ঢাকা ১২:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডিমের দাম ও ডিম ছুড়ে মারা

  • আপডেট সময় : ১১:২৯:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ২৮ বার পড়া হয়েছে

চিররঞ্জন সরকার : ‘ফেসবুকে’ জিনিসপত্রের দাম কমলেও বাজারে তা দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট, আওয়ামী চাঁদাবাজরা না থাকলেও জিনিসপত্রের দামে খুব একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। মধ্যবিত্তদের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিমের দাম। খুচরা বাজারে একটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ টাকায়। এমন দামের জন্য হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা। দাম নিয়ে চলছে তর্কাতর্কি। ক্রেতারা দায়ী করছে ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা দায়ী করছে খামারিদের। খামারিরা দায়ী করছে পোলট্রি সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিকে। এক রসিক ব্যবসায়ী ডিমের দাম বাড়ার জন্য গ্রেপ্তার হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের দায়ী করেছেন। তার মতে, ‘এখন গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের উদ্দেশে আদালতে নিয়মিত ডিম ছোড়া হচ্ছে। ফলে ডিমের ওপর চাপ বেড়েছে। ফলে দামও বেড়েছে!’
কারণ যাই হোক, ডিমের দাম না কমলে মানুষ কিন্তু লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেলতে পারে। যারা আন্দোলন করে, তাদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ডিম। খাদ্য হিসেবে ডিমের কোনো তুলনা নেই। ডিম গরিবের খাবার, মধ্যবিত্তের খাবার, এমনকি বড়লোকেরও খাবার। তবে মধ্যবিত্তের খাবার হিসেবে শীর্ষে। হোস্টেল-ছাত্রাবাসগুলোতেও ডিম ছাড়া একদিনও চলে না। ডিম দিয়ে কী হয়? এই প্রশ্নের চেয়ে ডিম দিয়ে কী না হয়, বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। ডিম ভাজি, ডিম চপ, ডিমের কোরমা, সিদ্ধ ডিম, ডিমের ভুনা, ডিমের অমলেট, ডিমের পাকোড়াসহ আধুনিক সময়ের এগ চ্যাট, এগ সালাদ কিংবা ডিমের মুত্তা এভিয়াল কত না রেসিপি। এ কারণে ডিম ডিমই। তবে ডিম নিয়ে মজার তর্ক আছে— ডিম আগে, না মুরগি আগে? উত্তর দিতে হিমশিম খেয়েছেন অনেকেই। কিন্তু উত্তরটা সহজ— ডিম আগে। কারণ, আমাদের অনেকের সকালটা তো শুরু হয় ডিম দিয়েই! তবে ডিম খাওয়া নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। কখনো শোনা যায় ডিম খেলে কোনো অসুবিধা নেই। কখনো বলা হয় সপ্তাহে তিনটির বেশি নয়। কখনো বলা হয়, বয়স যত বাড়বে, ডিম তত কমানো দরকার। কখনো বলা হয়, ডিম খাও যত খুশি, যে বয়সে খুশি, তবে কুসুম ছাড়া। আবার কেউ বলেন, দিনে একটা-দুইটা ডিম খেলে কিছুই হয় না, তা বয়স যতই হোক। এগুলো কোনো সাধারণ কথা নয়, রীতিমতো গবেষণা করে বের করা, পুষ্টিবিজ্ঞানীদের কথা। কোনটা যে সত্য আর কোনটা অসত্য বলা কঠিন। তবে ডিমখেকোরা এসব গবেষণার তোয়াক্কা না করেই ডিম খেয়ে যাচ্ছেন। অকাতরে। বেশুমার।
আমরা সাধারণত মুরগির ডিম বেশি খাই। এর বাইরে হাঁসের ডিমও প্রচলিত। ইদানীং কোয়েলের ডিমও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ডিম কেবল হাঁস-মুরগি-কোয়েলই পাড়ে না। জগতের আরও অনেক প্রাণী পাড়ে। কিন্তু আমরা তা খাই না। মশা পাড়ে, কচ্ছপ পাড়ে, কুমির পাড়ে, সাপ পাড়ে, তেলাপোকা পাড়ে, মাকড়সা পাড়ে, পাখি পাড়ে— জগতের আরও অনেক প্রাণী পাড়ে। ডিমের বদনামও কম নয়। সন্তান পরীক্ষা দিতে যাবে। মা কিছুতেই ডিম খাওয়াবেন না। তার ধারণা, ডিম খেয়ে গেলে পরীক্ষা ভালো হবে না, ডিম পাবে।
আপনার কাছে যদি দুটো ডিম থাকে, তাহলে আপনি কী করবেন? ভেজে খেয়ে ফেলবেন? বাচ্চা ফোটানোর জন্য তা দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন? না অন্যকে দিয়ে দেবেন? যাই করুন, ওটা একান্তই আপনার ব্যাপার। যদি অন্যদের হাতে দুটো ডিম থাকে, তাহলে তারা কী করবে?
আমেরিকান রাজনীতিবিদ: দুটো ডিমের একটা বিক্রি করে দেবেন। তারপর সামরিক অভিযানের ভয় দেখিয়ে আরেকটা ডিমকে চারটা ডিমের সমান হতে বলবেন, চারটা কুসুমও রাখতে বলবেন তাতে।
চীনা অর্থনীতিবিদ: তারা ডিম দুটোকে দশ ভাগের এক ভাগ ছোট করে ফেলবেন। কিন্তু সেটা ভাঙলেই ফুটবলের মতো বড় একটা কুসুম বের হয়ে আসবে সেখান থেকে। তারপর সারা বিশ্ব একচেটিয়া বাজারজাত করবে এটা।
বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ: ডিম দুটো যেমন ছিল তেমনই থাকবে। বিদেশ থেকে আরও দুটো ডিম উচ্চমূল্যে এবং শর্তসাপেক্ষে কিনে আনবেন আরও অভিজ্ঞতা অর্জনের কথা বলে। এ বাবদ বিশাল টাকার বাজেট করা হবে। বিদেশ থেকে আনা ডিম দুটো নতুন পরিবেশে নষ্ট হতে থাকবে। তাদের ভালো রাখার জন্য এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে একজন দক্ষ পরামর্শক নিয়োগ ও চারজন কেয়ারটেকার আনা হবে। এ বাবদ আরও বিশাল অংকের বাজেট হবে। অন্যদিকে, নিজের ডিম দুটো সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্নের অভাবে নষ্ট হয়ে যাবে একদিন!
ডিম যে মানুষকে কেবল পুষ্টি দেয় তা নয়, আরও উপকার করে। যেমন খারাপ নাটক, খারাপ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি পণ্ড করতে বা নিজেদের আপত্তি জানাতে ডিম ছুড়ে মারা হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিশুদ্ধ ডিম দিয়ে কাজটি হয় না। প্রয়োজন হয় পচা ডিমের। পচা অভিনেতা, পচা শিল্পী, পচা বক্তার জন্য পচা ডিম। দর্শক গ্যালারি থেকে মঞ্চের দিকে ছুড়ে দিতে হয় পচা ডিম। পচা ডিমের কাজ এখানেই শেষ নয়। অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের প্রতিও প্রতিপক্ষ কিংবা বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা ডিম ছুড়ে মারে।
ডিম নিক্ষেপের ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর অভিবাসী মুসলমানদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যকারী অস্ট্রেলিয়ার সিনেটর ফ্রেজার অ্যানিংয়ের মাথায় ডিম ছুড়ে মেরে ইন্টারনেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে ওঠে উইল কনোলি। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ওই সিনেটর মেলবোর্নে যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, সে সময় পেছন দিকে থেকে এসে ওই কিশোর তার মাথায় অতর্কিতে ডিম ফাটায়।
১৭ বছর বয়সী ওই বালকের এমন দুঃসাহসী কাজে আপ্লুত হয়ে প্রশংসার পাশাপাশি তাকে দেওয়া হয়েছিল নানা ধরনের অফার। সারা জীবনের জন্য ফ্রি-টিকিটের অফার করেছিল অস্ট্রেলীয় হিপহপ ব্যান্ড ‘হিলটপ হুডস’। এছাড়া, জনপ্রিয় মেটাল কোর ব্যান্ড অ্যামিটি অ্যাফলিকশন আরও একধাপ এগিয়ে। তারা কনোলিকে তাদের দলের সদস্য করাসহ তাদের শো উপভোগ করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনি একই ধরনের প্রস্তাব পেয়েছিলেন রক ব্যান্ড জেবিদিয়াহ, হুয়েটাসের কাছ থেকেও। আর বিশ্বের নানা প্রান্তের বিভিন্ন ব্যান্ড তাকে ফ্রিতে তাদের শো দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
সে সময় কনোলির পক্ষে আইনি লড়াই ও ডিম কেনার তহবিলে জমা পড়ে বাংলাদেশি টাকায় ৪৯ লাখের বেশি টাকা। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে হামলায় নিহত মুসলিম পরিবারদের দান করার ঘোষণা দিয়েছিলেন এই বিস্ময় বালক। কারও মাথায় ডিম ভেঙে বিশ্বব্যাপী এত খ্যাতি পাওয়া প্রথম ব্যক্তি সম্ভবত উইল কনোলি। তার এই খ্যাতি দেখেই অনুপ্রাণিত হয়ে এক সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা তৎকালীন ডাকসু ভিপি নূরের মাথায় ডিম ছোড়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। কালের পরিক্রমায় ওই ছাত্রলীগের বীর সেনানীরা এখন লা-পাত্তা। আর ডিম-নিক্ষেপের শিকার হওয়া ভিপি নূর এখন বীরবিক্রমে চলাফেরা করছেন। অন্তর্র্বতী সরকারকে নানা ধরনের উপদেশ-পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে এখন যারা ডিম নিক্ষেপের শিকার হচ্ছেন এবং যারা ডিম ছুড়ছেন তাদের সবারই ডিম-ক্যাচ প্র্যাকটিস করা দরকার। প্রয়োজনে জন্টি রোডসের (ক্রিকেটার) সহায়তা নিতে পারেন। কেননা আমাদের দেশের রাজনীতিতে ডিম-নিক্ষেপের খেলা সহজে থামবে বলে মনে হয় না। এখন যারা ডিম ছুড়ছেন, আগামী দিনে তাদের দিকে ডিম ধেয়ে আসবে না, ওই গ্যারান্টি কে দিতে পারে?
আরেকটি কথা, ডিম নিক্ষেপের মতো অপচয়মূলক কাজটি না করাই ভালো। ডিম নিক্ষেপ না করে যদি ওই ডিমটি ভেজে কিংবা সিদ্ধ করে খান, তাহলে অনেক বেশি আনন্দ পাবেন!
পরিশেষে পাঠকদের জন্য একটি পুরনো কৌতুক।
এক কৃপণ গৃহস্থ একবার ক্ষেপে গিয়ে তার সব মুরগিকে বললেন, আগামীকাল থেকে যদি প্রতিদিন ২টা করে ডিম না দিস তাহলে ধরে জবাই করে খেয়ে ফেলব! এরপর থেকে প্রত্যেকটা মুরগিই প্রতিদিন দুইটা করে ডিম দিতে লাগল। শুধু একটা বাদে! ওইটা প্রতিদিন একটা করেই ডিম পাড়তে লাগল। গৃহস্থ ক্ষেপে গিয়ে বললেন, কিরে! তোর তো সাহস কম না! এত বড় হুমকি দিলাম, এরপরও একটা করে ডিম পারতেছিস! মুরগির জবাব: জনাব! আপনার ভয়ে তাও তো বহু কষ্টে একটা করে ডিম পাড়ছি! আমি আসলে যে মোরগ!
লেখক: কলামিস্ট

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ডিমের দাম ও ডিম ছুড়ে মারা

আপডেট সময় : ১১:২৯:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

চিররঞ্জন সরকার : ‘ফেসবুকে’ জিনিসপত্রের দাম কমলেও বাজারে তা দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট, আওয়ামী চাঁদাবাজরা না থাকলেও জিনিসপত্রের দামে খুব একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। মধ্যবিত্তদের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিমের দাম। খুচরা বাজারে একটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ টাকায়। এমন দামের জন্য হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা। দাম নিয়ে চলছে তর্কাতর্কি। ক্রেতারা দায়ী করছে ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা দায়ী করছে খামারিদের। খামারিরা দায়ী করছে পোলট্রি সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিকে। এক রসিক ব্যবসায়ী ডিমের দাম বাড়ার জন্য গ্রেপ্তার হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের দায়ী করেছেন। তার মতে, ‘এখন গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের উদ্দেশে আদালতে নিয়মিত ডিম ছোড়া হচ্ছে। ফলে ডিমের ওপর চাপ বেড়েছে। ফলে দামও বেড়েছে!’
কারণ যাই হোক, ডিমের দাম না কমলে মানুষ কিন্তু লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেলতে পারে। যারা আন্দোলন করে, তাদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ডিম। খাদ্য হিসেবে ডিমের কোনো তুলনা নেই। ডিম গরিবের খাবার, মধ্যবিত্তের খাবার, এমনকি বড়লোকেরও খাবার। তবে মধ্যবিত্তের খাবার হিসেবে শীর্ষে। হোস্টেল-ছাত্রাবাসগুলোতেও ডিম ছাড়া একদিনও চলে না। ডিম দিয়ে কী হয়? এই প্রশ্নের চেয়ে ডিম দিয়ে কী না হয়, বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। ডিম ভাজি, ডিম চপ, ডিমের কোরমা, সিদ্ধ ডিম, ডিমের ভুনা, ডিমের অমলেট, ডিমের পাকোড়াসহ আধুনিক সময়ের এগ চ্যাট, এগ সালাদ কিংবা ডিমের মুত্তা এভিয়াল কত না রেসিপি। এ কারণে ডিম ডিমই। তবে ডিম নিয়ে মজার তর্ক আছে— ডিম আগে, না মুরগি আগে? উত্তর দিতে হিমশিম খেয়েছেন অনেকেই। কিন্তু উত্তরটা সহজ— ডিম আগে। কারণ, আমাদের অনেকের সকালটা তো শুরু হয় ডিম দিয়েই! তবে ডিম খাওয়া নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। কখনো শোনা যায় ডিম খেলে কোনো অসুবিধা নেই। কখনো বলা হয় সপ্তাহে তিনটির বেশি নয়। কখনো বলা হয়, বয়স যত বাড়বে, ডিম তত কমানো দরকার। কখনো বলা হয়, ডিম খাও যত খুশি, যে বয়সে খুশি, তবে কুসুম ছাড়া। আবার কেউ বলেন, দিনে একটা-দুইটা ডিম খেলে কিছুই হয় না, তা বয়স যতই হোক। এগুলো কোনো সাধারণ কথা নয়, রীতিমতো গবেষণা করে বের করা, পুষ্টিবিজ্ঞানীদের কথা। কোনটা যে সত্য আর কোনটা অসত্য বলা কঠিন। তবে ডিমখেকোরা এসব গবেষণার তোয়াক্কা না করেই ডিম খেয়ে যাচ্ছেন। অকাতরে। বেশুমার।
আমরা সাধারণত মুরগির ডিম বেশি খাই। এর বাইরে হাঁসের ডিমও প্রচলিত। ইদানীং কোয়েলের ডিমও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ডিম কেবল হাঁস-মুরগি-কোয়েলই পাড়ে না। জগতের আরও অনেক প্রাণী পাড়ে। কিন্তু আমরা তা খাই না। মশা পাড়ে, কচ্ছপ পাড়ে, কুমির পাড়ে, সাপ পাড়ে, তেলাপোকা পাড়ে, মাকড়সা পাড়ে, পাখি পাড়ে— জগতের আরও অনেক প্রাণী পাড়ে। ডিমের বদনামও কম নয়। সন্তান পরীক্ষা দিতে যাবে। মা কিছুতেই ডিম খাওয়াবেন না। তার ধারণা, ডিম খেয়ে গেলে পরীক্ষা ভালো হবে না, ডিম পাবে।
আপনার কাছে যদি দুটো ডিম থাকে, তাহলে আপনি কী করবেন? ভেজে খেয়ে ফেলবেন? বাচ্চা ফোটানোর জন্য তা দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন? না অন্যকে দিয়ে দেবেন? যাই করুন, ওটা একান্তই আপনার ব্যাপার। যদি অন্যদের হাতে দুটো ডিম থাকে, তাহলে তারা কী করবে?
আমেরিকান রাজনীতিবিদ: দুটো ডিমের একটা বিক্রি করে দেবেন। তারপর সামরিক অভিযানের ভয় দেখিয়ে আরেকটা ডিমকে চারটা ডিমের সমান হতে বলবেন, চারটা কুসুমও রাখতে বলবেন তাতে।
চীনা অর্থনীতিবিদ: তারা ডিম দুটোকে দশ ভাগের এক ভাগ ছোট করে ফেলবেন। কিন্তু সেটা ভাঙলেই ফুটবলের মতো বড় একটা কুসুম বের হয়ে আসবে সেখান থেকে। তারপর সারা বিশ্ব একচেটিয়া বাজারজাত করবে এটা।
বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ: ডিম দুটো যেমন ছিল তেমনই থাকবে। বিদেশ থেকে আরও দুটো ডিম উচ্চমূল্যে এবং শর্তসাপেক্ষে কিনে আনবেন আরও অভিজ্ঞতা অর্জনের কথা বলে। এ বাবদ বিশাল টাকার বাজেট করা হবে। বিদেশ থেকে আনা ডিম দুটো নতুন পরিবেশে নষ্ট হতে থাকবে। তাদের ভালো রাখার জন্য এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে একজন দক্ষ পরামর্শক নিয়োগ ও চারজন কেয়ারটেকার আনা হবে। এ বাবদ আরও বিশাল অংকের বাজেট হবে। অন্যদিকে, নিজের ডিম দুটো সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্নের অভাবে নষ্ট হয়ে যাবে একদিন!
ডিম যে মানুষকে কেবল পুষ্টি দেয় তা নয়, আরও উপকার করে। যেমন খারাপ নাটক, খারাপ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি পণ্ড করতে বা নিজেদের আপত্তি জানাতে ডিম ছুড়ে মারা হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিশুদ্ধ ডিম দিয়ে কাজটি হয় না। প্রয়োজন হয় পচা ডিমের। পচা অভিনেতা, পচা শিল্পী, পচা বক্তার জন্য পচা ডিম। দর্শক গ্যালারি থেকে মঞ্চের দিকে ছুড়ে দিতে হয় পচা ডিম। পচা ডিমের কাজ এখানেই শেষ নয়। অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের প্রতিও প্রতিপক্ষ কিংবা বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা ডিম ছুড়ে মারে।
ডিম নিক্ষেপের ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর অভিবাসী মুসলমানদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যকারী অস্ট্রেলিয়ার সিনেটর ফ্রেজার অ্যানিংয়ের মাথায় ডিম ছুড়ে মেরে ইন্টারনেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে ওঠে উইল কনোলি। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ওই সিনেটর মেলবোর্নে যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, সে সময় পেছন দিকে থেকে এসে ওই কিশোর তার মাথায় অতর্কিতে ডিম ফাটায়।
১৭ বছর বয়সী ওই বালকের এমন দুঃসাহসী কাজে আপ্লুত হয়ে প্রশংসার পাশাপাশি তাকে দেওয়া হয়েছিল নানা ধরনের অফার। সারা জীবনের জন্য ফ্রি-টিকিটের অফার করেছিল অস্ট্রেলীয় হিপহপ ব্যান্ড ‘হিলটপ হুডস’। এছাড়া, জনপ্রিয় মেটাল কোর ব্যান্ড অ্যামিটি অ্যাফলিকশন আরও একধাপ এগিয়ে। তারা কনোলিকে তাদের দলের সদস্য করাসহ তাদের শো উপভোগ করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনি একই ধরনের প্রস্তাব পেয়েছিলেন রক ব্যান্ড জেবিদিয়াহ, হুয়েটাসের কাছ থেকেও। আর বিশ্বের নানা প্রান্তের বিভিন্ন ব্যান্ড তাকে ফ্রিতে তাদের শো দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
সে সময় কনোলির পক্ষে আইনি লড়াই ও ডিম কেনার তহবিলে জমা পড়ে বাংলাদেশি টাকায় ৪৯ লাখের বেশি টাকা। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে হামলায় নিহত মুসলিম পরিবারদের দান করার ঘোষণা দিয়েছিলেন এই বিস্ময় বালক। কারও মাথায় ডিম ভেঙে বিশ্বব্যাপী এত খ্যাতি পাওয়া প্রথম ব্যক্তি সম্ভবত উইল কনোলি। তার এই খ্যাতি দেখেই অনুপ্রাণিত হয়ে এক সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা তৎকালীন ডাকসু ভিপি নূরের মাথায় ডিম ছোড়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। কালের পরিক্রমায় ওই ছাত্রলীগের বীর সেনানীরা এখন লা-পাত্তা। আর ডিম-নিক্ষেপের শিকার হওয়া ভিপি নূর এখন বীরবিক্রমে চলাফেরা করছেন। অন্তর্র্বতী সরকারকে নানা ধরনের উপদেশ-পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে এখন যারা ডিম নিক্ষেপের শিকার হচ্ছেন এবং যারা ডিম ছুড়ছেন তাদের সবারই ডিম-ক্যাচ প্র্যাকটিস করা দরকার। প্রয়োজনে জন্টি রোডসের (ক্রিকেটার) সহায়তা নিতে পারেন। কেননা আমাদের দেশের রাজনীতিতে ডিম-নিক্ষেপের খেলা সহজে থামবে বলে মনে হয় না। এখন যারা ডিম ছুড়ছেন, আগামী দিনে তাদের দিকে ডিম ধেয়ে আসবে না, ওই গ্যারান্টি কে দিতে পারে?
আরেকটি কথা, ডিম নিক্ষেপের মতো অপচয়মূলক কাজটি না করাই ভালো। ডিম নিক্ষেপ না করে যদি ওই ডিমটি ভেজে কিংবা সিদ্ধ করে খান, তাহলে অনেক বেশি আনন্দ পাবেন!
পরিশেষে পাঠকদের জন্য একটি পুরনো কৌতুক।
এক কৃপণ গৃহস্থ একবার ক্ষেপে গিয়ে তার সব মুরগিকে বললেন, আগামীকাল থেকে যদি প্রতিদিন ২টা করে ডিম না দিস তাহলে ধরে জবাই করে খেয়ে ফেলব! এরপর থেকে প্রত্যেকটা মুরগিই প্রতিদিন দুইটা করে ডিম দিতে লাগল। শুধু একটা বাদে! ওইটা প্রতিদিন একটা করেই ডিম পাড়তে লাগল। গৃহস্থ ক্ষেপে গিয়ে বললেন, কিরে! তোর তো সাহস কম না! এত বড় হুমকি দিলাম, এরপরও একটা করে ডিম পারতেছিস! মুরগির জবাব: জনাব! আপনার ভয়ে তাও তো বহু কষ্টে একটা করে ডিম পাড়ছি! আমি আসলে যে মোরগ!
লেখক: কলামিস্ট