নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে কোনও দ্বিমত নেই।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের ব্যাপারে বেশিরভাগ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কিছু দল অবশ্য এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন।’
সোমবার (২৬ মে) জাতীয় সংসদের একটি হলে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা জানান। তিনি এসময় বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে নীতিগত ঐকমত্য হলেও অনেক বিষয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে।’
সংবাদ সম্মেলনে আলী রীয়াজ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, বিশেষ করে কমিশনের প্রধান, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে সালাম ও শুভেচ্ছা জানান। তিনি জানান, সংবিধান বিষয়ে ঐকমত্য বা আংশিক ঐকমত্য আছে-তার মধ্যে সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে ‘বহুত্ববাদ’ না রাখার ব্যাপারে বেশিরভাগ দল মতামত দিয়েছে। অন্য চারটি মূলনীতির ব্যাপারে এক ধরনের ঐকমত্য আছে। তবে অনেক দল এই চারটির বাইরেও অন্যান্য বিষয় যুক্ত করার কথা বলেছে।
‘নাগরিকদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার সম্প্রসারিত করা এবং সেগুলোর কিছু কিছু বিষয় রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা তৈরি করা। তবে এই অধিকারের তালিকা এবং তার প্রয়োগে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা এবং বিশেষ করে তার মাত্রা বিষয়ে মতপার্থক্য আছে।’
সংসদে নারীদের ১০০ আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব: আলী রীয়াজ জানান, নিম্নকক্ষে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণের প্রশ্নে এক ধরনের ঐকমত্য রয়েছে দলগুলোর মধ্যে। তবে এর পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। যারা সংসদের উভয় কক্ষের পক্ষে এবং যারা এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভার পক্ষে– উভয়ই আইন সভার ব্যাপারে ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়ার পক্ষে।
‘উচ্চকক্ষ গঠনকে সেসব দল সমর্থন করে, তারা ১০০ জন সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠনের ব্যাপারে একমত। তবে এই প্রতিনিধিদের কীভাবে নির্বাচন করা হবে– সংবিধান সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারের সুপারিশে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকলেও এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।’
তিনি জানান, সংবিধানের ৪৮(ক) অনুচ্ছেদ যা কার্যত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নির্ধারণ করে, তা সংশোধনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে হবে, সেই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।
অর্থ বিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন বিলে দলীয় অনুশাসনে বাধ্যবাধকতা: আলী রীয়াজ উল্লেখ করেন, ৭০ অনুচ্ছেদ, অর্থাৎ সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেবার ক্ষেত্রে যে বিধান, তা পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্য হলেও- কী কী বিষয়ে দলের পক্ষে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক হবে, তার একটি আংশিক তালিকার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে- অর্থ বিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন বিলের ব্যাপারে দলীয় অনুশাসনের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে বেশিরভাগ দল একমত, এর অতিরিক্ত আরও কিছু যুক্ত করার, যেমন- রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিল যুক্ত করার জন্যেও কিছু দলের প্রস্তাব আছে।
তিনি জানান, আইনসভার গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতিত্ব পদ বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের দেওয়ার ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত। এই মর্মে বিশেষ কয়েকটি কমিটি, যেমন- পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, এস্টিমেট কমিটি, পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটি, প্রিভিলেজ কমিটির সভাপতিত্ব বিরোধী দলের কাছে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপের ব্যাপার বিবেচনায় আছে।
এ সময় কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া।
‘জাতীয় সনদ’ জুলাইয়ে: জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুনের শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার যে আলোচনা শুরু করবে, তার মধ্য দিয়েই ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি সম্ভব বলে আশা করছেন কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ।
সোমবার সংসদ ভবনের এলডি হলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, কমিশনের দায়িত্ব হল রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা।
আমরা আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার মধ্য দিয়ে জুলাই মাসের মধ্যেই একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব হবে।
সংস্কারের সুপারিশে জনগণের মতামত নিতে জরিপ: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কারের সুপারিশগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু বিষয়ে জনগণের মতামত নিতে জরিপ চালাতে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তবে কবে, কীভাবে জরিপ চালানো হবে, সে বিষয়ে কিছু জানাননি তিনি। আলী রীয়াজ বলেন, যে সুপারিশগুলো সম্পর্কে রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো সম্পর্কে জনগণের মতামত নেওয়ার উদ্দেশ্যেই জরিপ পরিচালনা করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকারের। রাজনৈতিক দলগুলো নির্ধারণ করবে প্রক্রিয়াটা কী হবে।
সংস্কারের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় শিগগির দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরুর কথাও বলেছে ঐকমত্য কমিশন। এক্ষেত্রে মে মাসের শেষে বা জুনের শুরুতে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু হতে পারে। যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়নি বা দলগুলোর অবস্থান কাছাকাছি সেগুলো নিয়ে ওই পর্বে আলোচনা হতে পারে বলে জানান আলী রিয়াজ।