নিজস্ব প্রতিবেদক : স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গাইডলাইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামীকাল সোমবার (১৫ নভেম্বর) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক আহ্বান করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ।
ইতোমধ্যে সভায় অংশ নিতে অংশিজনদের কাছে আমন্ত্রণ-বিষয়ক চিঠিও পাঠানো হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছে সরকার। বিষয়টি তামাকবিরোধী কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্তদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা তৈরি করেছে বলে জানা গেছে। তারা তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকটি বাতিলের দাবি জানিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সবিবের কাছে চিঠিও দিয়েছেন। স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, চলতি নভেম্বরের ৯ তারিখ স্থানীয় সরকার সচিবকে লেখা চিঠিতে আবেদনকারী হিসেবে জাতীয় যক্ষ্মা নিরোধ সমিতির (নাটাব) সভাপতি মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বাংলাদেশ আহছানিয়া মিশনের সভাপতি কাজী রফিকুল আলম, বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকি ও উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতারের স্বাক্ষর রয়েছে।
তারা চিঠিতে বলেছেন, আগামী ১৫ নভেম্বর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইন-বিষয়ক সভায় তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানোর সংবাদে তারা উৎকন্ঠিত।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ (১) এবং স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ এর তফসিল ১ ও ৫ অনুসারে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ‘স্থানীয় সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইড লাইন’ আপনার মন্ত্রণালয়ের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। সরকারের ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের এ উদ্যোগ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সুনাম কুড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে (এফসিটিসি) প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ। এ চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জনস্বাস্থ্য নীতি বিষয়ে তামাক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সভা ও আলোচনা এ চুক্তির পরিপন্থী। কারণ, তামাক কোম্পানিগুলো সরকারের জনস্বাস্থ্য রক্ষার চেষ্টাকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত করে। সরকারের উদ্দেশে তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনা, আর কোম্পানি মুনাফার স্বার্থে সরকারের এই জনস্বার্থমূলক কাজে বাধার সৃষ্টি করে। তাদের লক্ষ্য তামাক সেবন বাড়ানো। বিশেষ করে যুব সমাজকে ধূমপানে আকৃষ্ট করতে কাজ করে। তাই সরকার ও তামাক কোম্পানির উদ্দেশ্য পরস্পর সাংঘর্ষিক। আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর আর্টিকেল ৫.৩ তে জনস্বাস্থ্য রক্ষার নীতিকে সুরক্ষায় বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।
তারা চিঠিতে আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তির আর্টিকেল ৫.৩ অনুসারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের সভার আয়োজন হতে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রণীত স্থানীয় সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইনের বাস্তবায়ন যাতে কেউ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সেই বিষয়ে সতর্ক থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিধায় তামাক কোম্পানির সঙ্গে সভা বাতিলেরও অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা তামাকের বিপক্ষে। আমরা চাই, দেশে তামাকের ব্যবহার কমে আসুক। সভাটি নির্ধারিত তারিখেই অনুষ্ঠিত হবে। বাতিলের সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা আমাদের সঙ্গে একটি সভা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যে সভায় তারা এই গাইডলাইন সম্পর্কে তাদের মতামত দেবেন। আমরা তাদের আলাদা করে সময় না দিয়ে ওই বৈঠকে উপস্থিত হয়ে মতামত দেওয়ার জন্য বলেছি। আমরা তাদের মতামত শুনবো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তো হবে পরে।’
হেলালুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এই আমন্ত্রণ আইনের বা এফসিটিসির কোনও শর্ত ভঙ্গ করেনি। তারাও এই সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, তারা দেশের বড় ট্যাক্স পেয়ার। তারা মতামত দিতে চাইলে আমরা শুনবো।’
এ প্রসঙ্গে তামাকবিরোধী গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা)’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের জানিয়েছেন, তামাক কোম্পানির সঙ্গে তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইড লাইন বিষয়ে এ ধরনের সভা করার সংবাদে আমরা উৎকন্ঠিত। কারণ, তামাক কোম্পানি কখনোই তামাকের নিয়ন্ত্রণ চাইবে না। তাদের উদ্দেশ্য ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়ানো। তাই এদের সঙ্গে বৈঠক করা এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ এর পরিপন্থী। এ ধরনের সভা বাতিলের দাবি জানাই।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি। দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের এক-তৃতীয়াংশ তামাক ব্যবহার করে। ২০১৮ সালে তামাকজনিত রোগের কারণে ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যা ওই বছরের মোট মৃত্যুর ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা, যা জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ।