ঢাকা ১২:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫

ঢাবি এলাকায় বেপরোয়া ‘গ্যাং’

  • আপডেট সময় : ০৯:৫২:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৩
  • ৯৪ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় নিয়মিত ছিনতাই, মারধর ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না ছাত্রলীগ। এ ছাড়া এ অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশেরও তেমন তৎপরতা নেই। একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের অনলাইন প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
গত দুই সপ্তাহে ঢাবি ও তার আশপাশের এলাকায় ছিনতাই, মারধর, শ্লীলতাহানির বেশ কয়েকটি ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে এই এলাকায় হাজারো মানুষের সমাগম ঘটবে। তখন অপরাধের মাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
সাধারণ শিক্ষার্থী ও ভাসমান দোকানিদের ভাষ্য, টিএসসি, কলাভবন, শ্যাডো, স্মৃতি চিরন্তন, ফুলার রোড, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় ছিনতাইকারীদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয়। তারা ইদানীং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চক্রের সদস্যরা নিজেদের ঢাবির শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
২৬ জানুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লেক-সংলগ্ন কংক্রিটের বেঞ্চে বসা যুগলদের একে একে জেরা করেন ঢাবির ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। এ সময় কয়েক যুগলকে তাঁরা মারধর করেন। তাঁদের কাছ থেকে মুঠোফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। একই দিন রমনা কালীমন্দির-সংলগ্ন ভাবনগর সাধুসঙ্গ এলাকায় বহিরাগত কয়েকজন তরুণকে জিম্মি করা হয়। একপর্যায়ে তাঁদের মুঠোফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ২৬ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার দিন রাতে ঢাবি ক্যাম্পাস ও সংলগ্ন এলাকায় একাধিক ছিনতাই, মারধর ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই দিন রাত ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয়ে একদল তরুণ বহিরাগত ব্যক্তিদের মারধর করছেন।
২৬ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হয়রানির শিকার এক ব্যক্তি বলেন, তিনি ও তাঁর এক মেয়েবন্ধু উদ্যানের লেকের পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনটি মোটরসাইকেলে করে সেখানে নয়জন তরুণ আসেন। তাঁরা নিজেদের ঢাবির শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁরা জেরা শুরু করেন। ঢাবির শিক্ষার্থী কি না, তা জানতে চান। ‘না’ উত্তর দিতেই হয়রানি বেড়ে যায়। আশপাশ থেকে আরও ৮ থেকে ১০ জন তরুণ ঘটনাস্থলে আসেন। সবাই মিলে তাঁকে মারধর শুরু করেন। নানা অভিযোগ তুলে ভয়ভীতি দেখান। তাঁর মুঠোফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে নেন। তাঁর মেয়েবন্ধুকে লাঞ্ছিত করা হয়। তিনি ভয়ে কারও কাছে অভিযোগ করেননি। ২৭ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনের পেছনের সড়কে দুই ব্যক্তিকে মারধর করে টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী চক্র।
উদ্যান ভয়ংকর: ভুক্তভোগী, ভাসমান দোকানি ও শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একটি ভয়ংকর স্থান হয়ে উঠেছে। এখানে ছিনতাই, মারধর ও শ্লীলতাহানির ঘটনা বেশি ঘটে। উদ্যানে এসে ছিনতাই, মারধর ও শ্লীলতাহানির শিকার হওয়া বহিরাগত যুগলদের অনেকে চান না যে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা অন্য কেউ জানুক। এ কারণে তাঁরা পুলিশের কাছে যেতে চান না। উদ্যানে মাদক সহজলভ্য। এ কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই এখানে মাদক সেবনের জন্য আসেন। তাঁরাও মারধর-ছিনতাইয়ের শিকার হন। ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা উদ্যানের মাদক ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁদের চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করেন মাদক কারবারিরা। আবার বিনা মূল্যে মাদকও দিতে হয়। এর অন্যথা হলে মাদক কারবারিদেরও মারধর করে ছিনতাইকারী চক্র।
গ্যাং কালচার: রায়হান কামাল নামের ঢাবির এক ছাত্র গত রোববার ফেসবুকে লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক দিনে বহিরাগত ও ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী মিলিয়ে শতাধিক ব্যক্তি মারধরের শিকার হয়েছেন। করোনাকালের বিধিনিষেধ-পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে একটা ‘গ্যাং কালচার’ গড়ে উঠেছে। ছিনতাই, অকারণে মারধর, মাদক কারবার, নারীর শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তারা করছে না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁকেও মার খেতে হয়। তিনি একজনকে বাঁচাতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েছেন। তিনি ক্যাম্পাসের কি না, বারবার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। অপরাধীরা ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ। রায়হান টিএসসি-ভিত্তিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নেতা ছিলেন। তিনি আরও লিখেছেন, ক্যাম্পাসে একটা মাৎস্যন্যায় চলছে। এসব কারণে তিনি তাঁর পরিচিতজনদের ক্যাম্পাসে আসতে নিরুৎসাহিত করছেন। তিনি তাঁর প্রিয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
ব্যবস্থা নিচ্ছে না ছাত্রলীগ: ১৫ জানুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে মারধর ও হেনস্তা করে স্বর্ণালংকার ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় মামলা হয়। মামলার দুই দিন পর গ্রেপ্তার হন ঢাবির কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানজির আরাফাত ওরফে তুষার। তবে তিনি এক দিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে আবার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। একই মামলার আরেক আসামি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সহসম্পাদক রাহুল রায়। তানজির ও রাহুল—কারও বিরুদ্ধেই ছাত্রলীগ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। রাহুলকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকার ‘ছিনতাইকারী গ্যাংয়ের প্রধান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন খোদ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান। তিনি বলেন, কেউ ভালো হতে চাইলে সুযোগ দেওয়া উচিত। পরবর্তী সময়ে রাহুল এমন কিছুর সঙ্গে যুক্ত হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছিনতাই-মারধরসহ অপরাধমূলক কর্মকা-ের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা জানান তানভীর। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে ছিনতাই-মারধরের ঘটনা বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এসব ঘটনায় যাঁরাই যুক্ত হবেন, তাঁদের কোনো ছাড় নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে কিছু বহিরাগতও ছিনতাই-মারধরের ঘটনায় যুক্ত। এ কারণে বদনাম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের।
নীরব দর্শকের ভূমিকায় পুলিশ: দীর্ঘদিন ধরেই ঢাবি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় ছিনতাই, মারধর, শ্লীলতাহানির মতো অপরাধ করে আসছে চক্রটি। কিন্তু চক্রটিকে থামাতে শাহবাগ থানার পুলিশ তৎপর নয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের। তাঁরা বলছেন, পুলিশের সামনেই সবকিছু চলে। কিন্তু তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। মাঝেমধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটতে যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন এক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের কিছু সদস্যের সঙ্গে চক্রটির সখ্য আছে। এ কারণেই তারা বেপরোয়া। কিছু ছাত্রনেতাও চক্রটির সদস্যদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব বিষয়ের দায় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। এ কারণে অপরাধ থামছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহবাগ থানার একজন উপপরিদর্শক (এসআই) বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্নিত কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় নিয়মিত অপরাধমূলক কর্মকা- করেন। সব জানলেও পুলিশ দায়িত্ব নিয়ে কিছু করতে পারে না। কারণ, কোনো ছাত্রকে থানায় নিতে গেলে সহযোগীরা জোট বেঁধে বাধা দেন। থানায় নেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে দল বেঁধে শিক্ষার্থীরা চলে আসেন। পাশাপাশি কিছু ছাত্রনেতা পুলিশকে ফোন করে অপরাধীদের ছেড়ে দিতে চাপ দেন। এসব কারণে পুলিশ সদস্যরা যেচে ঝামেলায় জড়াতে চান না। জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মামলা হলে আমরা খতিয়ে দেখি। এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, তার জন্য পুলিশি টহল জোরদার করা হবে।’
ক্যাম্পাসে ছিনতাই-মারধর প্রতিরোধে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, ‘অহেতুক ক্যাম্পাসে বসে থাকা, ক্যাম্পাসকে বিনোদনকেন্দ্র ভাবার চিন্তা থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা লাগবে। ক্যাম্পাসে মারধর-ছিনতাই প্রতিরোধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রক্টরিয়াল বডির সতর্ক প্রহরা বাড়ানো হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সক্রিয় করা হচ্ছে।’

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ঢাবি এলাকায় বেপরোয়া ‘গ্যাং’

আপডেট সময় : ০৯:৫২:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৩

প্রত্যাশা ডেস্ক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় নিয়মিত ছিনতাই, মারধর ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না ছাত্রলীগ। এ ছাড়া এ অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশেরও তেমন তৎপরতা নেই। একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের অনলাইন প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
গত দুই সপ্তাহে ঢাবি ও তার আশপাশের এলাকায় ছিনতাই, মারধর, শ্লীলতাহানির বেশ কয়েকটি ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে এই এলাকায় হাজারো মানুষের সমাগম ঘটবে। তখন অপরাধের মাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
সাধারণ শিক্ষার্থী ও ভাসমান দোকানিদের ভাষ্য, টিএসসি, কলাভবন, শ্যাডো, স্মৃতি চিরন্তন, ফুলার রোড, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় ছিনতাইকারীদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয়। তারা ইদানীং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চক্রের সদস্যরা নিজেদের ঢাবির শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
২৬ জানুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লেক-সংলগ্ন কংক্রিটের বেঞ্চে বসা যুগলদের একে একে জেরা করেন ঢাবির ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। এ সময় কয়েক যুগলকে তাঁরা মারধর করেন। তাঁদের কাছ থেকে মুঠোফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। একই দিন রমনা কালীমন্দির-সংলগ্ন ভাবনগর সাধুসঙ্গ এলাকায় বহিরাগত কয়েকজন তরুণকে জিম্মি করা হয়। একপর্যায়ে তাঁদের মুঠোফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ২৬ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার দিন রাতে ঢাবি ক্যাম্পাস ও সংলগ্ন এলাকায় একাধিক ছিনতাই, মারধর ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই দিন রাত ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয়ে একদল তরুণ বহিরাগত ব্যক্তিদের মারধর করছেন।
২৬ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হয়রানির শিকার এক ব্যক্তি বলেন, তিনি ও তাঁর এক মেয়েবন্ধু উদ্যানের লেকের পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনটি মোটরসাইকেলে করে সেখানে নয়জন তরুণ আসেন। তাঁরা নিজেদের ঢাবির শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁরা জেরা শুরু করেন। ঢাবির শিক্ষার্থী কি না, তা জানতে চান। ‘না’ উত্তর দিতেই হয়রানি বেড়ে যায়। আশপাশ থেকে আরও ৮ থেকে ১০ জন তরুণ ঘটনাস্থলে আসেন। সবাই মিলে তাঁকে মারধর শুরু করেন। নানা অভিযোগ তুলে ভয়ভীতি দেখান। তাঁর মুঠোফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে নেন। তাঁর মেয়েবন্ধুকে লাঞ্ছিত করা হয়। তিনি ভয়ে কারও কাছে অভিযোগ করেননি। ২৭ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনের পেছনের সড়কে দুই ব্যক্তিকে মারধর করে টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী চক্র।
উদ্যান ভয়ংকর: ভুক্তভোগী, ভাসমান দোকানি ও শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একটি ভয়ংকর স্থান হয়ে উঠেছে। এখানে ছিনতাই, মারধর ও শ্লীলতাহানির ঘটনা বেশি ঘটে। উদ্যানে এসে ছিনতাই, মারধর ও শ্লীলতাহানির শিকার হওয়া বহিরাগত যুগলদের অনেকে চান না যে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা অন্য কেউ জানুক। এ কারণে তাঁরা পুলিশের কাছে যেতে চান না। উদ্যানে মাদক সহজলভ্য। এ কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই এখানে মাদক সেবনের জন্য আসেন। তাঁরাও মারধর-ছিনতাইয়ের শিকার হন। ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা উদ্যানের মাদক ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁদের চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করেন মাদক কারবারিরা। আবার বিনা মূল্যে মাদকও দিতে হয়। এর অন্যথা হলে মাদক কারবারিদেরও মারধর করে ছিনতাইকারী চক্র।
গ্যাং কালচার: রায়হান কামাল নামের ঢাবির এক ছাত্র গত রোববার ফেসবুকে লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক দিনে বহিরাগত ও ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী মিলিয়ে শতাধিক ব্যক্তি মারধরের শিকার হয়েছেন। করোনাকালের বিধিনিষেধ-পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে একটা ‘গ্যাং কালচার’ গড়ে উঠেছে। ছিনতাই, অকারণে মারধর, মাদক কারবার, নারীর শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তারা করছে না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁকেও মার খেতে হয়। তিনি একজনকে বাঁচাতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েছেন। তিনি ক্যাম্পাসের কি না, বারবার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। অপরাধীরা ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ। রায়হান টিএসসি-ভিত্তিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নেতা ছিলেন। তিনি আরও লিখেছেন, ক্যাম্পাসে একটা মাৎস্যন্যায় চলছে। এসব কারণে তিনি তাঁর পরিচিতজনদের ক্যাম্পাসে আসতে নিরুৎসাহিত করছেন। তিনি তাঁর প্রিয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
ব্যবস্থা নিচ্ছে না ছাত্রলীগ: ১৫ জানুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে মারধর ও হেনস্তা করে স্বর্ণালংকার ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় মামলা হয়। মামলার দুই দিন পর গ্রেপ্তার হন ঢাবির কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানজির আরাফাত ওরফে তুষার। তবে তিনি এক দিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে আবার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। একই মামলার আরেক আসামি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সহসম্পাদক রাহুল রায়। তানজির ও রাহুল—কারও বিরুদ্ধেই ছাত্রলীগ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। রাহুলকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকার ‘ছিনতাইকারী গ্যাংয়ের প্রধান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন খোদ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান। তিনি বলেন, কেউ ভালো হতে চাইলে সুযোগ দেওয়া উচিত। পরবর্তী সময়ে রাহুল এমন কিছুর সঙ্গে যুক্ত হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছিনতাই-মারধরসহ অপরাধমূলক কর্মকা-ের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা জানান তানভীর। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে ছিনতাই-মারধরের ঘটনা বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এসব ঘটনায় যাঁরাই যুক্ত হবেন, তাঁদের কোনো ছাড় নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে কিছু বহিরাগতও ছিনতাই-মারধরের ঘটনায় যুক্ত। এ কারণে বদনাম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের।
নীরব দর্শকের ভূমিকায় পুলিশ: দীর্ঘদিন ধরেই ঢাবি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় ছিনতাই, মারধর, শ্লীলতাহানির মতো অপরাধ করে আসছে চক্রটি। কিন্তু চক্রটিকে থামাতে শাহবাগ থানার পুলিশ তৎপর নয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের। তাঁরা বলছেন, পুলিশের সামনেই সবকিছু চলে। কিন্তু তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। মাঝেমধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটতে যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন এক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের কিছু সদস্যের সঙ্গে চক্রটির সখ্য আছে। এ কারণেই তারা বেপরোয়া। কিছু ছাত্রনেতাও চক্রটির সদস্যদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব বিষয়ের দায় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। এ কারণে অপরাধ থামছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহবাগ থানার একজন উপপরিদর্শক (এসআই) বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্নিত কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় নিয়মিত অপরাধমূলক কর্মকা- করেন। সব জানলেও পুলিশ দায়িত্ব নিয়ে কিছু করতে পারে না। কারণ, কোনো ছাত্রকে থানায় নিতে গেলে সহযোগীরা জোট বেঁধে বাধা দেন। থানায় নেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে দল বেঁধে শিক্ষার্থীরা চলে আসেন। পাশাপাশি কিছু ছাত্রনেতা পুলিশকে ফোন করে অপরাধীদের ছেড়ে দিতে চাপ দেন। এসব কারণে পুলিশ সদস্যরা যেচে ঝামেলায় জড়াতে চান না। জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মামলা হলে আমরা খতিয়ে দেখি। এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, তার জন্য পুলিশি টহল জোরদার করা হবে।’
ক্যাম্পাসে ছিনতাই-মারধর প্রতিরোধে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, ‘অহেতুক ক্যাম্পাসে বসে থাকা, ক্যাম্পাসকে বিনোদনকেন্দ্র ভাবার চিন্তা থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা লাগবে। ক্যাম্পাসে মারধর-ছিনতাই প্রতিরোধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রক্টরিয়াল বডির সতর্ক প্রহরা বাড়ানো হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সক্রিয় করা হচ্ছে।’