ঢাকা ০২:১৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

তালেবানের দখলে আফগানিস্তান, এক গনিকে সরিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে আরেক গনি?

  • আপডেট সময় : ০২:২২:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ অগাস্ট ২০২১
  • ৫৮ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : ক্ষমতার হস্তান্তর হয়ে গেল আফগানিস্তানে। তালেবান নেতাদের সঙ্গে মাত্র ৪৫ মিনিট বৈঠকের পরেই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করলেন আশরাফ গনি। তাঁর জায়গায় এবার আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন আরেক গনি, মোল্লা আব্দুল গনি বরাদর। বর্তমানে আফগানিস্তানে তালেবানের প্রধান তিনি। গতকাল রোববার সকালে আশরাফ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবীদদের সঙ্গে সমঝোতা করতে তিনিও প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হাজির ছিলেন। খবর আনন্দবাজারের।
গত শনিবার রাতে উত্তরের মাজার-ই-শরিফ দখলের পর থেকেই কাবুলের পতনের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছিল। গতকাল রোববার সকালে জালালাবাদ দখল করে নেয় তালেবান। তারপর রাজধানী কাবুলেও দলে দলে প্রবেশ করতে শুরু করে তারা। যদিও দলীয় নেতৃত্বের নির্দেশে কাবুলে ঢোকার মুখেই থমকে যেতে হয় তাঁদের। এরপর সরাসরি আশরাফ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবিদদের সঙ্গে সমঝোতা চান বলে দাবি করেন তালেবান নেতৃত্ব। জানিয়ে দেন, গায়ের জোরে কাবুল দখল করতে চান না তাঁরা। শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর চান।
এর পরেই মার্কিন কূটনীতিবিদ এবং ন্যাটো প্রতিনিধিদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন আশরাফ। তারপর বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় তালেবান নেতৃত্বকে। সেই মতো মোল্লা আবদুল গনি বরাদরের নেতৃত্বে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের উদ্দেশে রওনা দেয় তালিবানের একটি প্রতিনিধি দল। সেখানে তাঁদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন আশরাফ। নতুন তালেবান অন্তর্র্বতী সরকারের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন তালেবান সংগঠনের প্রধান।
১৯৯৪ সালে তালেবান আন্দোলনের হোতাদের মধ্যে অন্যতম এই মোল্লা আবদুল গনি বরাদর। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর, যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী যে আন্দোলন শুরু হয়, তার চালকের আসনে ছিলেন গনি। ২০১০ সালে আমেরিকা এবং পাকিস্তানের যৌথ অভিযানে করাচিতে ধরাও পড়েন তিনি। তারপর থেকে সেভাবে জনসমক্ষে দেখা যায়নি তাঁকে। কিন্তু ২০১২ সালে আফগান সরকার যে সমস্ত তালেবান বন্দিদের মুক্তি নিয়ে উদ্যোগী হয়, তাতে গনির নাম একেবারে উপরের দিকে উঠে আসে। সে বছর ২১ সেপ্টেম্বর গনিকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান।যদিও তালেবান তা স্বীকার করে ২০১৮ সালে। তারপর থেকেই তাঁর সঙ্গে শান্তি স্থাপন নিয়ে আলোচনা শুরু করতে উদ্যোগী হয় তৎকালীন আফগান সরকার। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, তাদের অনুরোধেই গনিকে ছেড়েছে পাকিস্তান।
গত জুলাই মাসে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তালেবান প্রধান গনি। সেই সময় ওয়াং বলেন, ‘প্রতিবেশী হিসেবে আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অখ-তাকে সম্মান করে চীন। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের কারও হস্তক্ষেপ একেবারেই কাম্য নয়। আফগানবাসীদের চীন বন্ধু ভাবে। আফগানিস্তানের উপর একমাত্র অধিকার সে দেশের মানুষের। তাই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎও তাঁরাই ঠিক করবেন। আমেরিকা এবং ন্যাটো যেভাবে তাড়াহুড়ো করে সেনা তুলে নিল, এতে তাদের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হচ্ছে।’
সবার জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা তালেবানের : বর্তমান আফগান প্রশাসনের বিভিন্ন পদে কর্মরত অথবা অতীতে পশ্চিমাদের পক্ষে কাজ করা সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের দ্বারপ্রান্তে থাকা তালেবান। রোববার সশস্ত্র গোষ্ঠীর মুখপাত্র সুহেইল শাহীন এক টুইটে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যারা এর আগে ‘আগ্রাসনবাদীদের’ জন্য কাজ করেছেন বা তাদের সাহায্য করেছেন অথবা এখন যারা ‘দুর্নীতিবাজ’ কাবুল প্রশাসনের বিভিন্ন পদে কর্মরত– আইইএ (ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান) তাদের সবার জন্য দরজা খোলা রেখেছে এবং এরই মধ্যে ক্ষমা ঘোষণা করেছে। আমরা তাদের আরেকবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, যেন তারা দেশ ও জাতির সেবায় কাজ করতে এগিয়ে আসেন। এর আগে সশস্ত্র গোষ্ঠীর এ মুখপাত্র বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমরা আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি এবং অন্য নেতাদের আমাদের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। তালেবান নারীদের বিষয়ে আগের রক্ষণশীল অবস্থা থেকে সরে আসবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। শাহীন বলেছেন, আফগান নারীরা চাইলে বাড়ির বাইরে বের হতে পারবেন, তবে অবশ্যই হিজাব পরতে হবে। তিনি আরও জানান, তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর গণমাধ্যমকে সমালোচনা করার অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু সচেতনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধের বিচার আদালত পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। তালেবানের এই মুখপাত্র বলেন, আমি কাবুলের বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করছি, তাদের সম্পত্তি, বাড়িঘর এমনকি জীবন নিরাপদ থাকবে।
ঘটনাক্রম: আফগানিস্তানজুড়ে তালেবানের তড়িৎ অগ্রগতি : আফগানিস্তানের প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তালেবান বিদ্রোহীরা এখন রাজধানী কাবুলে প্রবেশ করছে আর রক্তপাত এড়াতে ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের’ ঘোষণা এসেছে সরকারের তরফ থেকে।
গতকাল রোববারের এসব ঘটনার আগে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কিছু বড় ধরনের মাইলফলক পার হয়ে এসেছে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি। এ সময় বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী হামলাও হয়েছে, যার কয়েকটি জন্য তালেবানকে ও অন্যগুলোর জন্য ইসলামিক স্টেটসহ (আইএস) বেশ কয়েকটি কট্টরপন্থি গোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়েছে।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যস্থতায় তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে শান্তি চুক্তি করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেই প্রচেষ্টা কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।
১৪ এপ্রিল: ১ মে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়ে ১১ সেপ্টেম্বর শেষ হবে বলে ঘোষণা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। তার এ ঘোষণার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম লড়াই শেষ হয়। তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের হওয়া সমঝোতায় অনুযায়ী ১ মে-র মধ্যে দেশটি থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা ছিল, পরে সেই সময়টিকেই কিছুটা বাড়িয়ে নেন বাইডেন।
৪ মে: দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশে আফগান বাহিনীগুলো ওপর বড় ধরনের হামলা শুরু করে তালেবান। আরও অন্তত ছয়টি প্রদেশেও এ ধরনের হামলা শুরু করে তারা।
১১ মে: সারা দেশে সহিংসতা বৃদ্ধির মধ্যে তালেবান রাজধানী কাবুলের পার্শ্ববর্তী নেরখ জেলা দখল করে নেয়।
৭ জুন: ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা জানান তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় দেড়শরও বেশি আফগান সৈন্য নিহত হয়েছেন। তারা আরও জানান, দেশের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ২৬টিতে লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে।
২২ জুন: দক্ষিণে তাদের ঐতিহ্যগত শক্তিকেন্দ্র থেকে বহু দূরে দেশটির উত্তরাঞ্চলে ধারাবাহিক হামলা শুরু করে তালেবান যোদ্ধারা। আফগানিস্তানে নিযুক্ত জাতিসংঘের দূত জানান, ৩৭০টি জেলার মধ্যে ৫০টিরও বেশির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান।
২ জুলাই: আফগানিস্তানে তাদের প্রধান ঘাঁটি বাগরাম বিমান ঘাঁটি ছেড়ে চুপচাপ চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা। এর মাধ্যমে মার্কিন বাহিনীর আফগান যুদ্ধে কার্যকরভাবে জড়িত থাকার অবসান ঘটে।
৫ জুলাই: তালেবান জানায়, তারা অগাস্টের মধ্যে আফগান সরকারের কাছে একটি লিখিত শান্তি প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে।
২১ জুলাই: যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ জেনারেল জানান, আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক জেলা তালেবান বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এতে তালেবানের অগ্রগতির মাত্রা ও দ্রুত অগ্রসর হওয়ার বিষয়টি লক্ষ্যনীয় হয়ে ওঠে।
২৫ জুলাই: তালেবান হামলার জবাবে বিমান হামলা আরও জোরদার করে ‘আসছে সপ্তাহগুলোতেও’ আফগান সৈন্যদের সাহায্য করার মাধ্যমে তাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রত্যয় জানায় যুক্তরাষ্ট্র।
২৬ জুলাই: জাতিসংঘ জানায়, চলতি বছর তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে মে ও জুন মাসে প্রায় দুই হাজার ৪০০ আফগান বেসামরিক হতাহত হয়েছেন; ২০০৯ সাল থেকে রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে এ দুই মাসে এটিই হতাহতের সর্বোচ্চ সংখ্যা।
৬ আগস্ট: কয়েক বছরের মধ্যে প্রথম প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে তালেবানের হাতে জারাঞ্জের পতন। পরবর্তী কয়েকদিনে তারা অনেকগুলো প্রাদেশিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেয় যার মধ্যে উত্তরের কুন্দুজ অন্যতম।
১৩ অগাস্ট: একদিনে চারটি প্রাদেশিক রাজধানীর পতন। এর মধ্যে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহার এবং পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর হেরাতও আছে। তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া অভিজ্ঞ কমান্ডার মোহাম্মদ ইসমাইল খানকে আটক করে বিদ্রোহীরা।
১৪ আগস্ট: তালেবান উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর মাজার-ই-শরিফ এবং তেমন কোনো বাধা ছাড়াই কাবুলের ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে লোগার প্রদেশের রাজধানী পুল-ই-আলম দখল করে নেয়। কাবুল থেকে তাদের বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে আনতে সহায়তা করার জন্য সেখানে আরও সৈন্য পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে তা নিয়ে স্থানীয় নেতা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ করছেন বলে জানান আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি।
১৫ আগস্ট: তালেবান কোনো লড়াই ছাড়াই পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর জালালাবাদ দখল করে নিয়ে কাবুলকে কার্যত ঘিরে ফেলে। দিনের পরবর্তী সময় তারা রাজধানী কাবুলে প্রবেশ করতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র হেলিকপ্টার যোগে তাদের দূতাবাস থেকে কূটনীতিকদের সরিয়ে আনে। তালেবান যোদ্ধারা কাবুলে প্রবেশের পর রক্তপাত এড়াতে ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের’ ঘোষণা আসে সরকারের তরফ থেকে।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ডিসেম্বর ধরেই নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি

তালেবানের দখলে আফগানিস্তান, এক গনিকে সরিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে আরেক গনি?

আপডেট সময় : ০২:২২:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ অগাস্ট ২০২১

প্রত্যাশা ডেস্ক : ক্ষমতার হস্তান্তর হয়ে গেল আফগানিস্তানে। তালেবান নেতাদের সঙ্গে মাত্র ৪৫ মিনিট বৈঠকের পরেই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করলেন আশরাফ গনি। তাঁর জায়গায় এবার আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন আরেক গনি, মোল্লা আব্দুল গনি বরাদর। বর্তমানে আফগানিস্তানে তালেবানের প্রধান তিনি। গতকাল রোববার সকালে আশরাফ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবীদদের সঙ্গে সমঝোতা করতে তিনিও প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হাজির ছিলেন। খবর আনন্দবাজারের।
গত শনিবার রাতে উত্তরের মাজার-ই-শরিফ দখলের পর থেকেই কাবুলের পতনের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছিল। গতকাল রোববার সকালে জালালাবাদ দখল করে নেয় তালেবান। তারপর রাজধানী কাবুলেও দলে দলে প্রবেশ করতে শুরু করে তারা। যদিও দলীয় নেতৃত্বের নির্দেশে কাবুলে ঢোকার মুখেই থমকে যেতে হয় তাঁদের। এরপর সরাসরি আশরাফ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবিদদের সঙ্গে সমঝোতা চান বলে দাবি করেন তালেবান নেতৃত্ব। জানিয়ে দেন, গায়ের জোরে কাবুল দখল করতে চান না তাঁরা। শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর চান।
এর পরেই মার্কিন কূটনীতিবিদ এবং ন্যাটো প্রতিনিধিদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন আশরাফ। তারপর বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় তালেবান নেতৃত্বকে। সেই মতো মোল্লা আবদুল গনি বরাদরের নেতৃত্বে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের উদ্দেশে রওনা দেয় তালিবানের একটি প্রতিনিধি দল। সেখানে তাঁদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন আশরাফ। নতুন তালেবান অন্তর্র্বতী সরকারের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন তালেবান সংগঠনের প্রধান।
১৯৯৪ সালে তালেবান আন্দোলনের হোতাদের মধ্যে অন্যতম এই মোল্লা আবদুল গনি বরাদর। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর, যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী যে আন্দোলন শুরু হয়, তার চালকের আসনে ছিলেন গনি। ২০১০ সালে আমেরিকা এবং পাকিস্তানের যৌথ অভিযানে করাচিতে ধরাও পড়েন তিনি। তারপর থেকে সেভাবে জনসমক্ষে দেখা যায়নি তাঁকে। কিন্তু ২০১২ সালে আফগান সরকার যে সমস্ত তালেবান বন্দিদের মুক্তি নিয়ে উদ্যোগী হয়, তাতে গনির নাম একেবারে উপরের দিকে উঠে আসে। সে বছর ২১ সেপ্টেম্বর গনিকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান।যদিও তালেবান তা স্বীকার করে ২০১৮ সালে। তারপর থেকেই তাঁর সঙ্গে শান্তি স্থাপন নিয়ে আলোচনা শুরু করতে উদ্যোগী হয় তৎকালীন আফগান সরকার। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, তাদের অনুরোধেই গনিকে ছেড়েছে পাকিস্তান।
গত জুলাই মাসে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তালেবান প্রধান গনি। সেই সময় ওয়াং বলেন, ‘প্রতিবেশী হিসেবে আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অখ-তাকে সম্মান করে চীন। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের কারও হস্তক্ষেপ একেবারেই কাম্য নয়। আফগানবাসীদের চীন বন্ধু ভাবে। আফগানিস্তানের উপর একমাত্র অধিকার সে দেশের মানুষের। তাই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎও তাঁরাই ঠিক করবেন। আমেরিকা এবং ন্যাটো যেভাবে তাড়াহুড়ো করে সেনা তুলে নিল, এতে তাদের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হচ্ছে।’
সবার জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা তালেবানের : বর্তমান আফগান প্রশাসনের বিভিন্ন পদে কর্মরত অথবা অতীতে পশ্চিমাদের পক্ষে কাজ করা সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের দ্বারপ্রান্তে থাকা তালেবান। রোববার সশস্ত্র গোষ্ঠীর মুখপাত্র সুহেইল শাহীন এক টুইটে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যারা এর আগে ‘আগ্রাসনবাদীদের’ জন্য কাজ করেছেন বা তাদের সাহায্য করেছেন অথবা এখন যারা ‘দুর্নীতিবাজ’ কাবুল প্রশাসনের বিভিন্ন পদে কর্মরত– আইইএ (ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান) তাদের সবার জন্য দরজা খোলা রেখেছে এবং এরই মধ্যে ক্ষমা ঘোষণা করেছে। আমরা তাদের আরেকবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, যেন তারা দেশ ও জাতির সেবায় কাজ করতে এগিয়ে আসেন। এর আগে সশস্ত্র গোষ্ঠীর এ মুখপাত্র বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমরা আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি এবং অন্য নেতাদের আমাদের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। তালেবান নারীদের বিষয়ে আগের রক্ষণশীল অবস্থা থেকে সরে আসবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। শাহীন বলেছেন, আফগান নারীরা চাইলে বাড়ির বাইরে বের হতে পারবেন, তবে অবশ্যই হিজাব পরতে হবে। তিনি আরও জানান, তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর গণমাধ্যমকে সমালোচনা করার অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু সচেতনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধের বিচার আদালত পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। তালেবানের এই মুখপাত্র বলেন, আমি কাবুলের বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করছি, তাদের সম্পত্তি, বাড়িঘর এমনকি জীবন নিরাপদ থাকবে।
ঘটনাক্রম: আফগানিস্তানজুড়ে তালেবানের তড়িৎ অগ্রগতি : আফগানিস্তানের প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তালেবান বিদ্রোহীরা এখন রাজধানী কাবুলে প্রবেশ করছে আর রক্তপাত এড়াতে ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের’ ঘোষণা এসেছে সরকারের তরফ থেকে।
গতকাল রোববারের এসব ঘটনার আগে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কিছু বড় ধরনের মাইলফলক পার হয়ে এসেছে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি। এ সময় বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী হামলাও হয়েছে, যার কয়েকটি জন্য তালেবানকে ও অন্যগুলোর জন্য ইসলামিক স্টেটসহ (আইএস) বেশ কয়েকটি কট্টরপন্থি গোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়েছে।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যস্থতায় তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে শান্তি চুক্তি করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেই প্রচেষ্টা কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।
১৪ এপ্রিল: ১ মে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়ে ১১ সেপ্টেম্বর শেষ হবে বলে ঘোষণা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। তার এ ঘোষণার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম লড়াই শেষ হয়। তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের হওয়া সমঝোতায় অনুযায়ী ১ মে-র মধ্যে দেশটি থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা ছিল, পরে সেই সময়টিকেই কিছুটা বাড়িয়ে নেন বাইডেন।
৪ মে: দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশে আফগান বাহিনীগুলো ওপর বড় ধরনের হামলা শুরু করে তালেবান। আরও অন্তত ছয়টি প্রদেশেও এ ধরনের হামলা শুরু করে তারা।
১১ মে: সারা দেশে সহিংসতা বৃদ্ধির মধ্যে তালেবান রাজধানী কাবুলের পার্শ্ববর্তী নেরখ জেলা দখল করে নেয়।
৭ জুন: ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা জানান তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় দেড়শরও বেশি আফগান সৈন্য নিহত হয়েছেন। তারা আরও জানান, দেশের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ২৬টিতে লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে।
২২ জুন: দক্ষিণে তাদের ঐতিহ্যগত শক্তিকেন্দ্র থেকে বহু দূরে দেশটির উত্তরাঞ্চলে ধারাবাহিক হামলা শুরু করে তালেবান যোদ্ধারা। আফগানিস্তানে নিযুক্ত জাতিসংঘের দূত জানান, ৩৭০টি জেলার মধ্যে ৫০টিরও বেশির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান।
২ জুলাই: আফগানিস্তানে তাদের প্রধান ঘাঁটি বাগরাম বিমান ঘাঁটি ছেড়ে চুপচাপ চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা। এর মাধ্যমে মার্কিন বাহিনীর আফগান যুদ্ধে কার্যকরভাবে জড়িত থাকার অবসান ঘটে।
৫ জুলাই: তালেবান জানায়, তারা অগাস্টের মধ্যে আফগান সরকারের কাছে একটি লিখিত শান্তি প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে।
২১ জুলাই: যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ জেনারেল জানান, আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক জেলা তালেবান বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এতে তালেবানের অগ্রগতির মাত্রা ও দ্রুত অগ্রসর হওয়ার বিষয়টি লক্ষ্যনীয় হয়ে ওঠে।
২৫ জুলাই: তালেবান হামলার জবাবে বিমান হামলা আরও জোরদার করে ‘আসছে সপ্তাহগুলোতেও’ আফগান সৈন্যদের সাহায্য করার মাধ্যমে তাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রত্যয় জানায় যুক্তরাষ্ট্র।
২৬ জুলাই: জাতিসংঘ জানায়, চলতি বছর তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে মে ও জুন মাসে প্রায় দুই হাজার ৪০০ আফগান বেসামরিক হতাহত হয়েছেন; ২০০৯ সাল থেকে রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে এ দুই মাসে এটিই হতাহতের সর্বোচ্চ সংখ্যা।
৬ আগস্ট: কয়েক বছরের মধ্যে প্রথম প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে তালেবানের হাতে জারাঞ্জের পতন। পরবর্তী কয়েকদিনে তারা অনেকগুলো প্রাদেশিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেয় যার মধ্যে উত্তরের কুন্দুজ অন্যতম।
১৩ অগাস্ট: একদিনে চারটি প্রাদেশিক রাজধানীর পতন। এর মধ্যে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহার এবং পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর হেরাতও আছে। তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া অভিজ্ঞ কমান্ডার মোহাম্মদ ইসমাইল খানকে আটক করে বিদ্রোহীরা।
১৪ আগস্ট: তালেবান উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর মাজার-ই-শরিফ এবং তেমন কোনো বাধা ছাড়াই কাবুলের ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে লোগার প্রদেশের রাজধানী পুল-ই-আলম দখল করে নেয়। কাবুল থেকে তাদের বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে আনতে সহায়তা করার জন্য সেখানে আরও সৈন্য পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে তা নিয়ে স্থানীয় নেতা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ করছেন বলে জানান আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি।
১৫ আগস্ট: তালেবান কোনো লড়াই ছাড়াই পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর জালালাবাদ দখল করে নিয়ে কাবুলকে কার্যত ঘিরে ফেলে। দিনের পরবর্তী সময় তারা রাজধানী কাবুলে প্রবেশ করতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র হেলিকপ্টার যোগে তাদের দূতাবাস থেকে কূটনীতিকদের সরিয়ে আনে। তালেবান যোদ্ধারা কাবুলে প্রবেশের পর রক্তপাত এড়াতে ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের’ ঘোষণা আসে সরকারের তরফ থেকে।