ঢাকা ০৫:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ডেঙ্গু চিকিৎসায় হিমশিম
খরচের খাতায় বাড়তি চাপ

  • আপডেট সময় : ০২:৫৯:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ নভেম্বর ২০২২
  • ২০ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি বছরের শেষ দিকে মারাত্মক রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু, যা প্রাণঘাতীও হয়ে উঠছে; ধরন পাল্টে হঠাৎ রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতিতে দ্রুতই হাসপাতালে নিতে হচ্ছে, থাকাও লাগছে দীর্ঘ সময়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ কঠিন সময়ে পারিবারিক ব্যয় সামলাতে হিমশিম মানুষের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যয়।
ডেঙ্গুরোগী ও তাদের স্বজনরা বলছেন, এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়া রোগীদের খরচ অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। ভর্তির পর রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করছে খরচের পরিমাণ। হাসপাতালে ভর্তি, পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধ, বেড ভাড়া, নানা ধরনের পথ্য, প্লাটিলেট ও রক্ত দেওয়াসহ নানা খরচের ফর্দটা লম্বাই হতে থাকে অবস্থার বিচারে। যাদের দীর্ঘদিন থাকতে হয় তাদের ব্যয় বাড়তেই থাকে।
নি¤œ আয়ের মানুষের মতো সীমিত নি¤œ মধ্যবিত্তদেরও চিকিৎসার ব্যয় সামলাতে গিয়ে ধার করতে হচ্ছে আত্মীয় কিংবা শুভাকাঙ্খীদের থেকে। গত কয়েকদিন বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই জানিয়েছে একটি সংবাদসংস্থা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন দৈনন্দিন ব্যয় সামলানোর যুদ্ধের মধ্যে ডেঙ্গু চিকিৎসার বাড়তি খরচ তাদের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, ডেঙ্গু রোগীর চাপের কারণে সরকারিগুলোতে জায়গা না পাওয়ায় অনেককে রোগী নিয়ে যেতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। সেগুলোতে চিকিৎসা ব্যয় নির্ভর করে হাসপাতালের মানের ওপর। সরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা যে একেবারে বিনামূল্যে হয় তাও নয়। খরচের এ নতুন খাতের কারণে বড় অঙ্কের দেনার দায়ে পড়ার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছে তালতলা এলাকার শিশু সুলতানা। সে আছে ‘ফ্রি বেডে’ যেখানে চিকিৎসা, ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তবে লিভারে সমস্যা থাকায় তাকে একটি ওষুধ দেওয়া হয়েছে যেটি হাসপাতালে পাওয়া যায় না। সাড়ে তিন হাজার টাকা দামের ওষুধটি কিনতে গিয়ে দিশেহারা অবস্থা তার রিকশাচালক বাবার। সুলতানার বাবা মো. আলা উদ্দিন জানান, ১৩ নভেম্বর মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। অবস্থা দেখে চিকিৎসক ভর্তি করেছেন। এ পর্যন্ত ওষুধ কিনতে হয়েছে ১০ হাজার টাকার মতো। তিনি রিকশা চালান, তার স্ত্রী গৃহকর্মীর কাজ করেন। মেয়ের সুস্থতার পাশাপাশি চিকিৎসার খরচ জুগিয়ে সামনের মাসে বাসা ভাড়া দেবেন কীভাবে, খাবেন কী সেই চিন্তা ভর করেছে এ দম্পতির উপর।
“হাসপাতালের এক স্যার কিছু সাহায্য করতেছেন। আর কিছু ধার করছি। কয়দিন ধইরা আমিও কাজে যাইতে পারি না, ছোডটারে রাখতে হয়। হাসপাতালে দৌঁড়াইতে হয়,” বলছিলেন শিশুটির মা সীমা। তিনি বলেন, “বাচ্চার বাপের হার্টের অসুখ, ঠিকমত কাজ করতে পারে না। ছোট বাচ্চারে রাইখা আমিও বেশিক্ষণ কাজ করবার পারি না। এক মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি আছে, সামনের মাসের ভাড়াও ক্যা¤েœ দিমু, পোলাপান লইয়া কি খামু। চিন্তা করলে চউখ্যে আন্ধারা দেহি।” এ হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ভাসানটেক এলাকার ১০ বছরের শিশু সুমাইয়া। ‘পেয়িং বেডে’ ভর্তি এ শিশুর জন্য ওষুধ ও অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষায় এরই মধ্যে প্রায় ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। তার মা সীমা আক্তার জানান, ২৬৫০ টাকা দিয়ে ভর্তি করাতে হয়েছে। কয়েকটি পরীক্ষা করাতে হয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকায়, দৈনিক একটা রক্তের পরীক্ষা করতে হয় ৩০০ টাকায়। এছাড়া প্রতিদিন ওষুধ কিনতে হয় প্রায় তিন হাজার টাকার। “প্রতিদিনের এ খরচ পরিবারে চাপ তৈরি করেছে,” বলেন তিনি। “সরকারি হাসপাতাল হইলেও কিছু ওষুধ ছাড়া বাকিগুলা কিনা লাগে। তবে ডাক্তার-নার্সরা নিয়মিত খোঁজ খবর নিচ্ছে। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে ২০ হাজার টাকা চলে যাওয়া, এছাড়া খাবারদাবার আছে। আত্মীয়স্বজন আসছে ভাড়াসহ অন্যান্য খরচও লাগছে। আমাদের জন্য খুব চাপ তৈরি করে। আমাদের তো এত ইনকাম নাই।” সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের আর্থিক সহায়তা দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর। তবে তা সামান্য।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সমাজ সেবা কর্মকর্তা ইসরত জাহান ভূঁইয়া বলেন, “হাসপাতালের পেয়িং বেডে চিকিৎসাধীন রোগীদের সহায়তা দেওয়া হয়।” “প্রতি মাসে বরাদ্দ থাকে দুই লাখ টাকা। কিন্তু রোগীর চাপ অনেক। এ কারণে আমরা এই টাকাটা ১০০ জন রোগীকে দেওয়ার চেষ্টা করি। সবাই যেন কিছু পায়।” ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত পাঁচ দিন ধরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি মিরপুর এলাকার একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ষাটোর্ধ এখলাস মিয়া। তিনি বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসা, ওষুধ সব বিনামূল্যে দেয়। কিন্তু কিছু খাবার বাইরে থেইকা আনা লাগে, প্রতিদিন একটা-দুইটা ডাব খাইতে হয়। কিছু টাকা এমনিতেই চলে যায়, আমার ইনকাম আর কয় টাকা!” সীমিত আয়ের এসব মানুষের মত না হলেও মধ্যবিত্ত আর নি¤œবিত্তরাও ডেঙ্গু রোগের ব্যয় মেটাতে গিয়ে চাপে পড়েছেন।
ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর রাজধানীর মনোয়ারা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে গোড়ান এলাকার গৃহিণী জাকিয়া আহমেদকে। তার মেয়ে শারমিন সুলতানা জানান, তারা হাসপাতালের বিল দিয়েছেন এক লাখ টাকার বেশি। এছাড়া অন্যান্য খরচও ছিল।
“টাকাটা জোগাড় করতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। কারণ, আমাদের আব্বা নেই, ইনকাম সোর্স সেরকম নাই। আমার কাছে ক্যাশ ছিল না, ম্যানেজ করতে হয়েছে। এই খরচ আমাদের ওপর বাড়তি একটা চাপ তৈরি করেছে। এটা বিশাল একটা সমস্যা আমাদের ফ্যামিলির জন্য। কারণ এই টাকাটা আমাকে আবার ফেরত দিতে হবে।”
ডেঙ্গুতে হাসপাতালে আসার পর আর ফেরানো যায়নি নয় বছরের শিশু সিয়ামকে। গত ২৯ অক্টোবর রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যায় সায়েদাবাদের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদের এ সন্তান। তিনি জানান, ছেলের অবস্থা খারাপ হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান। দুদিন রাখতে হয় আইসিইউতে। সব মিলিয়ে এক লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। এ টাকা জোগাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। “আমি একটি পরিবহনের কাউন্টারে চাকরি করি। এখন আমার সংসার চালাইতে খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। টাকাটা আমি ধার করেছিলাম বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে।”
ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা তানজিম ইসলামের বাবা আসলাম হোসেন বলেন, “দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ ভোগান্তিতে আছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা করাতে গিয়ে আরও সমস্যা বেড়েছে।”
চিকিৎসা মোটামুটি ব্যয়বহুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাসপাতালে ভর্তি, বেড ভাড়া, প্লাটিলেট বা রক্ত দেওয়া, নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রতিনিয়তই বেশ টাকা খরচ হয়। এই ব্যয় বেশ প্রভাব ফেলেছে। ঢাকার মগবাজার ওয়্যারলেসগেট এলাকার নাজনিন সুলতানার ৬ বছরী মেয়ে মেহরিনকে ভর্তি করেছেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের শিশু বিভাগে। বুধবার তিনি বলেন, তিন দিন ধরে হাসপাতালে আছি। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। এ পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। “এখনও তো পুরো বিল দেই নাই। এ অবস্থায় আরও কিছু টাকা খরচ হয়ে যাবে, এটা একটা চাপই আমাদের জন্য।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, চিকিৎসা খরচ বেশি হয় যখন মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে যায়। ওষুধের দাম বাড়ায় এবার চিকিৎসার খরচ আরও বেড়েছে।
২০১৯ সালে ঢাকা মেডিকেল একটা ডেডিকেটেড ইউনিট খুলেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এরকম থাকলে মানুষ সেখানে যেতে পারে। তবে এবার কোভিড থাকায় চাইলেই আলাদা ইউনিট করা যায় না। ঢাকা মেডিকেলসহ সরকারি হাসপাতালে কিছু ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সেখানেও ক্যাপাসিটির ঘাটতি আছে। ফলে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছে।
সরকারকে ডেঙ্গু প্রতিরোধের পরামর্শ দিয়ে এজন্য সব ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন তিনি। একই সঙ্গে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন তিনি। “চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাইরে থেকে যেন কোনোকিছু কিনতে না হয় সেটাও দেখতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
আরও ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৪৭৭ রোগী : দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বাড়ছে মৃত্যুও। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তিন জন মারা গেছেন। একই সময়ে ৪৭৭ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো দুই হাজার ৮২ জনে। এছাড়া চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৪০ জন।
গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪৭৭ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২৬২ জন। এছাড়া ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১৫ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ৪৭৭ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮২ জনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরে ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সর্বমোট ৫৪ হাজার ৪০৫ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছন ৫২ হাজার ৮৩ জন। এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এনিয়ে ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৪০ জনের। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জন মারা যান।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার লার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ডেঙ্গু চিকিৎসায় হিমশিম
খরচের খাতায় বাড়তি চাপ

আপডেট সময় : ০২:৫৯:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ নভেম্বর ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি বছরের শেষ দিকে মারাত্মক রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু, যা প্রাণঘাতীও হয়ে উঠছে; ধরন পাল্টে হঠাৎ রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতিতে দ্রুতই হাসপাতালে নিতে হচ্ছে, থাকাও লাগছে দীর্ঘ সময়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ কঠিন সময়ে পারিবারিক ব্যয় সামলাতে হিমশিম মানুষের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যয়।
ডেঙ্গুরোগী ও তাদের স্বজনরা বলছেন, এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়া রোগীদের খরচ অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। ভর্তির পর রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করছে খরচের পরিমাণ। হাসপাতালে ভর্তি, পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধ, বেড ভাড়া, নানা ধরনের পথ্য, প্লাটিলেট ও রক্ত দেওয়াসহ নানা খরচের ফর্দটা লম্বাই হতে থাকে অবস্থার বিচারে। যাদের দীর্ঘদিন থাকতে হয় তাদের ব্যয় বাড়তেই থাকে।
নি¤œ আয়ের মানুষের মতো সীমিত নি¤œ মধ্যবিত্তদেরও চিকিৎসার ব্যয় সামলাতে গিয়ে ধার করতে হচ্ছে আত্মীয় কিংবা শুভাকাঙ্খীদের থেকে। গত কয়েকদিন বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই জানিয়েছে একটি সংবাদসংস্থা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন দৈনন্দিন ব্যয় সামলানোর যুদ্ধের মধ্যে ডেঙ্গু চিকিৎসার বাড়তি খরচ তাদের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, ডেঙ্গু রোগীর চাপের কারণে সরকারিগুলোতে জায়গা না পাওয়ায় অনেককে রোগী নিয়ে যেতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। সেগুলোতে চিকিৎসা ব্যয় নির্ভর করে হাসপাতালের মানের ওপর। সরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা যে একেবারে বিনামূল্যে হয় তাও নয়। খরচের এ নতুন খাতের কারণে বড় অঙ্কের দেনার দায়ে পড়ার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছে তালতলা এলাকার শিশু সুলতানা। সে আছে ‘ফ্রি বেডে’ যেখানে চিকিৎসা, ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তবে লিভারে সমস্যা থাকায় তাকে একটি ওষুধ দেওয়া হয়েছে যেটি হাসপাতালে পাওয়া যায় না। সাড়ে তিন হাজার টাকা দামের ওষুধটি কিনতে গিয়ে দিশেহারা অবস্থা তার রিকশাচালক বাবার। সুলতানার বাবা মো. আলা উদ্দিন জানান, ১৩ নভেম্বর মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। অবস্থা দেখে চিকিৎসক ভর্তি করেছেন। এ পর্যন্ত ওষুধ কিনতে হয়েছে ১০ হাজার টাকার মতো। তিনি রিকশা চালান, তার স্ত্রী গৃহকর্মীর কাজ করেন। মেয়ের সুস্থতার পাশাপাশি চিকিৎসার খরচ জুগিয়ে সামনের মাসে বাসা ভাড়া দেবেন কীভাবে, খাবেন কী সেই চিন্তা ভর করেছে এ দম্পতির উপর।
“হাসপাতালের এক স্যার কিছু সাহায্য করতেছেন। আর কিছু ধার করছি। কয়দিন ধইরা আমিও কাজে যাইতে পারি না, ছোডটারে রাখতে হয়। হাসপাতালে দৌঁড়াইতে হয়,” বলছিলেন শিশুটির মা সীমা। তিনি বলেন, “বাচ্চার বাপের হার্টের অসুখ, ঠিকমত কাজ করতে পারে না। ছোট বাচ্চারে রাইখা আমিও বেশিক্ষণ কাজ করবার পারি না। এক মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি আছে, সামনের মাসের ভাড়াও ক্যা¤েœ দিমু, পোলাপান লইয়া কি খামু। চিন্তা করলে চউখ্যে আন্ধারা দেহি।” এ হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ভাসানটেক এলাকার ১০ বছরের শিশু সুমাইয়া। ‘পেয়িং বেডে’ ভর্তি এ শিশুর জন্য ওষুধ ও অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষায় এরই মধ্যে প্রায় ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। তার মা সীমা আক্তার জানান, ২৬৫০ টাকা দিয়ে ভর্তি করাতে হয়েছে। কয়েকটি পরীক্ষা করাতে হয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকায়, দৈনিক একটা রক্তের পরীক্ষা করতে হয় ৩০০ টাকায়। এছাড়া প্রতিদিন ওষুধ কিনতে হয় প্রায় তিন হাজার টাকার। “প্রতিদিনের এ খরচ পরিবারে চাপ তৈরি করেছে,” বলেন তিনি। “সরকারি হাসপাতাল হইলেও কিছু ওষুধ ছাড়া বাকিগুলা কিনা লাগে। তবে ডাক্তার-নার্সরা নিয়মিত খোঁজ খবর নিচ্ছে। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে ২০ হাজার টাকা চলে যাওয়া, এছাড়া খাবারদাবার আছে। আত্মীয়স্বজন আসছে ভাড়াসহ অন্যান্য খরচও লাগছে। আমাদের জন্য খুব চাপ তৈরি করে। আমাদের তো এত ইনকাম নাই।” সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের আর্থিক সহায়তা দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর। তবে তা সামান্য।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সমাজ সেবা কর্মকর্তা ইসরত জাহান ভূঁইয়া বলেন, “হাসপাতালের পেয়িং বেডে চিকিৎসাধীন রোগীদের সহায়তা দেওয়া হয়।” “প্রতি মাসে বরাদ্দ থাকে দুই লাখ টাকা। কিন্তু রোগীর চাপ অনেক। এ কারণে আমরা এই টাকাটা ১০০ জন রোগীকে দেওয়ার চেষ্টা করি। সবাই যেন কিছু পায়।” ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত পাঁচ দিন ধরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি মিরপুর এলাকার একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ষাটোর্ধ এখলাস মিয়া। তিনি বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসা, ওষুধ সব বিনামূল্যে দেয়। কিন্তু কিছু খাবার বাইরে থেইকা আনা লাগে, প্রতিদিন একটা-দুইটা ডাব খাইতে হয়। কিছু টাকা এমনিতেই চলে যায়, আমার ইনকাম আর কয় টাকা!” সীমিত আয়ের এসব মানুষের মত না হলেও মধ্যবিত্ত আর নি¤œবিত্তরাও ডেঙ্গু রোগের ব্যয় মেটাতে গিয়ে চাপে পড়েছেন।
ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর রাজধানীর মনোয়ারা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে গোড়ান এলাকার গৃহিণী জাকিয়া আহমেদকে। তার মেয়ে শারমিন সুলতানা জানান, তারা হাসপাতালের বিল দিয়েছেন এক লাখ টাকার বেশি। এছাড়া অন্যান্য খরচও ছিল।
“টাকাটা জোগাড় করতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। কারণ, আমাদের আব্বা নেই, ইনকাম সোর্স সেরকম নাই। আমার কাছে ক্যাশ ছিল না, ম্যানেজ করতে হয়েছে। এই খরচ আমাদের ওপর বাড়তি একটা চাপ তৈরি করেছে। এটা বিশাল একটা সমস্যা আমাদের ফ্যামিলির জন্য। কারণ এই টাকাটা আমাকে আবার ফেরত দিতে হবে।”
ডেঙ্গুতে হাসপাতালে আসার পর আর ফেরানো যায়নি নয় বছরের শিশু সিয়ামকে। গত ২৯ অক্টোবর রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যায় সায়েদাবাদের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদের এ সন্তান। তিনি জানান, ছেলের অবস্থা খারাপ হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান। দুদিন রাখতে হয় আইসিইউতে। সব মিলিয়ে এক লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। এ টাকা জোগাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। “আমি একটি পরিবহনের কাউন্টারে চাকরি করি। এখন আমার সংসার চালাইতে খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। টাকাটা আমি ধার করেছিলাম বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে।”
ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা তানজিম ইসলামের বাবা আসলাম হোসেন বলেন, “দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ ভোগান্তিতে আছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা করাতে গিয়ে আরও সমস্যা বেড়েছে।”
চিকিৎসা মোটামুটি ব্যয়বহুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাসপাতালে ভর্তি, বেড ভাড়া, প্লাটিলেট বা রক্ত দেওয়া, নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রতিনিয়তই বেশ টাকা খরচ হয়। এই ব্যয় বেশ প্রভাব ফেলেছে। ঢাকার মগবাজার ওয়্যারলেসগেট এলাকার নাজনিন সুলতানার ৬ বছরী মেয়ে মেহরিনকে ভর্তি করেছেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের শিশু বিভাগে। বুধবার তিনি বলেন, তিন দিন ধরে হাসপাতালে আছি। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। এ পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। “এখনও তো পুরো বিল দেই নাই। এ অবস্থায় আরও কিছু টাকা খরচ হয়ে যাবে, এটা একটা চাপই আমাদের জন্য।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, চিকিৎসা খরচ বেশি হয় যখন মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে যায়। ওষুধের দাম বাড়ায় এবার চিকিৎসার খরচ আরও বেড়েছে।
২০১৯ সালে ঢাকা মেডিকেল একটা ডেডিকেটেড ইউনিট খুলেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এরকম থাকলে মানুষ সেখানে যেতে পারে। তবে এবার কোভিড থাকায় চাইলেই আলাদা ইউনিট করা যায় না। ঢাকা মেডিকেলসহ সরকারি হাসপাতালে কিছু ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সেখানেও ক্যাপাসিটির ঘাটতি আছে। ফলে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছে।
সরকারকে ডেঙ্গু প্রতিরোধের পরামর্শ দিয়ে এজন্য সব ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন তিনি। একই সঙ্গে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন তিনি। “চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাইরে থেকে যেন কোনোকিছু কিনতে না হয় সেটাও দেখতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
আরও ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৪৭৭ রোগী : দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বাড়ছে মৃত্যুও। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তিন জন মারা গেছেন। একই সময়ে ৪৭৭ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো দুই হাজার ৮২ জনে। এছাড়া চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৪০ জন।
গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪৭৭ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২৬২ জন। এছাড়া ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১৫ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ৪৭৭ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮২ জনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরে ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সর্বমোট ৫৪ হাজার ৪০৫ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছন ৫২ হাজার ৮৩ জন। এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এনিয়ে ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৪০ জনের। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জন মারা যান।