ করবেন এবং আনুষ্ঠানিক গার্ড অব অনার পরিদর্শন করবেন। এরপর রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে শেখ হাসিনা যাবেন হায়দ্রাবাদ হাউজে। সেখানে মোদীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করবেন তিনি। তারা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন। এরপর দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে। কর্মসূচি শেষে সেখানে মোদীর দেওয়া মধ্যাহ্ন ভোজে যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। বিকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং উপ রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে দেখা করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
আগামীকাল বুধবার সকালে ভারতের উন্নয়নমন্ত্রী কিষাণ রেড্ডি দেখা করবেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। এরপর বাংলাদেশ-ভারত ব্যবসায়ী ফোরামের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্টুডেন্ট স্কলারশিপ’ প্রধান অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। ঢাকা ফেরার আগে বৃহস্পতিবার বিমানে জয়পুর যাবেন শেখ হাসিনা; সেখান থেকে যাবেন আজমির শরিফ জিয়ারত করতে।
প্রোটোকল মেনেই দিল্লিতে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিল্লি বিমানবন্দরে কেন ভারতের একজন প্রতিমন্ত্রী স্বাগত জানালেন, তা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় হইচই শুরু হলেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, প্রোটোকল অনুযায়ী একজন সফররত সরকারপ্রধানকে যে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়ার কথা, সেটাই কিন্তু শেখ হাসিনাকে দেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে শেখ হাসিনার আগের বারের দিল্লি সফরেও (অক্টোবর ২০১৯) বিমানবন্দরে যাননি, সেটাও তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ‘ফলে এমন নয় যে এবারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অভ্যর্থনায় কোনও ত্রুটি হয়েছে বা প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে না গিয়ে অতিথিকে কোনও অমর্যাদা করেছেন।’ বলছেন সাউথ ব্লকে প্রোটোকল বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা।
নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার দিল্লি এসেছিলেন ২০১৭ সালের এপ্রিলে। সেই রাষ্ট্রীয় সফরেও বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীকে-আর তিনি ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় নগর উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ও সংগীতশিল্পী বাবুল সুপ্রিয়। আসানসোল আসন থেকে জিতে তখন বিজেপির এমপি ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়ে যান শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে। সেটা অনেকটাই ব্যক্তিগত হৃদ্যতার খাতিরে, তবে রুটিন অনুযায়ী অভ্যর্থনার দায়িত্ব পালন করেন বাবুল সুপ্রিয়ই।
‘দুই প্রধানমন্ত্রীর আমলে সেটা ছিল দিল্লিতে শেখ হাসিনার প্রথম সফর, তার একটা অন্যরকম ব্যঞ্জনা ছিল বলেই প্রোটোকল ভেঙে একটা ব্যতিক্রম স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি’- বলছিলেন ওই কর্মকর্তা।
তার আড়াই বছর পর শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের অক্টোবরে যখন আবার দিল্লিতে আসেন, তখন বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানানোর দায়িত্ব পান আরেকজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত বিজেপি এমপি দেবশ্রী চৌধুরী। সেবার কিন্তু নরেন্দ্র মোদি নিজে আর বিমানবন্দরে আসেননি। প্রোটোকলের রীতি অনুযায়ী এবারও একজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তিনি হলেন ভারতের কেন্দ্রীয় রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা বিক্রম জারদোশ। তিনি সুরাট থেকে নির্বাচিত বিজেপির এমপি। ‘গত দুবার যে মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তারা দুজনেই ছিলেন বাঙালি। আর এবারে একজন গুজরাটি মন্ত্রী তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। পার্থক্য যদি বলেন- তা শুধু এটুকুই।’ হাসতে হাসতে যোগ করছেন ভারতীয় ওই কর্মকর্তা।