ঢাকা ১২:২১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ডিমের কুসুম

  • আপডেট সময় : ১০:১৫:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২২
  • ৮৮ বার পড়া হয়েছে

কিযী তাহ্নিন : স্বপ্নটা নতুন। শফিকুলের জীবনের নতুন যা কিছু এসেছে, তা খুব সুখের হয়নি। গেল কয়েক মাসে তিন-চারবার একই স্বপ্ন দেখেছে। প্রথম দুইবার স্বপ্ন দেখেছে, ঘুম থেকে উঠে ভুলে গেছে। কিন্তু আবার যখন ফিরে এলো একই স্বপ্ন, তার কেমন পিনপিনে অস্বস্তি হলো।

শফিকুল স্বপ্নে দেখে যে, সে ছুটছে। গ্রামের সেই মূল রাস্তার পাশের তালগাছটাও এক ঝলক দেখে। কিন্তু তাকে পাশ কাটিয়ে সে ছুটছে। আর কাঁদছে, তার মুখোশ বাড়ি ফেলে এসেছে। এখন কী হবে? মুখোশ কই মুখোশ? সে বাড়ি ফেরার জন্য তালগাছের পাশের ওই রাস্তাটায় ফের ছুটছে। কিন্তু বাড়ি কই? ঠিক এমন সময় প্রতিবার তার ঘুম ভেঙে যায়।
সে বুঝতেই পারে না, মুখোশ কেন খুঁজছে? এই স্বপ্নের মানে কী? তার পুরোনো স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে। দিনের পর দিন, বছর ধরে সেই স্বপ্ন দেখে আসছিল। আপন মনে হতো বেশি, ভয় হতো না জেগে গেলে। স্বপ্নটা তার জগতের ভেতরে ছিল, আয়ত্তে, চেনাজানা। দেখত, তালগাছটা। সেই রাস্তার পাশের তালগাছটাই। দেখত, গাছটা কেমন নীল ফলে ভরে ভরে আছে। ছোটবেলায় ঘুম থেকে উঠে হুটোপুটি করে কাঁদত-
‘আমারে নীলাফল আইনে দাও।’
কত মারও খেয়েছে মায়ের কাছে। জাম, জাম্বুরা, কলা, বেতফল কোনোটাতেই শফিকুলের মন মিটত না। বড় ভাই রফিকুল একবার বুদ্ধি করে, একটা সাদাটে পানসে আপেল লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল মসজিদের জুম্মাবারের মিলাদ থেকে। কাপড়ের নীল মেখে দিয়ে বলেছিল-
‘খা তোর নীল ফল।’
তারপর সেই বেসামাল বমি আর পাতলা পায়খানা, সদরের হাসপাতাল, স্যালাইন, যায় যায় অবস্থা। ভারি ভুগেছিল শফিকুল। তবু স্বপ্ন কিন্তু সে দেখত। বাপ যতদিন বেঁচেছিল, গুনগুন করে বলতচ্
‘আব্বা নীলফল কি বাজারে নাই?’
আব্বা বলত-
‘আল্লাহর দুনিয়ায় এত ফল, সেগুলা খা। কী সব অখাদ্য ফলের কথা বইলা মাথা খাইস না।’
আব্বা বেঁচে থাকা পর্যন্ত তাও বলত স্বপ্নের কথা, গুনগুন করে। সে সময় তো খাওয়া-পরার অভাব ছিল না, কাজ ছিল, অবসর ছিল, ভবিষ্যৎ বলে একটা শব্দের খুব চল ছিল তাদের পরিবারে, আব্বা প্রায়ই বলত- ভবিষ্যৎ ভবিষ্যৎ। আর ভবিষ্যতের টান ধরে স্বপ্ন ও কেমন জড়িয়ে পেঁচিয়ে ছিল। এমনকি সেই নীলফলের অহেতুক স্বপ্নটাও।
কিন্তু শফিকুলের আব্বার মরে যাওয়া এমন বিচ্ছিরি এক কালো দমবন্ধ স্বপ্নের মতন। সব সুখস্বপ্ন নিয়েই যেন আব্বা মরল।
বাজারের মুদির দোকান বন্ধ করে প্রতিদিনের মতন আব্বা জয়নাল চাচার দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। চা খায়, বিড়ি টানে, সন্ধে শেষের এই সময় খুঁজলে আব্বাকে এখানেই পাওয়া যায়। শফিকুলের চাচাও আড্ডায় এসেছিল প্রতিদিনের মতন। অনেকদিন ধরে খুনের চাল বুনতে থাকা চাচার পুরোনো শত্রু আজগর মির্জা লোক পাঠিয়েছিল, চাচাকে মেরে পুঁতে ফেলার জন্য। ভাড়াটে খুনি হয়তো ভুলে গিয়েছিল কিংবা তাকে বলা হয়নি, যে তার আব্বা আর চাচা যমজ। দূর থেকে দেখলে হুবহু এক। টিমটিমে কুপির আলোতে যতটুকু দেখা যায়, ততটুকুর মধ্যে ঠিক নিশানা বুঝে মেরে এসেছিল খুনি। মরেও ছিল, তবে চাচা না আব্বা।
চাচা সেই যে পালিয়েছিল, শফিকুল আর কাছ থেকে দেখেনি তাকে। পাঁচ কাঠা ভাগের জমি, মুদির দোকান কেমন করে সব তার চাচার হয়ে গেল। ঠিক তার আব্বার মতন দেখতে চাচা, অনাত্মীয় হয়ে যেতে লাগল ক্রমশ। আম্মা, রফিকুল আর শফিকুল তিনজন মিলে ক্রমশ একা হয়ে যেতে লাগল।
আব্বার মৃত্যু এমন ঘন আঁধারের মতন এলো, জীবনটাই বদলে গেল, কেমন কুয়াশা, পরেরটুকু অজানা। নিজের ওই বোকা স্বপ্নের কথা শফিকুল আর বলত না, লজ্জা হতো। কিন্তু স্বপ্নটা তাকে ছেড়ে যেত না। ঘুমিয়ে সে দেখত তালগাছ, নীল নীল ডুমো ডুমো ফল।
আর জেগে উঠলে যে জীবন, প্রতিদিন তা কেমন বদলে যেতে লাগল, থেকে গেল শুধু নীলফলের পুরোনো স্বপ্নটা। রফিকুল এক বিকেলে শরীর ব্যথা বলে ঘুমোল। উঠল না। মাদকে জমা শরীর, মাদকেই শেষ হলো। বাজারে কুলিগিরি করে যা কামাত মাদকেই শেষ হতো। ও যে এমন করেই চলে যাবে, আম্মা আর শফিকুল হয়তো জানত, শুধু অপেক্ষা ছিল। তাই চার দিনের শোক শেষে ওরা আবার চাল-ডালের হিসাবে বেরিয়েছিল।
বড্ড থমকে যাওয়া সময় তখন। কোথাও কোনো শব্দ নেই, সুঘ্রাণ নেই, বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর গন্ধ মিলেমিশে কেমন একাকার। মজনু মিয়ার কাছ থেকে শাকসবজি কিনে সারাদিন বাজারের ওই বটগাছের কোনায় বসে বিক্রি করত শফিকুল আর আম্মা। দিন শেষে, টুকরিতে পরে থাকা দামহীন চামড়া কুঁঁচকানো পটোল আর শুকিয়ে যাওয়া লাউশাকের মতনই ক্লান্ত মনে হতো শফিকুল আর আম্মাকে। তারপর, সেই টুকরির শেষ সবজি পাতা আর ভাত ফুটিয়ে সন্ধেতে হাপুসহুপুস খাওয়া। আর রাতটাকে ভোলার জন্য এক ঘুম। শফিকুল আর আম্মার নিজেদের মধ্যে বলবার কিছু ছিল না। ভবিষ্যৎ যেন কোন দূর অতীতের গল্প হয়ে গেল। এ কেমন নিঃশব্দতা! তবু শফিকুল নীলফলের স্বপ্ন দেখত, যে রাতে স্বপ্ন দেখত, তারপরের সকাল কেমন পুরোনো দিনের মতন চেনা মনে হতো। আরামের। ওইটুকুই। তারপর দিন শেষে ওই টুকরিতে শুকিয়ে যাওয়া অপ্রয়োজনীয় সবজি আর ক্লান্ত শফিকুল আর তার আম্মা।
তবে এই ক্লান্ত অস্বস্তিতে মাখা সময় বেশিদিন পার করতে হয়নি। চারপাশে গুনগুন শোনা যেত, আম্মার নাকি বিয়ের বয়স পার হয়নি। আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে শুকনো জলহীন ঠোঁট, আর মেস্তার ছিটা ভরা গাল দেখতে পেত শফিকুল। কিন্তু কে জানে, মজনু মিয়ার ছোট ভাই হান্নান মিয়া হয়তো অন্যকিছু দেখতে পেয়েছিল। ভোরবেলায় যখন মজনু মিয়ার বাড়ির উঠোন থেকে সবজি ভরত টুকরিতে, আগের দিনের হিসাবকিতাব মিটাত, হান্নান মিয়া উঠোনে ঘুরে ঘুরে গুনগুন করত-
‘তুমি মুর জীবনের ভাবুনা …’
আম্মাও কেমন গাছের ডালে আটকে থাকা শুঁয়োপোকার মতন ছটফট করত। কে জানে শফিকুল ভাবত শুঁয়োপোকা, হান্নান মিয়া হয়তো দেখত রঙিন প্রজাপতি। আম্মা কেমন ঘনঘন চোখের পাপড়ি ফেলত ফড়িঙের মতন, যেন তার নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। কই আব্বার সাথে তো কখনও এমন ফড়িং খেলা দেখেনি শফিকুল। এমন সময় বড্ড অচেনা শফিকুলের জন্য, আম্মাকেও কেমন নতুন লাগে।
নতুন সময় এলো, শব্দহীন সময় তখন নিভু নিভু করছে। আম্মা গাছের ডালে আটকে থাকা সময় থেকে ছুটে পেয়ে উড়ছে, কেমন উড়ছে। অনেক কথা বলছে। গল্পে গল্পে ভবিষ্যৎ ফিরে এসেছে। চারপাশে এখন শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ। অপেক্ষা। মামারা আম্মার বিয়ের আয়োজন শুরু করল। হান্নান মিয়া বিপতœীক, নিঃসন্তান। অতীতের মেদ ঝেড়ে ফেলে নতুন করে সংসার সাজাতে চায়। শফিকুল ঠিক বুঝছিল সে কেমন অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে চারপাশ জুড়ে। আম্মা খালি টান খায়, একবার ওখানে, একবার শফিকুলের কাছে। ছাড়া পেয়েও পতপত করে ডানা ঝাপটায় আম্মা। একদিকে সুখ আর অন্য পাশে অস্বস্তি, কেমন ক্লান্ত করে দিচ্ছিল তাকে, আহারে আম্মা।
আম্মা মাথায় বিলি কেটে দেয়-
‘শফিরে তোর মামায় যে কাম ঠিক করসে শহরে, ওরা নাকি ভালো মানুষ। অনেক ট্যাকা।’
শফিকুল বলে-
‘আইচ্ছা।’
‘আমারে দেখতে আইবি?’
শফিকুল বলে-
‘আইচ্ছা।’
আম্মার বিয়ের আগের দিন শফিকুল গ্রাম ছাড়ে। খারাপ লাগে না তার। খারাপ লাগা, এই ব্যাপারটা আর আলাদা করে কেমন হয়, কে জানে? তালগাছের পাশ দিয়ে যায় যখন, প্রতিবারের মতন তাকায়। নীল ফল নাই। তাল ধরে না এ গাছে। আব্বা বলছিল- ‘ব্যাটা গাছ, ফল ধরে না।’
বাবুই পাখি গাছজুড়ে ঝাপটি মারে, ঘুরে ঘুরে। শফিকুল মনে মনে বলে-
‘যাইগা, যাইগা।’
আর ফিরেনি গ্রামে, আম্মাকে দেখতেও না। টানে না গ্রাম। আর তালগাছ তো সে স্বপ্নেই দেখে। আম্মা প্রতি বছর ঢাকায় আসে, দেখা করে যায়। বাতাসা, পিঠা, মোয়া, বাগানের পেয়ারা দিয়ে যায়। সে আম্মাকে দেয় পাঁচশ টাকা।
আম্মা কেঁপে কেঁপে ওঠে-
‘বাপ, তোর একটা ছোট ভাই হইসে, নাম রাখসি নুরুল। দেখতে আসিস।’
সে বলে-
‘আইচ্ছা।’
আম্মা কাঁদে,
‘যাইগা বাপ।’
সে বলে-
‘আইচ্ছা।’
এই যে গ্রাম ছেড়ে শহরে, উটের মতন কুঁজো এক সাদা প্রকা- বাড়ি, যেখানে সে এখন থাকে, সেও তো স্বপ্নের মতনই। কিংবা স্বপ্নের মতন নয়, তার চেয়ে অস্পষ্ট। সে কী স্বপ্নে এমন বাড়ি দেখতে পেত? যে বাড়ির জানালায় আকাশের মতন স্বচ্ছ ঝিরঝিরে পর্দা দোলে।
শফিকুল তো স্বপ্নেও কোনোদিন এমন পর্দা দেখেনি। পর্দার প্রয়োজন তার পড়েনি। সে ভাবত তার সব আছে। উটের মতন উঁচু সাদা বাড়িতে এসে জানল, কত কিছু নেই তার জীবনে, হয়তো কিছুই নেই।
আর এ ভরা বাড়ি কেমন প্রাণশূন্য। এক বুড়ি থাকে, সাদা চুল, কুঁচকে যাওয়া চামড়া, আভিজাত্য আর একাকিত্ব নিয়ে তার বাস। ছেলেমেয়েরা আসে। আবার চলে যায়। যেদিন আসে সেদিন থেকেই তাদের চলে যাওয়ার তাড়া। যখন আসে তারা পর্দার রং নিয়ে কথা বলে, বাড়ির কোণ নিয়ে কথা বলে, বিরিয়ানির আলু, রাজনীতি, সিনেমা, জমির দাগ আর কার কত ভাগ সে নিয়ে আলোচনা চলে। তারপর তারা চলে যায়। থেকে যায় বুড়ি, আর শফিকুলের মতন কয়েকজন।
তারা কেউ সাদা বাড়ি ঝেড়ে মুছে সাফ করে, কেউ বাগানে ফুল ফোটায়, কেউ বুড়ির সাদা জাউ ভাত, আর মুরগির রং ছাড়া আলুনি ঝোল রেঁধে দেয়। আর কেউ সপ্তাহ শেষে গাড়ি করে ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়। শফিকুল টুকটাক কাজে সাহায্য করে, বাগানে, রান্নাঘরে। আর সাদা বাড়ির বাইরের গরিবি চেহারার ঝুরঝুরে দুটো ইটের ঘরের একটিতে থাকে সে।
শফিকুল বোঝে না এমন সুন্দর মুক্তা রঙের বাড়ির বাইরে এমন ঝুরঝুরে ঘর কেন? বাড়ির সব মশা এখানেই বাস করে। ঘাম, তাপ, গন্ধ- সব অসুন্দরের এখানেই শুরু, এখানেই শেষ। আর ওই মুক্তার মতন বাড়ির ভেতর সুগন্ধে ভরা। তার পাশে ঝুরঝুরে ওই বেখাপ্পা দুটো ঘর দেখলে মনে হয়, যেন সুন্দর সাজানো মুখে দগদগে এক পুঁজওয়ালা ফোড়া। দেখলেই মনে হয় কেটে ফেলি, বাদ দিয়ে দেই।

শফিকুল জিজ্ঞেস করেছিল বাড়ির ড্রাইভারকে। একই ঘরে থাকে তারা। এ বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো কর্মচারী।
‘রাসেল ভাই, এমুন হালত কেন আমাগো ঘরের?’
‘যাতে তুই নিজেরে জমিদার না ভাবস।’
একমুহূর্ত চিন্তা না করেই উত্তর দিয়েছিল ড্রাইভার রাসেল ভাই। যেন এ প্রশ্ন সে জানে, উত্তরও।
তবে এমন দগদগে ফোড়ার মতন কুৎসিত ঘরে শুয়েও শফিকুল নীলফলের স্বপ্ন দেখে, তালগাছের স্বপ্ন দেখে। দেখত। কিন্তু গত ক’দিন কী এক মুখোশের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। স্বপ্ন ভাঙলে বুক ধকধক করে। নীলফলের স্বপ্নটার আশপাশ চেনা। নিজের মনে হতো। এই মুখোশের স্বপ্নটা খুব নতুন। এই সাদা বাড়িটার মতন। এই যে গেল আড়াই বছর ধরে আছে, তবু নতুনই লাগে। প্রতিদিন।
এই যে বাড়ির মালিক বুড়ি, তার সাথে গেল ক’বছরে হাতে গুনে কথা হয়েছে। সে বাড়ির বাইরের কাজ করে, বুড়ির সাথে কথা বলার প্রয়োজনও হয় না। কিন্তু বুড়ি যেদিন বাথরুমে পা পিছলে পরে গেল, সেদিন শফিকুলের ডাক পড়ল বাড়ির ভেতরে। এ যেন লুকিয়ে থাকা এক ছোটখাটো প্রাসাদ। যে বাথরুমে বুড়ি পড়ে আছে, তাদের গ্রামের পুরো বাড়িটাও কি এত বড় হবে? সবাই ধরাধরি করে বুড়িকে উঠিয়ে শুইয়ে দিলাম। সেই থেকে বুড়ির অসুখের দিন শুরু হলো। আর শফিকুলের কাজ বাড়ির বাইরে থেকে ভেতরে বাড়তে লাগল ক্রমশ।
বাড়ির সবাই যখন দিনে কাজ করে, শফিকুল বুড়ির পায়ের কাছে বসে থাকে আজকাল। এটা-ওটা লাগলে এগিয়ে দেয়। বিকালে ডাক্তারের ওখান থেকে মালিশ করার লোক আসে যন্ত্রপাতি নিয়ে, কীসব ব্যায়াম করায়, তাদের সাহায্য করে। বুড়ির এক অসুখ আরও অনেক অসুখ ডেকে আনে। শফিকুল এতদিন জানত, মানুষ দুম করে মরে যায়, তার বাপের মতন। কিংবা বেদম কাশতে কাশতে ভাতের থালার ওপর, কোনো এক সাধারণ দুপুরে, তার দাদির মতন। এমন অসুখের জীবন যে হয়, এ বুড়িকে না দেখলে সে বুঝত না।
বুড়ির হাড্ডি ভাঙা, ঝুরঝুর করছে, শফিকুলদের ওই থাকার ঘরগুলোর মতন। আর এদিকে রক্তে নাকি এটা বেশি, ওটা কম। ডাক্তার বলেছে, দুইটা ডিম খেতে হবে প্রতিদিন, কুসুম বাদে, শুধু সাদা। দুটো ডিম সেদ্ধ করে, সাদা অংশ আলাদা করে বুড়ি খায়। কুসুম দুটো ফেলে দেয়। কী জীবন বুড়ির, ডিমটুকুও পুরো খেতে পারে না।
প্রতি বুধবারে শফিকুলদের জন্য ডিমের তরকারি রান্না হয়। টলটলে হলুদ পানির ঝোলে একগাদা পেঁয়াজের মধ্যে ডিম ভাসে। রান্নার লোকটা বড় অযতেœ রান্না করে তাদের খাওয়ায়। তবু ডিমের দিনে কেমন হাপুসহুপুস শব্দ শোনা যায় চারপাশ থেকে। মেঝেতে মাদুর পেতে কাজের লোকেরা একসাথে খায়। রাসেল ভাই প্রতিবার বলে-
‘জমিলা ভুনা ভুনা করে ডিম রাঁধবা।’
জমিলা প্রতিবার মাথা নাড়ে, আর বুধবারে ঠিক সেই হলদে টলটলে ডিমের ঝোল রেঁধে দেয়।
শফিকুলের অবশ্য টলটলে ডিমের ঝোল খারাপ লাগে না। এই যে বুড়ি ডিমের কুসুমগুলো প্রতিদিন ফেলে দেয় ময়লার ঝুড়িতে, তাও খারাপ লাগে না। বরং মায়া লাগে, বুড়ির এত আছে, তবু কুসুমের স্বাদ সে পায় না। শফিকুল তো প্রতি বুধবার আস্ত ডিম খায়, কুসুমসহ।
সেদিন ডাক্তারের লোক ব্যায়াম করাচ্ছিল বুড়ির পা দুটো টেনে টেনে। বুড়ি আধা বসা হয়ে আছে, হাতে ধরা বাটিতে দুটো সেদ্ধ ডিম। কুসুম ফেলতে যেয়ে দেখে, পাশে থাকা বেতের ময়লার ঝুড়ি নেই, কে যেন নিয়ে গেছে পরিস্কার করতে।
বুড়ি বলে-
‘কুসুম দুটো খেয়ে ফেল।’
বুড়িকে ভয় লাগে। শফিকুল তাই বাড়িয়ে কুসুম দুটো নিয়ে টপটপ করে রসগোল্লার মতন মুখে পুরে দেয়, শুকনো কুসুম দুটো গলার কাছে দলা পাকিয়ে কেমন আটকে থাকে। শুধু কুসুম, কী বিচ্ছিরি! মুখটা কুসুমের গন্ধে ভরে আছে। কুসুমের গন্ধওয়ালা ঢেকুর ওঠে। এর পর থেকে প্রতিদিন বুড়ি কুসুম দুটো শফিকুলকে দেয়। শফিকুল বুড়ির ভয়ে গিলে গিলে ফেলে। সেদিন কুসুম হাতে দিয়ে, বুড়ি পাশ ফিরে শুলো। শফিকুল একটা টিস্যু নিয়ে তাতে মুড়ে, আলতো করে শার্টের বুকপকেটে রেখে দিল। ফেলে দেওয়া যাবে পরে।
দুপুরের পর ঝিরঝির বাতাস কেমন ‘আয় বৃষ্টি আয় বৃষ্টি’ গান গায়। শফিকুলের এমন বৃষ্টি আসার আগে মুহূর্তে মরে যাওয়া ভাই রফিকুলের কথা মনে পড়ে। বৃষ্টি আসি আসি করলে, তারা তালগাছের ধার হয়ে গোল গোল করে এলোনা বেলোনা কলাপাতা ঝুম খেলত। তালগাছের বাবুই পাখিগুলোকে ঢিল মারত। সেই ঢিল ওই উঁচুতে পৌঁছত না জেনেই মারত, অহেতুক। আর বৃষ্টি এলে রফিকুল বলত-
‘চল প্যাকে গড়ান দেই।’
মাটিতে হুটোপুটি করে জলে কাদায় ভাসত।
এমন বৃষ্টি আসার আগের মুহূর্ত শফিকুলের চোখে বেশি পড়ে না আজকাল। সারাদিন তার নানা কাজ। যখন সে এমন মুহূর্ত খুঁজে পায়, রফিকুলের কথা মনে পড়ে। এই যেমন আজ। ঝিরঝির বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব, শফিকুল বাগানের কোনায় যেয়ে বসে। কেমন মেপে মেপে ফুল জন্মায় এ বাগানে, যেন কেউ এক সরু বেত দিয়ে সমান করে রাখে গাছগুলোকে। ওই যে স্কুলে যখন যেত, সেই কবে, পিটি স্যার বলত-
‘সোজা হও, আরামে দাঁড়াও।’
তেমন গাছগুলো সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে। আরাম করার সময় নেই। এমন ভাবতে ভাবতে, ঘাসে গা এলিয়ে দেয়, বুকপকেটে নরম নরম কী যেন হাতে লাগে। আধা ভাঙা সেই ডিমের কুসুম বের করে পকেট থেকে। ফেলে দিতে মায়া লাগে। আর এমন দুপুর শেষে তার একটু খিদেও পায়। রাতের আগে তো কোনো খাবার নেই আর। আচারের মতন একটু একটু করে ভেঙে ভেঙে ডিমের কুসুম মুখে পুরে। আহা এত মজা তো কখনও পায়নি সে। বুড়ির সামনে খেলে কেমন গলায় আটকে যায়, যেন শুকনো পাথর। এমন বৃষ্টিতে টপটপ ভিজতে ভিজতে ডিমের কুসুম চিবানো, পৃথিবীতে এমন সুখ সে আগে পায়নি। যদি শফিকুল কখনও একদিন প্রেমে পড়ে তো সে বুঝবে এ ভেজা সুখ প্রথম প্রেমের মতন, তার চেয়ে কম নয়।
শফিকুল এখনও সেই মুখোশের অর্থহীন স্বপ্ন দেখে, এখনও সে ঝুরঝুরে নুইয়ে পড়া ঘরে রাত কাটায়। বুড়িকে পাহারা দেয়। তবে তাতে তার সেই পাথরচাপা বোধ আর হয় না। মায়ের জন্য, আব্বা আর রফিকুলের জন্য মন খারাপের আলাদা সময় হয় না। ওই যে দুপুর শেষে ডিমের কুসুম, আহা! প্রতি বুধবার হাপুসহুপুস করে ওই পানসে ডিমের ঝোল খায় সবাই। শফিকুলের বড্ড মায়া হয় সবার জন্য, ফুর্তিও হয়। ওরা তো আর দুপুর শেষে আস্ত কুসুম মুখে পুরে দেওয়ার সুখ জানে না। ওরা জানে না ডিমের কুসুমের আলাদা স্বাদ আছে, ঘ্রাণ আছে, গলে যাওয়া এক রং আছে।
আজকাল বুড়ি ডিমের কুসুম হাতে দিলে, রান্নাঘর থেকে পাওয়া একটা পুরোনো ছোট্ট জর্দার কৌটায় টুক করে দুটো কুসুম ভরে পকেটে রাখে শফিকুল। দুপুর শেষে বাগানে বসে কুসুম খায় অল্প অল্প করে, যত সময় নিয়ে খাওয়া যায়। সে জানে, সে বাঁচে এমন দুপুর শেষে, ডিমের কুসুমে, আর বাকি দিনরাত শুধু অপেক্ষা।
এমন করেই চলছিল, কী ভালো চলছিল। আর এদিকে বুড়ি দিনদিন অসুখে পড়ে, আরও অসুখ, যেন তালগাছের মতন লম্বা হয়ে তিরতির বাড়ছে। খাওয়া নাই, ঘুম নাই। ডিম দিলে নষ্ট করে বেশিরভাগ দিন, আধাখেঁচড়া করে খায়। আর কুসুমটুকু উঠিয়ে নেয় শফিকুল।
বুড়ির ছেলেমেয়েরা বাড়ি আসে। রাসেল ভাই খবর দেয়-
‘বুড়ি মরলেই বাড়ি ভাঙব পোলামাইয়ারা। সেই ধান্ধায়ই তো আইসে। ৫ তলা দালান তুলবে।’
সে ফিসফাস শফিকুলও শুনতে পায়। চারপাশে গুনগুন বুড়ি মরে যাবে। সেই দিন আসে, যেদিন বুড়ি মরে যাবে। মরে যায়ও। ছেলেমেয়েরা ফিসফিস করে ঝগড়া করে। নতুন দালানের নকশা করে। আর কাঁদে অনেক জোরে জোরে।
শফিকুল কাঁদে। বহুদিন পরে কাঁদে। বুক ধুকধুক করে কান্না আসে। সেই মুখোশের স্বপ্ন দেখার পর যেমন বুক ধুকধুক করে, অমন। সবাই বলে-
‘আহারে বুড়িটা শফিকুলকে অনেক মায়া করত। এতিম ছেলেটা।’
শফিকুল কাঁদে, অনেক কাঁদে। অনেক কষ্ট হয় যে তার। শফিকুল অনেক অনেক দিন পর হয়তো জানবে যে প্রথম প্রেম হারিয়ে গেলে এমন কষ্ট হয়। শফিকুলের লজ্জা হয়, তবু সে কাঁদে। শফিকুলের ইচ্ছে হয়, আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করতে-
‘ডিমের কুসুম, আহারে আমার ডিমের কুসুম।’

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আয়নাঘরের পরতে পরতে নির্যাতনের চিহ্ন

ডিমের কুসুম

আপডেট সময় : ১০:১৫:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২২

কিযী তাহ্নিন : স্বপ্নটা নতুন। শফিকুলের জীবনের নতুন যা কিছু এসেছে, তা খুব সুখের হয়নি। গেল কয়েক মাসে তিন-চারবার একই স্বপ্ন দেখেছে। প্রথম দুইবার স্বপ্ন দেখেছে, ঘুম থেকে উঠে ভুলে গেছে। কিন্তু আবার যখন ফিরে এলো একই স্বপ্ন, তার কেমন পিনপিনে অস্বস্তি হলো।

শফিকুল স্বপ্নে দেখে যে, সে ছুটছে। গ্রামের সেই মূল রাস্তার পাশের তালগাছটাও এক ঝলক দেখে। কিন্তু তাকে পাশ কাটিয়ে সে ছুটছে। আর কাঁদছে, তার মুখোশ বাড়ি ফেলে এসেছে। এখন কী হবে? মুখোশ কই মুখোশ? সে বাড়ি ফেরার জন্য তালগাছের পাশের ওই রাস্তাটায় ফের ছুটছে। কিন্তু বাড়ি কই? ঠিক এমন সময় প্রতিবার তার ঘুম ভেঙে যায়।
সে বুঝতেই পারে না, মুখোশ কেন খুঁজছে? এই স্বপ্নের মানে কী? তার পুরোনো স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে। দিনের পর দিন, বছর ধরে সেই স্বপ্ন দেখে আসছিল। আপন মনে হতো বেশি, ভয় হতো না জেগে গেলে। স্বপ্নটা তার জগতের ভেতরে ছিল, আয়ত্তে, চেনাজানা। দেখত, তালগাছটা। সেই রাস্তার পাশের তালগাছটাই। দেখত, গাছটা কেমন নীল ফলে ভরে ভরে আছে। ছোটবেলায় ঘুম থেকে উঠে হুটোপুটি করে কাঁদত-
‘আমারে নীলাফল আইনে দাও।’
কত মারও খেয়েছে মায়ের কাছে। জাম, জাম্বুরা, কলা, বেতফল কোনোটাতেই শফিকুলের মন মিটত না। বড় ভাই রফিকুল একবার বুদ্ধি করে, একটা সাদাটে পানসে আপেল লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল মসজিদের জুম্মাবারের মিলাদ থেকে। কাপড়ের নীল মেখে দিয়ে বলেছিল-
‘খা তোর নীল ফল।’
তারপর সেই বেসামাল বমি আর পাতলা পায়খানা, সদরের হাসপাতাল, স্যালাইন, যায় যায় অবস্থা। ভারি ভুগেছিল শফিকুল। তবু স্বপ্ন কিন্তু সে দেখত। বাপ যতদিন বেঁচেছিল, গুনগুন করে বলতচ্
‘আব্বা নীলফল কি বাজারে নাই?’
আব্বা বলত-
‘আল্লাহর দুনিয়ায় এত ফল, সেগুলা খা। কী সব অখাদ্য ফলের কথা বইলা মাথা খাইস না।’
আব্বা বেঁচে থাকা পর্যন্ত তাও বলত স্বপ্নের কথা, গুনগুন করে। সে সময় তো খাওয়া-পরার অভাব ছিল না, কাজ ছিল, অবসর ছিল, ভবিষ্যৎ বলে একটা শব্দের খুব চল ছিল তাদের পরিবারে, আব্বা প্রায়ই বলত- ভবিষ্যৎ ভবিষ্যৎ। আর ভবিষ্যতের টান ধরে স্বপ্ন ও কেমন জড়িয়ে পেঁচিয়ে ছিল। এমনকি সেই নীলফলের অহেতুক স্বপ্নটাও।
কিন্তু শফিকুলের আব্বার মরে যাওয়া এমন বিচ্ছিরি এক কালো দমবন্ধ স্বপ্নের মতন। সব সুখস্বপ্ন নিয়েই যেন আব্বা মরল।
বাজারের মুদির দোকান বন্ধ করে প্রতিদিনের মতন আব্বা জয়নাল চাচার দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। চা খায়, বিড়ি টানে, সন্ধে শেষের এই সময় খুঁজলে আব্বাকে এখানেই পাওয়া যায়। শফিকুলের চাচাও আড্ডায় এসেছিল প্রতিদিনের মতন। অনেকদিন ধরে খুনের চাল বুনতে থাকা চাচার পুরোনো শত্রু আজগর মির্জা লোক পাঠিয়েছিল, চাচাকে মেরে পুঁতে ফেলার জন্য। ভাড়াটে খুনি হয়তো ভুলে গিয়েছিল কিংবা তাকে বলা হয়নি, যে তার আব্বা আর চাচা যমজ। দূর থেকে দেখলে হুবহু এক। টিমটিমে কুপির আলোতে যতটুকু দেখা যায়, ততটুকুর মধ্যে ঠিক নিশানা বুঝে মেরে এসেছিল খুনি। মরেও ছিল, তবে চাচা না আব্বা।
চাচা সেই যে পালিয়েছিল, শফিকুল আর কাছ থেকে দেখেনি তাকে। পাঁচ কাঠা ভাগের জমি, মুদির দোকান কেমন করে সব তার চাচার হয়ে গেল। ঠিক তার আব্বার মতন দেখতে চাচা, অনাত্মীয় হয়ে যেতে লাগল ক্রমশ। আম্মা, রফিকুল আর শফিকুল তিনজন মিলে ক্রমশ একা হয়ে যেতে লাগল।
আব্বার মৃত্যু এমন ঘন আঁধারের মতন এলো, জীবনটাই বদলে গেল, কেমন কুয়াশা, পরেরটুকু অজানা। নিজের ওই বোকা স্বপ্নের কথা শফিকুল আর বলত না, লজ্জা হতো। কিন্তু স্বপ্নটা তাকে ছেড়ে যেত না। ঘুমিয়ে সে দেখত তালগাছ, নীল নীল ডুমো ডুমো ফল।
আর জেগে উঠলে যে জীবন, প্রতিদিন তা কেমন বদলে যেতে লাগল, থেকে গেল শুধু নীলফলের পুরোনো স্বপ্নটা। রফিকুল এক বিকেলে শরীর ব্যথা বলে ঘুমোল। উঠল না। মাদকে জমা শরীর, মাদকেই শেষ হলো। বাজারে কুলিগিরি করে যা কামাত মাদকেই শেষ হতো। ও যে এমন করেই চলে যাবে, আম্মা আর শফিকুল হয়তো জানত, শুধু অপেক্ষা ছিল। তাই চার দিনের শোক শেষে ওরা আবার চাল-ডালের হিসাবে বেরিয়েছিল।
বড্ড থমকে যাওয়া সময় তখন। কোথাও কোনো শব্দ নেই, সুঘ্রাণ নেই, বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর গন্ধ মিলেমিশে কেমন একাকার। মজনু মিয়ার কাছ থেকে শাকসবজি কিনে সারাদিন বাজারের ওই বটগাছের কোনায় বসে বিক্রি করত শফিকুল আর আম্মা। দিন শেষে, টুকরিতে পরে থাকা দামহীন চামড়া কুঁঁচকানো পটোল আর শুকিয়ে যাওয়া লাউশাকের মতনই ক্লান্ত মনে হতো শফিকুল আর আম্মাকে। তারপর, সেই টুকরির শেষ সবজি পাতা আর ভাত ফুটিয়ে সন্ধেতে হাপুসহুপুস খাওয়া। আর রাতটাকে ভোলার জন্য এক ঘুম। শফিকুল আর আম্মার নিজেদের মধ্যে বলবার কিছু ছিল না। ভবিষ্যৎ যেন কোন দূর অতীতের গল্প হয়ে গেল। এ কেমন নিঃশব্দতা! তবু শফিকুল নীলফলের স্বপ্ন দেখত, যে রাতে স্বপ্ন দেখত, তারপরের সকাল কেমন পুরোনো দিনের মতন চেনা মনে হতো। আরামের। ওইটুকুই। তারপর দিন শেষে ওই টুকরিতে শুকিয়ে যাওয়া অপ্রয়োজনীয় সবজি আর ক্লান্ত শফিকুল আর তার আম্মা।
তবে এই ক্লান্ত অস্বস্তিতে মাখা সময় বেশিদিন পার করতে হয়নি। চারপাশে গুনগুন শোনা যেত, আম্মার নাকি বিয়ের বয়স পার হয়নি। আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে শুকনো জলহীন ঠোঁট, আর মেস্তার ছিটা ভরা গাল দেখতে পেত শফিকুল। কিন্তু কে জানে, মজনু মিয়ার ছোট ভাই হান্নান মিয়া হয়তো অন্যকিছু দেখতে পেয়েছিল। ভোরবেলায় যখন মজনু মিয়ার বাড়ির উঠোন থেকে সবজি ভরত টুকরিতে, আগের দিনের হিসাবকিতাব মিটাত, হান্নান মিয়া উঠোনে ঘুরে ঘুরে গুনগুন করত-
‘তুমি মুর জীবনের ভাবুনা …’
আম্মাও কেমন গাছের ডালে আটকে থাকা শুঁয়োপোকার মতন ছটফট করত। কে জানে শফিকুল ভাবত শুঁয়োপোকা, হান্নান মিয়া হয়তো দেখত রঙিন প্রজাপতি। আম্মা কেমন ঘনঘন চোখের পাপড়ি ফেলত ফড়িঙের মতন, যেন তার নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। কই আব্বার সাথে তো কখনও এমন ফড়িং খেলা দেখেনি শফিকুল। এমন সময় বড্ড অচেনা শফিকুলের জন্য, আম্মাকেও কেমন নতুন লাগে।
নতুন সময় এলো, শব্দহীন সময় তখন নিভু নিভু করছে। আম্মা গাছের ডালে আটকে থাকা সময় থেকে ছুটে পেয়ে উড়ছে, কেমন উড়ছে। অনেক কথা বলছে। গল্পে গল্পে ভবিষ্যৎ ফিরে এসেছে। চারপাশে এখন শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ। অপেক্ষা। মামারা আম্মার বিয়ের আয়োজন শুরু করল। হান্নান মিয়া বিপতœীক, নিঃসন্তান। অতীতের মেদ ঝেড়ে ফেলে নতুন করে সংসার সাজাতে চায়। শফিকুল ঠিক বুঝছিল সে কেমন অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে চারপাশ জুড়ে। আম্মা খালি টান খায়, একবার ওখানে, একবার শফিকুলের কাছে। ছাড়া পেয়েও পতপত করে ডানা ঝাপটায় আম্মা। একদিকে সুখ আর অন্য পাশে অস্বস্তি, কেমন ক্লান্ত করে দিচ্ছিল তাকে, আহারে আম্মা।
আম্মা মাথায় বিলি কেটে দেয়-
‘শফিরে তোর মামায় যে কাম ঠিক করসে শহরে, ওরা নাকি ভালো মানুষ। অনেক ট্যাকা।’
শফিকুল বলে-
‘আইচ্ছা।’
‘আমারে দেখতে আইবি?’
শফিকুল বলে-
‘আইচ্ছা।’
আম্মার বিয়ের আগের দিন শফিকুল গ্রাম ছাড়ে। খারাপ লাগে না তার। খারাপ লাগা, এই ব্যাপারটা আর আলাদা করে কেমন হয়, কে জানে? তালগাছের পাশ দিয়ে যায় যখন, প্রতিবারের মতন তাকায়। নীল ফল নাই। তাল ধরে না এ গাছে। আব্বা বলছিল- ‘ব্যাটা গাছ, ফল ধরে না।’
বাবুই পাখি গাছজুড়ে ঝাপটি মারে, ঘুরে ঘুরে। শফিকুল মনে মনে বলে-
‘যাইগা, যাইগা।’
আর ফিরেনি গ্রামে, আম্মাকে দেখতেও না। টানে না গ্রাম। আর তালগাছ তো সে স্বপ্নেই দেখে। আম্মা প্রতি বছর ঢাকায় আসে, দেখা করে যায়। বাতাসা, পিঠা, মোয়া, বাগানের পেয়ারা দিয়ে যায়। সে আম্মাকে দেয় পাঁচশ টাকা।
আম্মা কেঁপে কেঁপে ওঠে-
‘বাপ, তোর একটা ছোট ভাই হইসে, নাম রাখসি নুরুল। দেখতে আসিস।’
সে বলে-
‘আইচ্ছা।’
আম্মা কাঁদে,
‘যাইগা বাপ।’
সে বলে-
‘আইচ্ছা।’
এই যে গ্রাম ছেড়ে শহরে, উটের মতন কুঁজো এক সাদা প্রকা- বাড়ি, যেখানে সে এখন থাকে, সেও তো স্বপ্নের মতনই। কিংবা স্বপ্নের মতন নয়, তার চেয়ে অস্পষ্ট। সে কী স্বপ্নে এমন বাড়ি দেখতে পেত? যে বাড়ির জানালায় আকাশের মতন স্বচ্ছ ঝিরঝিরে পর্দা দোলে।
শফিকুল তো স্বপ্নেও কোনোদিন এমন পর্দা দেখেনি। পর্দার প্রয়োজন তার পড়েনি। সে ভাবত তার সব আছে। উটের মতন উঁচু সাদা বাড়িতে এসে জানল, কত কিছু নেই তার জীবনে, হয়তো কিছুই নেই।
আর এ ভরা বাড়ি কেমন প্রাণশূন্য। এক বুড়ি থাকে, সাদা চুল, কুঁচকে যাওয়া চামড়া, আভিজাত্য আর একাকিত্ব নিয়ে তার বাস। ছেলেমেয়েরা আসে। আবার চলে যায়। যেদিন আসে সেদিন থেকেই তাদের চলে যাওয়ার তাড়া। যখন আসে তারা পর্দার রং নিয়ে কথা বলে, বাড়ির কোণ নিয়ে কথা বলে, বিরিয়ানির আলু, রাজনীতি, সিনেমা, জমির দাগ আর কার কত ভাগ সে নিয়ে আলোচনা চলে। তারপর তারা চলে যায়। থেকে যায় বুড়ি, আর শফিকুলের মতন কয়েকজন।
তারা কেউ সাদা বাড়ি ঝেড়ে মুছে সাফ করে, কেউ বাগানে ফুল ফোটায়, কেউ বুড়ির সাদা জাউ ভাত, আর মুরগির রং ছাড়া আলুনি ঝোল রেঁধে দেয়। আর কেউ সপ্তাহ শেষে গাড়ি করে ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়। শফিকুল টুকটাক কাজে সাহায্য করে, বাগানে, রান্নাঘরে। আর সাদা বাড়ির বাইরের গরিবি চেহারার ঝুরঝুরে দুটো ইটের ঘরের একটিতে থাকে সে।
শফিকুল বোঝে না এমন সুন্দর মুক্তা রঙের বাড়ির বাইরে এমন ঝুরঝুরে ঘর কেন? বাড়ির সব মশা এখানেই বাস করে। ঘাম, তাপ, গন্ধ- সব অসুন্দরের এখানেই শুরু, এখানেই শেষ। আর ওই মুক্তার মতন বাড়ির ভেতর সুগন্ধে ভরা। তার পাশে ঝুরঝুরে ওই বেখাপ্পা দুটো ঘর দেখলে মনে হয়, যেন সুন্দর সাজানো মুখে দগদগে এক পুঁজওয়ালা ফোড়া। দেখলেই মনে হয় কেটে ফেলি, বাদ দিয়ে দেই।

শফিকুল জিজ্ঞেস করেছিল বাড়ির ড্রাইভারকে। একই ঘরে থাকে তারা। এ বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো কর্মচারী।
‘রাসেল ভাই, এমুন হালত কেন আমাগো ঘরের?’
‘যাতে তুই নিজেরে জমিদার না ভাবস।’
একমুহূর্ত চিন্তা না করেই উত্তর দিয়েছিল ড্রাইভার রাসেল ভাই। যেন এ প্রশ্ন সে জানে, উত্তরও।
তবে এমন দগদগে ফোড়ার মতন কুৎসিত ঘরে শুয়েও শফিকুল নীলফলের স্বপ্ন দেখে, তালগাছের স্বপ্ন দেখে। দেখত। কিন্তু গত ক’দিন কী এক মুখোশের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। স্বপ্ন ভাঙলে বুক ধকধক করে। নীলফলের স্বপ্নটার আশপাশ চেনা। নিজের মনে হতো। এই মুখোশের স্বপ্নটা খুব নতুন। এই সাদা বাড়িটার মতন। এই যে গেল আড়াই বছর ধরে আছে, তবু নতুনই লাগে। প্রতিদিন।
এই যে বাড়ির মালিক বুড়ি, তার সাথে গেল ক’বছরে হাতে গুনে কথা হয়েছে। সে বাড়ির বাইরের কাজ করে, বুড়ির সাথে কথা বলার প্রয়োজনও হয় না। কিন্তু বুড়ি যেদিন বাথরুমে পা পিছলে পরে গেল, সেদিন শফিকুলের ডাক পড়ল বাড়ির ভেতরে। এ যেন লুকিয়ে থাকা এক ছোটখাটো প্রাসাদ। যে বাথরুমে বুড়ি পড়ে আছে, তাদের গ্রামের পুরো বাড়িটাও কি এত বড় হবে? সবাই ধরাধরি করে বুড়িকে উঠিয়ে শুইয়ে দিলাম। সেই থেকে বুড়ির অসুখের দিন শুরু হলো। আর শফিকুলের কাজ বাড়ির বাইরে থেকে ভেতরে বাড়তে লাগল ক্রমশ।
বাড়ির সবাই যখন দিনে কাজ করে, শফিকুল বুড়ির পায়ের কাছে বসে থাকে আজকাল। এটা-ওটা লাগলে এগিয়ে দেয়। বিকালে ডাক্তারের ওখান থেকে মালিশ করার লোক আসে যন্ত্রপাতি নিয়ে, কীসব ব্যায়াম করায়, তাদের সাহায্য করে। বুড়ির এক অসুখ আরও অনেক অসুখ ডেকে আনে। শফিকুল এতদিন জানত, মানুষ দুম করে মরে যায়, তার বাপের মতন। কিংবা বেদম কাশতে কাশতে ভাতের থালার ওপর, কোনো এক সাধারণ দুপুরে, তার দাদির মতন। এমন অসুখের জীবন যে হয়, এ বুড়িকে না দেখলে সে বুঝত না।
বুড়ির হাড্ডি ভাঙা, ঝুরঝুর করছে, শফিকুলদের ওই থাকার ঘরগুলোর মতন। আর এদিকে রক্তে নাকি এটা বেশি, ওটা কম। ডাক্তার বলেছে, দুইটা ডিম খেতে হবে প্রতিদিন, কুসুম বাদে, শুধু সাদা। দুটো ডিম সেদ্ধ করে, সাদা অংশ আলাদা করে বুড়ি খায়। কুসুম দুটো ফেলে দেয়। কী জীবন বুড়ির, ডিমটুকুও পুরো খেতে পারে না।
প্রতি বুধবারে শফিকুলদের জন্য ডিমের তরকারি রান্না হয়। টলটলে হলুদ পানির ঝোলে একগাদা পেঁয়াজের মধ্যে ডিম ভাসে। রান্নার লোকটা বড় অযতেœ রান্না করে তাদের খাওয়ায়। তবু ডিমের দিনে কেমন হাপুসহুপুস শব্দ শোনা যায় চারপাশ থেকে। মেঝেতে মাদুর পেতে কাজের লোকেরা একসাথে খায়। রাসেল ভাই প্রতিবার বলে-
‘জমিলা ভুনা ভুনা করে ডিম রাঁধবা।’
জমিলা প্রতিবার মাথা নাড়ে, আর বুধবারে ঠিক সেই হলদে টলটলে ডিমের ঝোল রেঁধে দেয়।
শফিকুলের অবশ্য টলটলে ডিমের ঝোল খারাপ লাগে না। এই যে বুড়ি ডিমের কুসুমগুলো প্রতিদিন ফেলে দেয় ময়লার ঝুড়িতে, তাও খারাপ লাগে না। বরং মায়া লাগে, বুড়ির এত আছে, তবু কুসুমের স্বাদ সে পায় না। শফিকুল তো প্রতি বুধবার আস্ত ডিম খায়, কুসুমসহ।
সেদিন ডাক্তারের লোক ব্যায়াম করাচ্ছিল বুড়ির পা দুটো টেনে টেনে। বুড়ি আধা বসা হয়ে আছে, হাতে ধরা বাটিতে দুটো সেদ্ধ ডিম। কুসুম ফেলতে যেয়ে দেখে, পাশে থাকা বেতের ময়লার ঝুড়ি নেই, কে যেন নিয়ে গেছে পরিস্কার করতে।
বুড়ি বলে-
‘কুসুম দুটো খেয়ে ফেল।’
বুড়িকে ভয় লাগে। শফিকুল তাই বাড়িয়ে কুসুম দুটো নিয়ে টপটপ করে রসগোল্লার মতন মুখে পুরে দেয়, শুকনো কুসুম দুটো গলার কাছে দলা পাকিয়ে কেমন আটকে থাকে। শুধু কুসুম, কী বিচ্ছিরি! মুখটা কুসুমের গন্ধে ভরে আছে। কুসুমের গন্ধওয়ালা ঢেকুর ওঠে। এর পর থেকে প্রতিদিন বুড়ি কুসুম দুটো শফিকুলকে দেয়। শফিকুল বুড়ির ভয়ে গিলে গিলে ফেলে। সেদিন কুসুম হাতে দিয়ে, বুড়ি পাশ ফিরে শুলো। শফিকুল একটা টিস্যু নিয়ে তাতে মুড়ে, আলতো করে শার্টের বুকপকেটে রেখে দিল। ফেলে দেওয়া যাবে পরে।
দুপুরের পর ঝিরঝির বাতাস কেমন ‘আয় বৃষ্টি আয় বৃষ্টি’ গান গায়। শফিকুলের এমন বৃষ্টি আসার আগে মুহূর্তে মরে যাওয়া ভাই রফিকুলের কথা মনে পড়ে। বৃষ্টি আসি আসি করলে, তারা তালগাছের ধার হয়ে গোল গোল করে এলোনা বেলোনা কলাপাতা ঝুম খেলত। তালগাছের বাবুই পাখিগুলোকে ঢিল মারত। সেই ঢিল ওই উঁচুতে পৌঁছত না জেনেই মারত, অহেতুক। আর বৃষ্টি এলে রফিকুল বলত-
‘চল প্যাকে গড়ান দেই।’
মাটিতে হুটোপুটি করে জলে কাদায় ভাসত।
এমন বৃষ্টি আসার আগের মুহূর্ত শফিকুলের চোখে বেশি পড়ে না আজকাল। সারাদিন তার নানা কাজ। যখন সে এমন মুহূর্ত খুঁজে পায়, রফিকুলের কথা মনে পড়ে। এই যেমন আজ। ঝিরঝির বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব, শফিকুল বাগানের কোনায় যেয়ে বসে। কেমন মেপে মেপে ফুল জন্মায় এ বাগানে, যেন কেউ এক সরু বেত দিয়ে সমান করে রাখে গাছগুলোকে। ওই যে স্কুলে যখন যেত, সেই কবে, পিটি স্যার বলত-
‘সোজা হও, আরামে দাঁড়াও।’
তেমন গাছগুলো সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে। আরাম করার সময় নেই। এমন ভাবতে ভাবতে, ঘাসে গা এলিয়ে দেয়, বুকপকেটে নরম নরম কী যেন হাতে লাগে। আধা ভাঙা সেই ডিমের কুসুম বের করে পকেট থেকে। ফেলে দিতে মায়া লাগে। আর এমন দুপুর শেষে তার একটু খিদেও পায়। রাতের আগে তো কোনো খাবার নেই আর। আচারের মতন একটু একটু করে ভেঙে ভেঙে ডিমের কুসুম মুখে পুরে। আহা এত মজা তো কখনও পায়নি সে। বুড়ির সামনে খেলে কেমন গলায় আটকে যায়, যেন শুকনো পাথর। এমন বৃষ্টিতে টপটপ ভিজতে ভিজতে ডিমের কুসুম চিবানো, পৃথিবীতে এমন সুখ সে আগে পায়নি। যদি শফিকুল কখনও একদিন প্রেমে পড়ে তো সে বুঝবে এ ভেজা সুখ প্রথম প্রেমের মতন, তার চেয়ে কম নয়।
শফিকুল এখনও সেই মুখোশের অর্থহীন স্বপ্ন দেখে, এখনও সে ঝুরঝুরে নুইয়ে পড়া ঘরে রাত কাটায়। বুড়িকে পাহারা দেয়। তবে তাতে তার সেই পাথরচাপা বোধ আর হয় না। মায়ের জন্য, আব্বা আর রফিকুলের জন্য মন খারাপের আলাদা সময় হয় না। ওই যে দুপুর শেষে ডিমের কুসুম, আহা! প্রতি বুধবার হাপুসহুপুস করে ওই পানসে ডিমের ঝোল খায় সবাই। শফিকুলের বড্ড মায়া হয় সবার জন্য, ফুর্তিও হয়। ওরা তো আর দুপুর শেষে আস্ত কুসুম মুখে পুরে দেওয়ার সুখ জানে না। ওরা জানে না ডিমের কুসুমের আলাদা স্বাদ আছে, ঘ্রাণ আছে, গলে যাওয়া এক রং আছে।
আজকাল বুড়ি ডিমের কুসুম হাতে দিলে, রান্নাঘর থেকে পাওয়া একটা পুরোনো ছোট্ট জর্দার কৌটায় টুক করে দুটো কুসুম ভরে পকেটে রাখে শফিকুল। দুপুর শেষে বাগানে বসে কুসুম খায় অল্প অল্প করে, যত সময় নিয়ে খাওয়া যায়। সে জানে, সে বাঁচে এমন দুপুর শেষে, ডিমের কুসুমে, আর বাকি দিনরাত শুধু অপেক্ষা।
এমন করেই চলছিল, কী ভালো চলছিল। আর এদিকে বুড়ি দিনদিন অসুখে পড়ে, আরও অসুখ, যেন তালগাছের মতন লম্বা হয়ে তিরতির বাড়ছে। খাওয়া নাই, ঘুম নাই। ডিম দিলে নষ্ট করে বেশিরভাগ দিন, আধাখেঁচড়া করে খায়। আর কুসুমটুকু উঠিয়ে নেয় শফিকুল।
বুড়ির ছেলেমেয়েরা বাড়ি আসে। রাসেল ভাই খবর দেয়-
‘বুড়ি মরলেই বাড়ি ভাঙব পোলামাইয়ারা। সেই ধান্ধায়ই তো আইসে। ৫ তলা দালান তুলবে।’
সে ফিসফাস শফিকুলও শুনতে পায়। চারপাশে গুনগুন বুড়ি মরে যাবে। সেই দিন আসে, যেদিন বুড়ি মরে যাবে। মরে যায়ও। ছেলেমেয়েরা ফিসফিস করে ঝগড়া করে। নতুন দালানের নকশা করে। আর কাঁদে অনেক জোরে জোরে।
শফিকুল কাঁদে। বহুদিন পরে কাঁদে। বুক ধুকধুক করে কান্না আসে। সেই মুখোশের স্বপ্ন দেখার পর যেমন বুক ধুকধুক করে, অমন। সবাই বলে-
‘আহারে বুড়িটা শফিকুলকে অনেক মায়া করত। এতিম ছেলেটা।’
শফিকুল কাঁদে, অনেক কাঁদে। অনেক কষ্ট হয় যে তার। শফিকুল অনেক অনেক দিন পর হয়তো জানবে যে প্রথম প্রেম হারিয়ে গেলে এমন কষ্ট হয়। শফিকুলের লজ্জা হয়, তবু সে কাঁদে। শফিকুলের ইচ্ছে হয়, আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করতে-
‘ডিমের কুসুম, আহারে আমার ডিমের কুসুম।’