বিশেষ সংবাদদাতা: যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে এক্সপ্রেসওয়েতে ‘স্পিড ক্যামেরা’ লাগানো হলেও সেগুলো ‘ট্রায়াল’ পর্যায়ে। এ সুযোগে রাজধানীর ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’-তে উঠেই গাড়িতে গতির ঝড় তোলেন চালকরা। কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করে দেওয়া ৬০ কিলোমিটারের গতিবেগ টপকে ৮০, ৯০ এমনকি ১০০ কিলোমিটার গতিতেও গাড়ি চলে এই সড়কে। এরফলে ঘটছে দুর্ঘটনাও। এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর থেকে এ পর্যন্ত ‘ওভার স্পিডের’ কারণে কোনও মামলা হয়েছি কিনা, এর কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্যও পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা এড়াতে এ বিষয়ে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ঢাকায় যানজট নিরসনে বহুল প্রতীক্ষিত মেগা প্রকল্প ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ উদ্বোধন করা হয় গত বছরের ২ সেপ্টেম্বরে। ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার উড়াল সড়কটির বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার চালু হয়। এর পরের দিন ৩ সেপ্টেম্বর এক্সপ্রেসওয়েটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
গেলো বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণা অনুযায়ী, যানজটের এই নগরীতে যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এই ধীরগতিতে দ্রুত চলাচলের জন্য নগরবাসীকে স্বস্তি দিয়েছে এক্সপ্রেসওয়ে। যদিও নিরাপদ চলাচলের জন্য গতির এই উড়াল সড়কে চলাচলকারীদের নিয়ম মেনে গাড়ি চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে শুরু থেকেই। এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ তিন চাকার যান ও বাইসাইকেল চলাচল করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর চলাচলের যোগ্য বাস, প্রাইভেটকার, ট্রাকসহ অন্য যানবাহনগুলোর জন্য সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। আর র্যাম্পে এ গতির সীমা সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার। তবে কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেওয়া এই গতিবেগ কতজন চালক মেনে গাড়ি চালাচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ওই পথে চলাচল করা কয়েকজন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেউ কেউ নিয়ম মেনে গাড়ি চালালেও অনেক চালকই নিয়মের বাইরে গিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। তারা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার পর নির্ধারিত গতি ৬০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে বেশিরভাগ গাড়িই ৮০-৯০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করে থাকে। এমনকি ফাঁকা থাকলে এ গতি ১০০ কিলোমিটারও পার হয়ে যায়।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ার সপ্তাহ খানেক পরে একটি দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর ভোরে এক্সপ্রেসওয়ের কুড়িল পয়েন্টে একটি প্রাইভেটকারকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় আরেকটি গাড়ি। এতে কেউ হতাহত না হলেও প্রাইভেট কারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলতি বছর ৮ জানুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্রাইভেট কারকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে একটি বাস। এতে প্রাইভেট কারের চালক নিহত ও এক আরোহী আহত হয়েছেন। এছাড়াও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কে (এক্সপ্রেসওয়ে) প্রায়শই এমন দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই ক্যামেরাগুলো বর্তমানে ট্রায়াল হিসেবে রাখা হয়েছে। পরীক্ষামূলক ব্যবহার শেষ হলেই আইনিভাবে কার্যকর হবে। ফলে ওভার স্পিডের কারণে মামলা হয়েছে- এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি প্রকল্প কর্মকর্তারা।
স্পিড ক্যামেরার বিষয়ে তথ্য জানা আছে নিয়মিত চালকদেরও। এক্ষেত্রে কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন অনেক চালক। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ চালকই ক্যামেরার স্পটগুলোর কাছাকাছি গিয়ে গতি কমিয়ে দেন। আর বাকি অংশে গতি বাড়িয়ে গাড়ি চালান তারা।
আজিমপুর থেকে ছেড়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে উত্তরার দিকে নিয়মিত যাত্রী নিয়ে চলাচল ভিআইপি পরিবহন। এই গাড়ির একজন গাড়ি চালক লাল চান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উড়াল সেতুতে ওঠার পর একই গতি দিয়ে সবসময় চালানো যায় না। কয়েকটি জায়গা আছে, যেখানে ক্যামেরা বসানো। এসব জায়গায় কাছাকাছি থাকলে গাড়ি ৬০ মতোই গতিতেই রাখি। এছাড়া ৭০ থেকে ৮০ গতিতে চালাই। এখন পর্যন্ত কোনও মামলা দেয়নি।’
এক্সপ্রেসওয়েতে নিয়মিত যাত্রী নিয়ে চলাচল করে বিআরটিসির বাসও। রাষ্ট্রায়ত্ব এই প্রতিষ্ঠানের চালক হাসান মিয়া বলেন, ‘৬০ কিলোমিটার গতিতে চললেই ভালো। তবে আমরা মাঝেমধ্যে ৬৫ থেকে ৭০, আবার কখনও এর বেশি গতিতেও চালাই। যেহেতু আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যেতে পারছি, ফলে নির্ধারিত গতিতে যাওয়ায় ভালো। বর্তমানে এভাবে চালানোর চেষ্টা করছি।’
গাড়ির গতি নিয়ে একই রকম কথা বলেছেন আরও কয়েকজন চালক। তবে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে এখনও কোনও মামলার মুখোমুখি হতে হয়নি বলেও জানিয়েছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গতি কমিয়ে চালানোর পেছনের কারণগুলো চালকদের জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া টোল ফির সঙ্গে আইন অমান্য করার মামলার ফি-টাও যুক্ত করলে নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না চালকরা।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প কর্মকর্তা সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জুনায়েদ বলেন, ‘প্রযুক্তিগত বিষয় নতুন কোথাও প্রয়োগ করার আগে সময় নিয়েই কাজটি করতে হয়। প্রকল্পটি বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) আওতায় পরিচালিত হচ্ছে।’ এছাড়া এক্সপ্রেসওয়েতে অনিয়মের কারণে এখন পর্যন্ত কোনও মামলা হয়েছে কি না জানতে চাইলে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি তিনি। প্রকল্পটির সহকারী পরিচালক মুস্তাকিম আহমেদও মামলা নিয়ে একইরকম উত্তর দিয়েছেন। তার জানা মতে, এখনও কোনও মামলা হয়নি।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘কীজন্য নির্ধারিত গতিতে চলতে হবে, ৭০ অথবা ৮০-তে গতি তোলা যাবে না, এ বিষয়ে চালকদের বোঝাতে হবে। উপরে ওভার স্পিডে গাড়ি চালালে কী কী সমস্যায় পড়তে হতে পারে, সে বিষয়গুলো নজরে আনতে হবে।’