ঢাকা ০৩:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ঘাটতির কারণে অপরাধ বাড়ছে

ঢাকায় বেপরোয়া ছিনতাইকারী

  • আপডেট সময় : ০৭:২৬:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫
  • ১৮ বার পড়া হয়েছে

ঢাকায় রাতে ছিনতাইয়ের ঘটনার একটি ফুটেজের ফাইল ছবি

বিশেষ সংবাদদাতা: রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েই চলছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে। পতিত সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় তাদের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আর এই মনোবল ঘাটতিকে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে অপরাধীরা।

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকারের সামনে যেসব বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসছে, তার মধ্যে অন্যতম আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। এর মধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊধ্বগতি।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ফিরে না আসার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। দুটি কারণে ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে। প্রথমত; দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেকেই এসব কাজে যুক্ত হচ্ছেন। দ্বিতীয়ত; আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয় উঠতে পারেনি।

একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে ছিনতাইয়ের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মাইনুল হাসান সোহেল। গত ২৪ ডিসেম্বর রাত ৯টার পর টিকাটুলির মোড়ের অফিস থেকে রিকশায় সেগুনবাগিচার ডিআরইউতে যাচ্ছিলেন। রিকশাটি দৈনিক বাংলা মোড়ে আসলে একদল ছিনতাইকারী গতিরোধ করে। এক সময় তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনটি তারা ছিনিয়ে নেয়।

ভুক্তভোগী এই সাংবাদিক বলেন, ছিনতাইকারীরা মোবাইল টার্গেট করে আক্রমণ করে। তারা আমার হাত ও পায়ে আঘাত করে। এক পযার্য়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরি। রাস্তায় প্রকাশ্যে ও মতিঝিলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ছিনতাইকারীরা যেভাবে আক্রমণ করেছে, সেক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতি হলেও হতে পারতো।

গত, ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ ছিনতাই হওয়া মোবাইলটি উদ্ধার করতে পারেনি বলে জানা যায়।

মতিঝিল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বলেন, ‘আমরা শুধু মোবাইল উদ্ধারই নয়, অপরাধীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে।

শুধু সাংবাদিক নয়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে শুধু সর্বস্বই খোয়াচ্ছন না, অনেককে জীবন দিতে হয়েছে জনবহুল এই শহরে।

ফ্লাইওভার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন হাফেজ কামরুল হাসান। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কাছে থাকা নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিতে চায় ছিনতাইকারীরা। ছিনতাইকারীদের বাধা দেওয়ায় তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা হাতে থাকা ধারালো চাকু দিয়ে বুকে আঘাত করে কামরুলের। ফ্লাইওভারের ওপর লুটিয়ে পড়লে ছিনতাইকারীরা তার কাছে থাকা একটি মোবাইল ফোন ও নগদ ৭ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। অবশ্য এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

হঠাৎ করে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, মিরপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল, শাহজাহানপুর, হাজারীবাগ, শাহ আলী, এমনকি গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। সন্ধ্যা নামতেই বেপরোয়া ছিনতাইচক্রের সদস্যরা। প্রায়শই গুরুতর আহত, এমনকি প্রাণহানির খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

যেসব থানায় ছিনতাই মামলা বেশি: অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকায় পুলিশের জনবলে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। পুলিশের সর্বোচ্চ পদ আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনার পদে পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বেশি আলোচনায় রয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকা।

এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে ঢাকায় গড়ে তিনটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল ও শাহজাহানপুর থানায়। দুটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে হাজারীবাগ, মিরপুর ও শাহআলী থানায়। একটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে ১৬টি থানায়। জানুয়ারিতে ১১৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ১২১টি, মার্চে ১৩৮টি, এপ্রিলে ৯৭টি, মে মাসে ১১৫টি, জুনে ১০৩টি, জুলাইতে ১০১টি এবং আগস্টে ৭০টি ছিনতাই ও ডাকাতির মামলা হয়েছে। এর আগের বছর

জানুয়ারিতে ১০৭টি, ফেব্রুয়ারিতে ৯৭টি, মার্চে ১১১টি, এপ্রিলে ১১৮টি, মে মাসে ৯৫টি, জুনে ১০৫টি, জুলাইতে ৯৪টি, আগস্টে ১০৪টি, সেপ্টেম্বরে ১০৬টি, অক্টোবরে ১০৬টি, নভেম্বরে ৭৯টি এবং ডিসেম্বরে ১০৫টি। মোট ১২২৭। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ৯১টি, ফেব্রুয়ারিতে ৮৫টি, মার্চে ৯৪টি, এপ্রিলে ১০৭টি, মে মাসে ৮৫টি, জুনে ৮৫টি, জুলাইতে ৯৭টি, আগস্টে ১০৭টি, সেপ্টেম্বরে ১০৯টি, অক্টোবরে ১০২টি, নভেম্বরে ৯২টি এবং ডিসেম্বরে ৭৪টি। সব মিলিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন সাতজন। এ ছাড়া অনেকে গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে অন্তত ৩৪ জন ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মামলা করেছেন। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন প্রায় শতাধিক ভুক্তভোগী। এ সময় একজন ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন।

আক্রান্ত সাংবাদিকরাও: কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ঢাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে প্রাণ রক্ষার্থে খুইয়েছেন ক্যামেরা, মোবাইল, টাকা আর ব্যাগ। গত ১৩ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ফটো সাংবাদিক মো. নাঈমুর রহমান রাত ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে মোহাম্মদপুর থানার বসিলা রোডস্থ তিন রাস্তার সামনে পৌঁছালে অজ্ঞাতনামা চারজন সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর ভয়ভীতি দেখায়। এ সময় তার কাছে থাকা নগদ ৭ হাজার টাকা, ক্যামেরার লেন্স, একটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

১৬ ডিসেম্বর ছুটির দিন সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনে থেকে মফিজুল ইসলাম সাদিক নামের একজন সংবাদকর্মীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি ছিনতাই হয়ে যায়।

তিনি বলেন, মোবাইলটি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ছিনতাইকারী। আশপাশে চিৎকার করলেও আমার কথা কেউ শোনেনি।’ পরে অবশ্য মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিনি থানায় জিডি করেছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে ডাকাতি: হাতিরঝিল থানা এলাকায় ডাকাতির ঘটনাটি ঘটে গত ৩০ নভেম্বর। মামলার এজাহার বলা হয়, পশ্চিম রামপুরার বাসিন্দা হোসনে আরা বেগমের বাসায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে ছয় ব্যক্তি প্রবেশ করেন। তারা হোসনে আরার স্বামী আবদুল বাশার চৌধুরীকে মারধর করে আলমারিতে রাখা ৪০ হাজার ডলার, নগদ ১১ লাখ টাকা, ১০ ভরি সোনার গয়না লুট করে নিয়ে যায়। ডাকাতির এই ঘটনায় ১ ডিসেম্বর হাতিরঝিল থানায় মামলা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে আরেকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর আদাবরে। গত ২৮ নভেম্বর আদাবরের একটি বাসায় গিয়ে ডাকাতেরা চার লাখ টাকার মালামাল লুট করে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

অভিযান চলছে: ঢাকার ছিনতাইপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে, কারা ছিনতাই করে, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ডিএমপির প্রত্যেক বিভাগের ডিসি, এডিসি ও এসিকে নজরদারি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক রাতে তারা গাড়ি নিয়ে মুভে থাকছেন এবং তদারকি করছেন। এ ছাড়া ডিএমপি কন্ট্রোল রুম থেকে ওয়ারলেসে পেট্রোগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে এবং তারা সজাগ আছে কি না, সেটিও তদারকি করা হচ্ছে। আবার যারা এসব ছিনতাইয়ের কাজে অভ্যস্ত, তাদের আদালতে প্রেরণ করলে তারা অতি সহজেই জামিনে বের হয়ে আসছে এবং আবার ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে।

ঢাকা মহানগরীতে ২ কোটির মত মানুষের বসবাস। তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এসব ছিনতাইকারী যেন সহজে জামিন না পায়, এজন্য আদালত বা সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছে পুলিশ।

ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর চেষ্টা করছি ঢাকা শহরে চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির মত ঘটনা যেন না হয়। ইতোমধ্যে ডিএমপির সবগুলো বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তারা ছিনতাইকারীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে। গত কয়েকদিনের প্রায় দুই শতাধিকের বেশি ছিনতাইকারীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ইদানিং মোবাইল ছিনতাই বেড়েছে। মোবাইল ছিনতাই প্রতিরোধেও পুলিশ মোড়ে মোড়ে কাজ করছে। এ ছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেলে মুহূর্তেই ছুটে যাচ্ছে পুলিশ।

এদিকে, ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের পাশাপাশি এলিট ফোর্স র‌্যাবও কাজ করছে। এজন্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে র‌্যাবের ব্যাটেলিয়নের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে ছিনতাই প্রতিরোধে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, ‘সম্প্রতি চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে র‌্যাব। র‌্যাবের প্রত্যেকটি ব্যাটালিয়নে সংশ্লিষ্ট এলাকার অপরাধপ্রবণ জায়গাগুলো নির্ধারণ করা হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় কোন সময়ে চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ বেশি হচ্ছে, সে অনুযায়ী টহল কার্যক্রমসহ চেকপোস্ট বাড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যরাত এবং ভোরে বাসসহ বিভিন্ন টার্মিনালে যখন যাত্রীরা নামেন, তখন ওইসব এলাকায় চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। ইতোমধ্যে র‌্যাব বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতারও করেছে।’

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ঘাটতির কারণে অপরাধ বাড়ছে

ঢাকায় বেপরোয়া ছিনতাইকারী

আপডেট সময় : ০৭:২৬:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫

বিশেষ সংবাদদাতা: রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েই চলছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে। পতিত সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় তাদের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আর এই মনোবল ঘাটতিকে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে অপরাধীরা।

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকারের সামনে যেসব বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসছে, তার মধ্যে অন্যতম আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। এর মধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊধ্বগতি।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ফিরে না আসার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। দুটি কারণে ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে। প্রথমত; দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেকেই এসব কাজে যুক্ত হচ্ছেন। দ্বিতীয়ত; আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয় উঠতে পারেনি।

একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে ছিনতাইয়ের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মাইনুল হাসান সোহেল। গত ২৪ ডিসেম্বর রাত ৯টার পর টিকাটুলির মোড়ের অফিস থেকে রিকশায় সেগুনবাগিচার ডিআরইউতে যাচ্ছিলেন। রিকশাটি দৈনিক বাংলা মোড়ে আসলে একদল ছিনতাইকারী গতিরোধ করে। এক সময় তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনটি তারা ছিনিয়ে নেয়।

ভুক্তভোগী এই সাংবাদিক বলেন, ছিনতাইকারীরা মোবাইল টার্গেট করে আক্রমণ করে। তারা আমার হাত ও পায়ে আঘাত করে। এক পযার্য়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরি। রাস্তায় প্রকাশ্যে ও মতিঝিলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ছিনতাইকারীরা যেভাবে আক্রমণ করেছে, সেক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতি হলেও হতে পারতো।

গত, ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ ছিনতাই হওয়া মোবাইলটি উদ্ধার করতে পারেনি বলে জানা যায়।

মতিঝিল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বলেন, ‘আমরা শুধু মোবাইল উদ্ধারই নয়, অপরাধীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে।

শুধু সাংবাদিক নয়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে শুধু সর্বস্বই খোয়াচ্ছন না, অনেককে জীবন দিতে হয়েছে জনবহুল এই শহরে।

ফ্লাইওভার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন হাফেজ কামরুল হাসান। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কাছে থাকা নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিতে চায় ছিনতাইকারীরা। ছিনতাইকারীদের বাধা দেওয়ায় তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা হাতে থাকা ধারালো চাকু দিয়ে বুকে আঘাত করে কামরুলের। ফ্লাইওভারের ওপর লুটিয়ে পড়লে ছিনতাইকারীরা তার কাছে থাকা একটি মোবাইল ফোন ও নগদ ৭ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। অবশ্য এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

হঠাৎ করে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, মিরপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল, শাহজাহানপুর, হাজারীবাগ, শাহ আলী, এমনকি গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। সন্ধ্যা নামতেই বেপরোয়া ছিনতাইচক্রের সদস্যরা। প্রায়শই গুরুতর আহত, এমনকি প্রাণহানির খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

যেসব থানায় ছিনতাই মামলা বেশি: অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকায় পুলিশের জনবলে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। পুলিশের সর্বোচ্চ পদ আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনার পদে পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বেশি আলোচনায় রয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকা।

এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে ঢাকায় গড়ে তিনটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল ও শাহজাহানপুর থানায়। দুটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে হাজারীবাগ, মিরপুর ও শাহআলী থানায়। একটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে ১৬টি থানায়। জানুয়ারিতে ১১৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ১২১টি, মার্চে ১৩৮টি, এপ্রিলে ৯৭টি, মে মাসে ১১৫টি, জুনে ১০৩টি, জুলাইতে ১০১টি এবং আগস্টে ৭০টি ছিনতাই ও ডাকাতির মামলা হয়েছে। এর আগের বছর

জানুয়ারিতে ১০৭টি, ফেব্রুয়ারিতে ৯৭টি, মার্চে ১১১টি, এপ্রিলে ১১৮টি, মে মাসে ৯৫টি, জুনে ১০৫টি, জুলাইতে ৯৪টি, আগস্টে ১০৪টি, সেপ্টেম্বরে ১০৬টি, অক্টোবরে ১০৬টি, নভেম্বরে ৭৯টি এবং ডিসেম্বরে ১০৫টি। মোট ১২২৭। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ৯১টি, ফেব্রুয়ারিতে ৮৫টি, মার্চে ৯৪টি, এপ্রিলে ১০৭টি, মে মাসে ৮৫টি, জুনে ৮৫টি, জুলাইতে ৯৭টি, আগস্টে ১০৭টি, সেপ্টেম্বরে ১০৯টি, অক্টোবরে ১০২টি, নভেম্বরে ৯২টি এবং ডিসেম্বরে ৭৪টি। সব মিলিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন সাতজন। এ ছাড়া অনেকে গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে অন্তত ৩৪ জন ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মামলা করেছেন। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন প্রায় শতাধিক ভুক্তভোগী। এ সময় একজন ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন।

আক্রান্ত সাংবাদিকরাও: কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ঢাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে প্রাণ রক্ষার্থে খুইয়েছেন ক্যামেরা, মোবাইল, টাকা আর ব্যাগ। গত ১৩ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ফটো সাংবাদিক মো. নাঈমুর রহমান রাত ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে মোহাম্মদপুর থানার বসিলা রোডস্থ তিন রাস্তার সামনে পৌঁছালে অজ্ঞাতনামা চারজন সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর ভয়ভীতি দেখায়। এ সময় তার কাছে থাকা নগদ ৭ হাজার টাকা, ক্যামেরার লেন্স, একটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

১৬ ডিসেম্বর ছুটির দিন সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনে থেকে মফিজুল ইসলাম সাদিক নামের একজন সংবাদকর্মীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি ছিনতাই হয়ে যায়।

তিনি বলেন, মোবাইলটি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ছিনতাইকারী। আশপাশে চিৎকার করলেও আমার কথা কেউ শোনেনি।’ পরে অবশ্য মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিনি থানায় জিডি করেছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে ডাকাতি: হাতিরঝিল থানা এলাকায় ডাকাতির ঘটনাটি ঘটে গত ৩০ নভেম্বর। মামলার এজাহার বলা হয়, পশ্চিম রামপুরার বাসিন্দা হোসনে আরা বেগমের বাসায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে ছয় ব্যক্তি প্রবেশ করেন। তারা হোসনে আরার স্বামী আবদুল বাশার চৌধুরীকে মারধর করে আলমারিতে রাখা ৪০ হাজার ডলার, নগদ ১১ লাখ টাকা, ১০ ভরি সোনার গয়না লুট করে নিয়ে যায়। ডাকাতির এই ঘটনায় ১ ডিসেম্বর হাতিরঝিল থানায় মামলা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে আরেকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর আদাবরে। গত ২৮ নভেম্বর আদাবরের একটি বাসায় গিয়ে ডাকাতেরা চার লাখ টাকার মালামাল লুট করে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

অভিযান চলছে: ঢাকার ছিনতাইপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে, কারা ছিনতাই করে, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ডিএমপির প্রত্যেক বিভাগের ডিসি, এডিসি ও এসিকে নজরদারি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক রাতে তারা গাড়ি নিয়ে মুভে থাকছেন এবং তদারকি করছেন। এ ছাড়া ডিএমপি কন্ট্রোল রুম থেকে ওয়ারলেসে পেট্রোগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে এবং তারা সজাগ আছে কি না, সেটিও তদারকি করা হচ্ছে। আবার যারা এসব ছিনতাইয়ের কাজে অভ্যস্ত, তাদের আদালতে প্রেরণ করলে তারা অতি সহজেই জামিনে বের হয়ে আসছে এবং আবার ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে।

ঢাকা মহানগরীতে ২ কোটির মত মানুষের বসবাস। তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এসব ছিনতাইকারী যেন সহজে জামিন না পায়, এজন্য আদালত বা সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছে পুলিশ।

ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর চেষ্টা করছি ঢাকা শহরে চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির মত ঘটনা যেন না হয়। ইতোমধ্যে ডিএমপির সবগুলো বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তারা ছিনতাইকারীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে। গত কয়েকদিনের প্রায় দুই শতাধিকের বেশি ছিনতাইকারীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ইদানিং মোবাইল ছিনতাই বেড়েছে। মোবাইল ছিনতাই প্রতিরোধেও পুলিশ মোড়ে মোড়ে কাজ করছে। এ ছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেলে মুহূর্তেই ছুটে যাচ্ছে পুলিশ।

এদিকে, ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের পাশাপাশি এলিট ফোর্স র‌্যাবও কাজ করছে। এজন্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে র‌্যাবের ব্যাটেলিয়নের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে ছিনতাই প্রতিরোধে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, ‘সম্প্রতি চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে র‌্যাব। র‌্যাবের প্রত্যেকটি ব্যাটালিয়নে সংশ্লিষ্ট এলাকার অপরাধপ্রবণ জায়গাগুলো নির্ধারণ করা হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় কোন সময়ে চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ বেশি হচ্ছে, সে অনুযায়ী টহল কার্যক্রমসহ চেকপোস্ট বাড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যরাত এবং ভোরে বাসসহ বিভিন্ন টার্মিনালে যখন যাত্রীরা নামেন, তখন ওইসব এলাকায় চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। ইতোমধ্যে র‌্যাব বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতারও করেছে।’