কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্গু, ইছাখালী, চাঁনখালী, মুরারি, ডলু বিধৌত চট্টগ্রাম বরাবরই কৃষির উর্বর জনপদ। তবে বর্তমানে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি ও অপেক্ষাকৃত লাভবান হওয়ায় কয়েক বছর ধরে আগাম সবজি চাষের পরিধি বাড়ছে; বিশেষ করে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।
তেমনই একজন কৃষি উদ্যোক্তা দক্ষিণ চট্টগ্রামের শহীদুল ইসলাম বাবর। সানমুন এগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজের স্বত্বাধিকারী বাবর সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায় প্রায় ৪০ একর জমিতে গড়ে তুলেছেন বিশাল কৃষি খামার। যেখানে সবজির আগাম চাহিদা মাথায় রেখে ফলানো হচ্ছে নানান জাতের সবজি।
শহীদুল ইসলাম বাবর বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে আমাদের ফসল ওঠানো হয়। কিন্তু ওই সময় কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পান না। অন্যদিকে বর্ষার শেষে বাজারে সবজির যে অপর্যাপ্ততা তৈরি হয়, দামও থাকে বেশি। এসব কিছু মাথায় রেখে কয়েক বছর ধরে আমরা আগাম সবজি চাষে জোর দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘২০২০ সালে আমি ২৩ একর জমিতে সবজি চাষের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। বর্তমানে প্রায় ৪০ একর জমিতে আবাদ গড়ে তুলেছি। এটা সম্ভব হয়েছে সবগুলো সিজন সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে।’
শুধু শহীদুল ইসলাম বাবর নন; বর্তমানে সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী চন্দনাইশের ধোপাছরি, দোহাজারি, বরমা, বইলতলী, বসরত নগর, হাজারীবাজার, বারতখানা, চাগাচর, জামিরজুরী, লালটিয়া, দিয়াকুল, রায়জোয়ারা, কিল্লাপাড়া, লালিয়ার চর, লালটিয়ার চর, পুরানগড় ও শিলঘাটা এবং সাতকানিয়ার কালিয়াইশ, খাগড়িয়া, নলুয়া, আমিলাইষ, চরতিসহ বিভিন্ন এলাকায় চলছে আগাম সবজির চাষ। সেখানে বিশাল এলাকাজুড়ে আবাদ হচ্ছে শীতকালীন সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, বেগুন, করলা, কাকরোল, টমেটো, লাউ, লালশাক, মুলাশাক, ধনিয়াপাতা ইত্যাদি।
সীতাকুণ্ডে ৫৪০০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ: লোহাগাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাজী শফিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে কৃষকদের আগাম সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করছি। চলতি বছর ৫০ হেক্টর জমিতে আগাম শীতকালীন সবজি আবাদ হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক কৃষক ফলন পেতে শুরু করেছেন।’
শীতকালীন সবজি আগাম বাজারে আনতে ব্যস্ত সময় পার করছেন সীতাকুণ্ডের চাষিরা। উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, সীতাকুণ্ডে মোট ৫ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে। তার মধ্যে ২ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে শিম ও ২ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে অন্যান্য ফসলের চাষ করেছেন চাষিরা।
সৈয়দপুরের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘যে কোনো সবজি যদি মৌসুমের শুরুতে বাজারে তোলা যায়, তাহলে তার দাম বেশি পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে মুলা, লালশাক, করলা, পালংশাক বাজারে আসতে শুরু করেছে। পর্যাপ্ত দামও পাচ্ছি।’
কীটনাশকমুক্ত সবজি চাষ: ফটিকছড়ির তরুণ দুই কৃষি উদ্যোক্তা আব্দুল হালিম ও ওসমান গণি। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় ফটিকছড়ির প্রান্তিক পাহাড়ি অঞ্চলের রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্মটি এখন স্থানীয় কৃষকদের হাতে-কলমের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তারা জানান, যে কোনো ফসল আগাম চাষ হলে বাজারে চাহিদা বেশি থাকে। তাই মুনাফাও অনেক বেশি হয়। আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করলে এখন কীটনাশকমুক্ত সবজি চাষ করা সম্ভব।
তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা আব্দুল হালিম বলেন, ‘রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্মে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য হলুদ পাতার ব্যবহার ও ফেরোমন জৈব পদ্ধতি এবং জৈব সার ব্যবহার করা হয়। এ দুটি বালাই দমন পদ্ধতির কারণে কীটনাশক ছাড়াই পোকামাকড় দমন করা সহজ হচ্ছে। জৈব পদ্ধতিতে খরচও কম।’
চিত্র বদলে দিয়েছেন তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা: চার-পাঁচ বছর আগেও চট্টগ্রামের সবজির চাহিদার বেশির ভাগই মেটানো হতো উত্তরবঙ্গ থেকে সরবরাহ করা সবজি দিয়ে। সেই চিত্র বদলে দিয়েছেন তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা। সময় উপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে বর্তমানে এখানকার উৎপাদিত সবজি দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে বেশির ভাগ চাহিদা।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী সবজি উৎপাদনে চট্টগ্রামের প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধির চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। ২০১০-১১ সালে চট্টগ্রামে উৎপাদন হয়েছিল পৌনে তিন লাখ টন। এক যুগের ব্যবধানে চট্টগ্রামে সবজি উৎপাদন দ্বিগুণের কাছাকাছি বেড়েছে, বর্তমানে যা ৬ লাখ টনের বেশি। উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহারে সবজি উৎপাদন বাড়ছে। ধানের চেয়ে সবজি চাষে লাভ বেশি পাওয়ায় কৃষকরা এখন সবজি চাষে ঝুঁকছেন।
বড় বাধা জলবায়ু পরিবর্তন: সবজি চাষাবাদে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাত ও বিলম্ব বন্যা।
চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আজাদ হোসেন জানান, চলতি রবি মৌসুমে আগাম শীতকালীন সবজির মধ্যে ইতিমধ্যে খরিপ-২ এর আওতায় ৭০০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টি থাকায় ৪০০ হেক্টরের মতো জমিতে কৃষকরা চাষাবাদ করতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টিপাত থাকায় চলতি মৌসুমে আগাম শীতকালীন সবজি চাষাবাদে কৃষকরা কিছুটা বিপাকে পড়েছেন। দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাত ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রণোদনা এবং পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে সহযোগিতা করা হবে।’