খান মুহঃ আশরাফুল আলম
ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্মরণীয় আমল হলো তাকবিরে তাশরিক। জিলহজ মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে আল্লাহর মহত্ব ঘোষণা করে এই তাকবির পাঠ করা ওয়াজিব করা হয়েছে। এটি কেবল একটি উচ্চারণ নয়; বরং মুসলিম জীবনে ত্যাগ, আনুগত্য ও ঈমানের চেতনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
তাকবিরে তাশরিকের বিধান: আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহকে (বেশি বেশি) স্মরণ কর’ (সুরা বাকারা: ২০৩)।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এখানে উদ্দেশ্য- আইয়ামে তাশরিক (সহিহ বুখারি, অধ্যায় ফাদলিল আমাল ফি আইয়ামিত তাশরিক; মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার: ১০৮৭২)।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যেন তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে’ (সুরা হজ: ২৮)। এই আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলির দ্বারা প্রায় সকলের মতে জিলহজের প্রথম ১৩ দিন উদ্দেশ্য। এই দিনগুলোয় বিশেষ করে আল্লাহর জিকির ও তাকবিরের প্রতি আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর কারণ সম্পর্কে বিশিষ্ট আলেম ও ফকিহদের বক্তব্য হলো, জাহেলি যুগের লোকেরা তাদের কথিত প্রভুদের নামে পশু-প্রাণী উৎসর্গ করত। এর প্রতিউত্তরে মুমিনদের আদেশ করা হয়েছে তারা যেন আল্লাহর জিকির ও তাকবিরের মাধ্যমে তাওহিদ ও আনুগত্যের ঘোষণা দান করে। আল্লাহই একমাত্র ইলাহ। তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি ছাড়া কারো নামে প্রাণী উৎসর্গ করা যাবে না। কারণ তা সুস্পষ্ট শিরক (ফাতহুল বারি: ২/৫৩৫)।
তাকবিরে তাশরিক: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু; ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
তাকবিরে তাশরিকের অর্থ: আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
তাকবিরে তাশরিক কখন থেকে কোন পর্যন্ত: তাকবিরে তাশরিক পাঠ করতে হয় জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজের পর থেকে ১৩ তারিখ আছরের নামাজ পর্যন্ত—মোট ৫ দিন। এই সময়ে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর জামাতের সঙ্গে পড়া হোক কিংবা একাকী, ওয়াক্তের মধ্যে পড়া হোক বা কাজা, নামাজি মুকিম হোক অথবা মুসাফির, শহরের বাসিন্দা হোক বা গ্রামের- সবার ওপর একবার তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব (দুররে মুখতার: ২/১৮০)।
তাকবিরে তাশরিক কার জন্য ওয়াজিব: তাকবিরে তাশরিক প্রত্যেক মুসলমান, পুরুষ ও নারী- সবার জন্য ওয়াজিব, যারা ফরজ নামাজ আদায় করে থাকেন। ইবনে আবি শায়বা, আব্দুর রাজ্জাক ও বায়হাকি সাহাবাদের থেকে এই আমলের ব্যাপক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৫৬৫১; বায়হাকি: ৩/৩০৮)।
তাকবিরে তাশরিক নারী-পুরুষ যেভাবে পড়বেন: ফরজ নামাজ শেষ করে কোনো কথা বলার আগেই বা স্থান পরিবর্তনের আগেই এই তাকবির পাঠ করতে হবে। পুরুষদের জন্য উচ্চস্বরে এবং নারীদের জন্য নিচু স্বরে পাঠ করা উত্তম। ইবনে হাজম (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর স্মরণ করতে বলা হয়েছে, তাই পুরুষরা প্রকাশ্যে ও নারীরা নিচু স্বরে পাঠ করবে’ (আল-মুহাল্লা: ৫/৭৫)।
ফতোয়ায়ে শামিতে বলা হয়েছে, তাশরিকের দিনগুলোয় প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পুরুষদের উচ্চৈঃস্বরে একবার তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব। আর নারীরা নিচু স্বরে পড়বেন; যাতে নিজে শোনেন (শামি: ২/১৭৮)।
তাকবিরে তাশরিক কতবার পড়তে হবে: একবার পাঠ করা ওয়াজিব। কেউ বেশি পড়লে নেকি হবে, তবে তা সুন্নত মনে করে ৩ বার পড়া মাকরুহ। ইবনে তায়মিয়াহ (রহ.) বলেন, ‘তাকবিরে তাশরিক একবার পড়া ওয়াজিব, একাধিকবার সুন্নত নয়’ (ফতোয়া ইবনে তায়মিয়াহ: ২৪/২২১)। ‘তাকবিরে তাশরিক তিনবার বলার কোনো ভিত্তি নেই। সুন্নত মনে করে তিনবার পড়লে মাকরুহ হবে’ (ফতোয়ায়ে নাওয়াজেল: ১৪/৫৯৪)।
তাশরিকের দিনগুলোতে সাহাবিদের আমল: সাহাবায়ে কেরাম এই দিনগুলোতে সর্বদা আল্লাহু আকবর ধ্বনি তুলতেন। হজরত ইবনে ওমর (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বাজারে গিয়ে তাকবিরের আওয়াজ তুলতেন। শুনে শুনে লোকজনও তাঁদের সাথে তাকবিরের সুর তুলত।
ইবনে ওমর (রা.) পথে-ঘাটে, হাঁটা-বসায়, বাজারে-ঘরে এবং নামাজের পরে শুধুই তাকবির বলতে থাকতেন। মিনার দিনগুলোতো তাঁর তাকবিরের সাথে সমস্বরে মানুষের তাকবিরে মিনার পুরো অঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠত। মহিলারাও (নিচু স্বরে) তাকবীর বলতে থাকতেন (বুখারি-ফাতহুল বারি: ২/৫৩০-৫৩৬)।
তাকবিরে তাশরিকের ঐতিহাসিক পটভূমি: হাদিস অনুযায়ী ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানি প্রস্ততির সময় এই কথাগুলো প্রথম উচ্চারিত হয়। ইবনে আবি শায়বা (৫৬৪৭) ও ইমাম বায়হাকির (৩/৩১৫) বর্ণনায় এসেছে- ‘ইবরাহিম, ইসমাঈল ও জিবরাঈল (আ.)-এর মুখে এই তাকবির উচ্চারিত হয়।’
কোরআন-হাদিসে তাকবিরে তাশরিকের গুরুত্ব: আল্লাহতাআলা বলেন- ‘যেন তারা নির্ধারিত দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে ‘(সুরা হজ: ২৮)। আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহকে (বেশি বেশি) স্মরণ কর’ (সুরা বাকারা: ২০৩)।
রাসুল (স.) বলেন, ‘আইয়ামে তাশরিক হলো খাওয়ার, পান করার এবং আল্লাহর জিকির করার দিন’ (সহিহ মুসলিম: ১১৪১)। এছাড়াও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী ‘এই দিনগুলোয় আল্লাহর জিকিরের চেয়ে উত্তম কোনো আমল নেই, এমনকি জিহাদও নয়’ (সহিহ বুখারি: ৯৬৯)।
কাজা নামাজে তাকবিরে তাশরিকের বিধান: আইয়ামে তাশরিকের কোনো নামায কাজা হয়ে গেলে ওই দিনগুলোর মধ্যে তার কাজা আদায় করলে তাকবির বলা ওয়াজিব। কিন্তু এই কাজা পরবর্তী অন্য সময় আদায় করলে বা আইয়ামে তাশরিকের আগের কাজা নামাজ ওই দিনগুলোতে আদায় করলে তাকবির বলা ওয়াজিব নয় (বাদায়েউস সানায়ে: ১/৪৬৪; হিন্দিয়া: ১/১৫২; আলমুহিতুল বুরহানি: ২/৫১১-৫১৩)। উল্লেখ্য, তাকবির পড়তে হয় ফরজ নামাজের পর। সুন্নত, নফল, বিতির নামাজের পর তাকবির ওয়াজিব নয় (বাদায়েউস সানায়ে: ১/৪৬২; মাবসুত সারাখসি: ২/৪৪; হিন্দিয়া: ১/১৫২)।
তাকবিরে তাশরিকের ফজিলত: রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, এই দিনগুলোয় তাকবিরে তাশরিকের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল উত্তম নয়। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয়? নবী করিম (স.) বলেন, ‘জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ভিন্ন- যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না’ (সহিহ বুখারি: ৯৬৯)।
শেষ কথা: তাকবিরে তাশরিক একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত- যা আমাদের ঈমান, ইতিহাস ও আনুগত্যের শিক্ষা দেয়। প্রতিটি ফরজ নামাজের পর একবার করে তাকবির পাঠের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর মহত্বকে স্মরণ করি এবং তাঁর প্রশংসা করি। তাকবিরে তাশরিক কেবল ঐতিহ্য নয়, বরং সুস্পষ্ট দলিলভিত্তিক একটি ইবাদত।
আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাকবিরে তাশরিকের গুরুত্ব উপলব্ধি করার এবং নির্দিষ্ট সময়ে যথানিয়মে তাকবিরটি পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: সাংবাদিক
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ
(৩)