ঢাকা ০৭:৪৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫

ডেভিলস ব্রেথ-ব্ল্যাক ম্যাজিক ‘শয়তানের নিশ্বাস’ থেকে নিরাপদ থাকার উপায়

  • আপডেট সময় : ০৫:৩৬:৪৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৪২ বার পড়া হয়েছে

ড. কবিরুল বাশার : গত সপ্তাহে আমার স্ত্রী নিউমার্কেটে শপিং করতে গিয়েছিলেন। শপিং থেকে এসে আমাকে খুব আতঙ্কিত হয়ে বলছিলেন আর কখনো একা বাইরে যেতে পারবে না। মার্কেটে বোরকা পরা এক মহিলা তার সামনে এসে জুতা দেখিয়ে বলছে, ‘আপা জুতাটা কিনলাম দেখেন তো কেমন হয়েছে?’
জীববিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ায় আগে থেকেই আমার পরিবারের সব সদস্যদের আমি শয়তানের নিশ্বাস বা ডেভিলস ব্রেথ ও তার কার্যকারিতা সম্পর্কে আগেই জানিয়েছিলাম। বিষয়টি নিয়ে তার জানা থাকার কারণে ওই মার্কেটে সে বেঁচে গিয়েছে। আমার স্ত্রী দুই কদম পিছিয়ে যখন ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কেন আমাকে এটি দেখতে দিচ্ছেন?’
তখন খুব দ্রুত গতিতে মহিলা পালিয়ে গেলেন। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই এমন ঘটনার শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এবং ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা নানারকম ভিডিও দেখছি এ বিষয়ে। বিভিন্ন ভিডিওতে আপনারা দেখেছেন কোনো একজন অপরিচিত ব্যক্তি একজন পথচারীকে কোনো একটি ঠিকানা পড়তে দিচ্ছেন। ওই ঠিকানাটি পড়ার সময় টোকা দিয়ে বা তার নিশ্বাসের সঙ্গে স্কোপোলামিন (ঝপড়ঢ়ড়ষধসরহব) পাউডার শরীরে ঢুকে নার্ভাস সিস্টেমকে আক্রান্ত করছে এবং তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে ছিনতাইকারীর হাতে।
স্কোপোলামিন; যা সাধারণত ব্ল্যাক ম্যাজিক বা শয়তানের নিঃশ্বাস বা ডেভিলস ব্রেথ নামে পরিচিত। একটি শক্তিশালী ওষুধ; যার অপরাধমূলক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষের কাছে যা আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। স্কোপোলামিন মূলত চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হলেও অপরাধীরা এটিকে ব্যবহার করে জনসাধারণ বশীভূত ও বিভ্রান্ত করে ছিনতাই বা চুরি করে থাকে।
বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ওই হত্যার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। পরে আরও একজনকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে একজনের কাছে প্রথমবারের মতো স্কোপোলামিন পাওয়ার কথা জানায় পুলিশ। বোতলের ভেতর সাদা পাউডার আকারে কয়েক গ্রাম স্কোপোলামিনসহ আরও কয়েক ধরনের মাদক জব্দ করা হয়। পরে আদালতের আদেশ নিয়ে সিআইডি’র ল্যাবে টেস্ট করার পর সেখানে স্কোপোলামিন শনাক্ত হয়।
স্কোপোলামিন কী: স্কোপোলামিন হলো একটি ট্রোপেন অ্যালকালয়েড; যা ঝড়ষধহধপবধব (নাইটশেড) পরিবারের গাছ, বিশেষত হেনবেন এবং ধুতরাসহ একই পরিবারের বেশকিছু কাছে পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে এটি এই পরিবারের গাছ থেকে আহরিত হয়েছিল পরে কেমিক্যালি সিন্থেসিস করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হয়েছে।
স্কোপোলামিন মূলত একটি সিন্থেটিক ড্রাগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার আছে। বমি বমি ভাব, মোশন সিকনেস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন পরবর্তী রোগীর জন্য ওষুধে এর ব্যবহার রয়েছে। অতীতে এটি মানসিক রোগের চিকিৎসায় এবং সত্য কথা বলার ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে, এর অন্ধকার দিকটি হলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার, বিশেষত চুরি এবং হামলার ক্ষেত্রে। এটি তরল এবং পাউডার দুই রূপেই পাওয়া যায়।
স্কোপোলামিনের ইতিহাস: প্রাকৃতিকভাবে স্কোপোলামিন ধারণকারী কিছু গাছের মধ্যে রয়েছে অঃৎড়ঢ়ধ নবষষধফড়হহধ (ডেডলি নাইটশেড), ইৎঁমসধহংরধ (এঞ্জেলস ট্রাম্পেট), উধঃঁৎধ (জিমসন উইড), ঐুড়ংপুধসঁং হরমবৎ, গধহফৎধমড়ৎধ ড়ভভরপরহধৎঁস, ঝপড়ঢ়ড়ষরধ পধৎহরড়ষরপধ, খধঃঁধ ও উঁনড়রংরধ সুড়ঢ়ড়ৎড়রফবং। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সভ্যতায় এই গাছগুলো বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
স্কোপোলামিন হলো প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত অন্যতম প্রাথমিক অ্যালকালয়েডগুলোর মধ্যে একটি। এটি উদ্ভিদ থেকে পৃথক করার পর জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট লাডেনবার্গ ১৮৮০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি আলাদা করতে সক্ষম হন। তখন থেকেই স্কোপোলামিনের বিশুদ্ধ রূপ, যেমন হাইড্রোক্লোরাইড, হাইড্রোব্রমাইড, হাইড্রোআইওডাইড এবং সালফেট লবণের আকারে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৮৯৯ সালে ড. শ্নাইডারলিন অস্ত্রোপচারের অ্যানাস্থেসিয়ার জন্য স্কোপোলামিন ও মরফিনের সংমিশ্রণ ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এরপর এটি মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ১৯০২ সালে, রিচার্ড ফন স্টেইনবুচেল প্রথমবারের মতো প্রসূতি অ্যানাস্থেসিয়ায় (প্রসবকালীন ব্যথা উপশমের জন্য) স্কোপোলামিন ও মরফিন ব্যবহারের ধারণা দেন। পরে ১৯০৩ সালে কার্ল গাউস এটি আরও উন্নত করেন এবং ফ্রাইবুর্গ, জার্মানিতে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটি ড্যামারশ্লাফ (টুইলাইট স্লিপ বা ফ্রাইবুর্গ পদ্ধতি) নামে পরিচিত হয়।
এই পদ্ধতিটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বিভিন্ন ক্লিনিকে বিভিন্ন মাত্রায় ও উপাদানের সংমিশ্রণে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হতে থাকে। ১৯১৫ সালে কানাডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন জার্নালে এটি নিয়ে রিপোর্ট করা হয়। এটি ১৯৬০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বহুল ব্যবহৃত ছিল, তবে পরে রাসায়নিক ওষুধের প্রতি মানুষের ভীতি এবং আর স্বাভাবিক প্রসবের চাহিদার কারণে এটি বাদ দেওয়া হয়।
কীভাবে কাজ করে: স্কোপোলামিন মানুষের মস্তিষ্ক বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে, যা অ্যাসিটাইলকোলিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারকে ব্লক করে। এর ফলে নিম্নলিখিত প্রভাবগুলো দেখা যায়-
= স্মৃতিভ্রংশ।
= বিভ্রান্তি এবং দিশাহীনতা।
= মুখ শুষ্ক হওয়া এবং দৃষ্টিবিভ্রম।
= তন্দ্রাচ্ছন্নতা বা অজ্ঞান হয়ে পড়া।
= স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অভাব (শিকার সহজেই অপরাধীদের কথামতো কাজ করতে বাধ্য হয়)।
অপরাধীরা সাধারণত গুঁড়া বা তরল আকারে স্কোপোলামিন শিকারের মুখের দিকে ছুঁড়ে দেয় বা পানীয়তে মিশিয়ে দেয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভুক্তভোগী উচ্চমাত্রায় বশীভূত হয়ে পড়েন, বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন এবং প্রতিরোধ করার শক্তি থাকেন না। ফলে তারা সহজেই চুরির শিকার হন বা প্রতারণার শিকার হতে পারেন।
স্কোপোলামিনের অপরাধমূলক ব্যবহার ও প্রতিরোধের উপায়: স্কোপোলামিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোয় ব্যবহারের নজির আছে। তখন এর ব্যবহার হতো তরল বা লিকুইড হিসেবে, ইনজেকশনের মাধ্যমে। এটি প্রথম দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে ‘ট্রুথ সেরাম’ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অর্থাৎ, এই ইনজেকশন দিলে ব্যক্তি সত্য কথা বলতে শুরু করে কারণ তার মস্তিষ্কের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। সে তখন অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং অন্যের কথা শুনতে বাধ্য হয়।
স্কোপোলামিন মূলত পাউডার হিসেবে প্রতারণার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ভিজিটিং কার্ড, কাগজ, কাপড় কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনে এটি লাগিয়ে কৌশলে টার্গেট করা ব্যক্তিদের নিশ্বাসের কাছাকাছি আনা হয়। স্কোপোলামিন মানুষের নাকের চার থেকে ছয় ইঞ্চি কাছাকাছি আসলেই নিশ্বাসের আওতায় আসে। এটি নিশ্বাসের সঙ্গে ঢুকলেই মাত্র ১০ মিনিট বা তারও আগে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। মেমোরি এবং ব্রেন তখন সচেতনভাবে কাজ করতে পারে না। কারও ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতে এক ঘণ্টা লাগে, আবার কেউ তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেও স্বাভাবিক হতে পারে না।
উপসর্গ এবং তাৎক্ষণিক করণীয়: যদি মনে হয় যে স্কোপোলামিনের সংস্পর্শে এসেছেন, তাহলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
উপসর্গ চিহ্নিত করুন: আকস্মিক বিভ্রান্তি, মাথা ঘোরা, স্মৃতিভ্রংশ ও অতিরিক্ত বাধ্যতা।
তাৎক্ষণিক সাহায্য নিন: বিশ্বস্ত কারো সাথে যোগাযোগ করুন বা জরুরি পরিষেবাগুলো বিশেষ করে পুলিশকে জানান।
পানি পান: পর্যাপ্ত পানি পান করুন এবং জাগ্রত থাকার চেষ্টা করুন।
একাকী থাকবেন না: স্কোপোলামিন বিচারশক্তি দুর্বল করে, তাই নির্ভরযোগ্য কারো সাহচর্য গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসা নিন: হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সক্রিয় চারকোলের মতো ওষুধ গ্রহণ করুন; যা শরীরে ওষুধের শোষণ কমাতে পারে।
ব্যক্তিগত সম্পদ নিরাপদে রাখুন: যদি জনসমাগম স্থলে আক্রান্ত হন, তাহলে নিরাপত্তা কর্মী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করুন।
স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রেথ এমন একটি বিপজ্জনক পদার্থ যা অপরাধীরা তাদের শিকারের বোধশক্তি নষ্ট করে সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবহার করে। এর প্রভাব এতটাই তীব্র যে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের কার্যকলাপের কথা কিছুই মনে রাখতে পারে না। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। সকলে মিলে সচেতন থাকলে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিলে আমরা নিজেদের এবং আশেপাশের মানুষদের নিরাপদ রাখতে পারব।

লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ঢ়ৎড়ভবংংড়ৎশধনরৎঁষ@মসধরষ.পড়স

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ডেভিলস ব্রেথ-ব্ল্যাক ম্যাজিক ‘শয়তানের নিশ্বাস’ থেকে নিরাপদ থাকার উপায়

আপডেট সময় : ০৫:৩৬:৪৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ড. কবিরুল বাশার : গত সপ্তাহে আমার স্ত্রী নিউমার্কেটে শপিং করতে গিয়েছিলেন। শপিং থেকে এসে আমাকে খুব আতঙ্কিত হয়ে বলছিলেন আর কখনো একা বাইরে যেতে পারবে না। মার্কেটে বোরকা পরা এক মহিলা তার সামনে এসে জুতা দেখিয়ে বলছে, ‘আপা জুতাটা কিনলাম দেখেন তো কেমন হয়েছে?’
জীববিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ায় আগে থেকেই আমার পরিবারের সব সদস্যদের আমি শয়তানের নিশ্বাস বা ডেভিলস ব্রেথ ও তার কার্যকারিতা সম্পর্কে আগেই জানিয়েছিলাম। বিষয়টি নিয়ে তার জানা থাকার কারণে ওই মার্কেটে সে বেঁচে গিয়েছে। আমার স্ত্রী দুই কদম পিছিয়ে যখন ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কেন আমাকে এটি দেখতে দিচ্ছেন?’
তখন খুব দ্রুত গতিতে মহিলা পালিয়ে গেলেন। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই এমন ঘটনার শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এবং ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা নানারকম ভিডিও দেখছি এ বিষয়ে। বিভিন্ন ভিডিওতে আপনারা দেখেছেন কোনো একজন অপরিচিত ব্যক্তি একজন পথচারীকে কোনো একটি ঠিকানা পড়তে দিচ্ছেন। ওই ঠিকানাটি পড়ার সময় টোকা দিয়ে বা তার নিশ্বাসের সঙ্গে স্কোপোলামিন (ঝপড়ঢ়ড়ষধসরহব) পাউডার শরীরে ঢুকে নার্ভাস সিস্টেমকে আক্রান্ত করছে এবং তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে ছিনতাইকারীর হাতে।
স্কোপোলামিন; যা সাধারণত ব্ল্যাক ম্যাজিক বা শয়তানের নিঃশ্বাস বা ডেভিলস ব্রেথ নামে পরিচিত। একটি শক্তিশালী ওষুধ; যার অপরাধমূলক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষের কাছে যা আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। স্কোপোলামিন মূলত চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হলেও অপরাধীরা এটিকে ব্যবহার করে জনসাধারণ বশীভূত ও বিভ্রান্ত করে ছিনতাই বা চুরি করে থাকে।
বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ওই হত্যার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। পরে আরও একজনকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে একজনের কাছে প্রথমবারের মতো স্কোপোলামিন পাওয়ার কথা জানায় পুলিশ। বোতলের ভেতর সাদা পাউডার আকারে কয়েক গ্রাম স্কোপোলামিনসহ আরও কয়েক ধরনের মাদক জব্দ করা হয়। পরে আদালতের আদেশ নিয়ে সিআইডি’র ল্যাবে টেস্ট করার পর সেখানে স্কোপোলামিন শনাক্ত হয়।
স্কোপোলামিন কী: স্কোপোলামিন হলো একটি ট্রোপেন অ্যালকালয়েড; যা ঝড়ষধহধপবধব (নাইটশেড) পরিবারের গাছ, বিশেষত হেনবেন এবং ধুতরাসহ একই পরিবারের বেশকিছু কাছে পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে এটি এই পরিবারের গাছ থেকে আহরিত হয়েছিল পরে কেমিক্যালি সিন্থেসিস করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হয়েছে।
স্কোপোলামিন মূলত একটি সিন্থেটিক ড্রাগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার আছে। বমি বমি ভাব, মোশন সিকনেস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন পরবর্তী রোগীর জন্য ওষুধে এর ব্যবহার রয়েছে। অতীতে এটি মানসিক রোগের চিকিৎসায় এবং সত্য কথা বলার ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে, এর অন্ধকার দিকটি হলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার, বিশেষত চুরি এবং হামলার ক্ষেত্রে। এটি তরল এবং পাউডার দুই রূপেই পাওয়া যায়।
স্কোপোলামিনের ইতিহাস: প্রাকৃতিকভাবে স্কোপোলামিন ধারণকারী কিছু গাছের মধ্যে রয়েছে অঃৎড়ঢ়ধ নবষষধফড়হহধ (ডেডলি নাইটশেড), ইৎঁমসধহংরধ (এঞ্জেলস ট্রাম্পেট), উধঃঁৎধ (জিমসন উইড), ঐুড়ংপুধসঁং হরমবৎ, গধহফৎধমড়ৎধ ড়ভভরপরহধৎঁস, ঝপড়ঢ়ড়ষরধ পধৎহরড়ষরপধ, খধঃঁধ ও উঁনড়রংরধ সুড়ঢ়ড়ৎড়রফবং। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সভ্যতায় এই গাছগুলো বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
স্কোপোলামিন হলো প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত অন্যতম প্রাথমিক অ্যালকালয়েডগুলোর মধ্যে একটি। এটি উদ্ভিদ থেকে পৃথক করার পর জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট লাডেনবার্গ ১৮৮০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি আলাদা করতে সক্ষম হন। তখন থেকেই স্কোপোলামিনের বিশুদ্ধ রূপ, যেমন হাইড্রোক্লোরাইড, হাইড্রোব্রমাইড, হাইড্রোআইওডাইড এবং সালফেট লবণের আকারে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৮৯৯ সালে ড. শ্নাইডারলিন অস্ত্রোপচারের অ্যানাস্থেসিয়ার জন্য স্কোপোলামিন ও মরফিনের সংমিশ্রণ ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এরপর এটি মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ১৯০২ সালে, রিচার্ড ফন স্টেইনবুচেল প্রথমবারের মতো প্রসূতি অ্যানাস্থেসিয়ায় (প্রসবকালীন ব্যথা উপশমের জন্য) স্কোপোলামিন ও মরফিন ব্যবহারের ধারণা দেন। পরে ১৯০৩ সালে কার্ল গাউস এটি আরও উন্নত করেন এবং ফ্রাইবুর্গ, জার্মানিতে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটি ড্যামারশ্লাফ (টুইলাইট স্লিপ বা ফ্রাইবুর্গ পদ্ধতি) নামে পরিচিত হয়।
এই পদ্ধতিটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বিভিন্ন ক্লিনিকে বিভিন্ন মাত্রায় ও উপাদানের সংমিশ্রণে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হতে থাকে। ১৯১৫ সালে কানাডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন জার্নালে এটি নিয়ে রিপোর্ট করা হয়। এটি ১৯৬০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বহুল ব্যবহৃত ছিল, তবে পরে রাসায়নিক ওষুধের প্রতি মানুষের ভীতি এবং আর স্বাভাবিক প্রসবের চাহিদার কারণে এটি বাদ দেওয়া হয়।
কীভাবে কাজ করে: স্কোপোলামিন মানুষের মস্তিষ্ক বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে, যা অ্যাসিটাইলকোলিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারকে ব্লক করে। এর ফলে নিম্নলিখিত প্রভাবগুলো দেখা যায়-
= স্মৃতিভ্রংশ।
= বিভ্রান্তি এবং দিশাহীনতা।
= মুখ শুষ্ক হওয়া এবং দৃষ্টিবিভ্রম।
= তন্দ্রাচ্ছন্নতা বা অজ্ঞান হয়ে পড়া।
= স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অভাব (শিকার সহজেই অপরাধীদের কথামতো কাজ করতে বাধ্য হয়)।
অপরাধীরা সাধারণত গুঁড়া বা তরল আকারে স্কোপোলামিন শিকারের মুখের দিকে ছুঁড়ে দেয় বা পানীয়তে মিশিয়ে দেয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভুক্তভোগী উচ্চমাত্রায় বশীভূত হয়ে পড়েন, বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন এবং প্রতিরোধ করার শক্তি থাকেন না। ফলে তারা সহজেই চুরির শিকার হন বা প্রতারণার শিকার হতে পারেন।
স্কোপোলামিনের অপরাধমূলক ব্যবহার ও প্রতিরোধের উপায়: স্কোপোলামিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোয় ব্যবহারের নজির আছে। তখন এর ব্যবহার হতো তরল বা লিকুইড হিসেবে, ইনজেকশনের মাধ্যমে। এটি প্রথম দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে ‘ট্রুথ সেরাম’ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অর্থাৎ, এই ইনজেকশন দিলে ব্যক্তি সত্য কথা বলতে শুরু করে কারণ তার মস্তিষ্কের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। সে তখন অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং অন্যের কথা শুনতে বাধ্য হয়।
স্কোপোলামিন মূলত পাউডার হিসেবে প্রতারণার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ভিজিটিং কার্ড, কাগজ, কাপড় কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনে এটি লাগিয়ে কৌশলে টার্গেট করা ব্যক্তিদের নিশ্বাসের কাছাকাছি আনা হয়। স্কোপোলামিন মানুষের নাকের চার থেকে ছয় ইঞ্চি কাছাকাছি আসলেই নিশ্বাসের আওতায় আসে। এটি নিশ্বাসের সঙ্গে ঢুকলেই মাত্র ১০ মিনিট বা তারও আগে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। মেমোরি এবং ব্রেন তখন সচেতনভাবে কাজ করতে পারে না। কারও ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতে এক ঘণ্টা লাগে, আবার কেউ তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেও স্বাভাবিক হতে পারে না।
উপসর্গ এবং তাৎক্ষণিক করণীয়: যদি মনে হয় যে স্কোপোলামিনের সংস্পর্শে এসেছেন, তাহলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
উপসর্গ চিহ্নিত করুন: আকস্মিক বিভ্রান্তি, মাথা ঘোরা, স্মৃতিভ্রংশ ও অতিরিক্ত বাধ্যতা।
তাৎক্ষণিক সাহায্য নিন: বিশ্বস্ত কারো সাথে যোগাযোগ করুন বা জরুরি পরিষেবাগুলো বিশেষ করে পুলিশকে জানান।
পানি পান: পর্যাপ্ত পানি পান করুন এবং জাগ্রত থাকার চেষ্টা করুন।
একাকী থাকবেন না: স্কোপোলামিন বিচারশক্তি দুর্বল করে, তাই নির্ভরযোগ্য কারো সাহচর্য গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসা নিন: হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সক্রিয় চারকোলের মতো ওষুধ গ্রহণ করুন; যা শরীরে ওষুধের শোষণ কমাতে পারে।
ব্যক্তিগত সম্পদ নিরাপদে রাখুন: যদি জনসমাগম স্থলে আক্রান্ত হন, তাহলে নিরাপত্তা কর্মী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করুন।
স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রেথ এমন একটি বিপজ্জনক পদার্থ যা অপরাধীরা তাদের শিকারের বোধশক্তি নষ্ট করে সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবহার করে। এর প্রভাব এতটাই তীব্র যে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের কার্যকলাপের কথা কিছুই মনে রাখতে পারে না। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। সকলে মিলে সচেতন থাকলে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিলে আমরা নিজেদের এবং আশেপাশের মানুষদের নিরাপদ রাখতে পারব।

লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ঢ়ৎড়ভবংংড়ৎশধনরৎঁষ@মসধরষ.পড়স