স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা ডেস্ক: গরমকালে কালোজাম অন্যতম জনপ্রিয় ফল। স্বাদে কোনটি মিষ্টি আবার কোনটি টক-মিষ্টি। বেশ কিছু স্বাস্থ্যকর উপকারিতার জন্য এই ফল বিশেষ সমাদৃত। কালোজাম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা, বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস ও হার্টের সমস্যা রয়েছে। পুষ্টিবিদেরা ডায়েটে এই ফল রাখার কথা বলেন বার বার। জামের বীজ, পাতা এবং ছাল অনেক আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে ডায়াবিটিস রোগীদের জন্য এই ফল ওযুধের মতো কাজ করে। অন্য সব মৌসুমি ফলের তুলনায় জামের স্থায়ীকাল কম হলেও এটি পুষ্টিগুণে অতুলনীয়। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এই গরমে প্রতিদিন কালোজাম খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। কালো জামে সুক্রোজ একেবারেই থাকে না। ফলে কালো জাম রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। চিরসবুজ কালোজাম উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম সিজিজিয়াম কামিনি। কালোজাম বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত। ব্ল্যাক প্লামূ জাম্বুলূ জাম্বোলানূ জাম্বাসূ মালাবার প্লামূ রজামানূ নেরেডুূ কালা জামুনূ নাভালূ জামালিূ জাভা প্লাম ইত্যাদি নামে এটি পরিচিত। এই ফল জুন আর জুলাই মাসে পাওয়া যায়। কালোজাম গাছের উদ্ভব হয় দক্ষিণ এশিয়া, সিলন, আন্দামান ও ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ায় কালোজাম ফল ব্যাপকভাবে চাষ হয়। আমাদের দেশে কুমিল্লা, নোয়াখালী, গাজীপুর, সিলেট, ঢাকা, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় কালোজাম বেশি উৎপন্ন হয়। কালোজাম ফল লম্বাটে ডিম্বাকার। শুরুতে এটি সবুজ থাকে যা পরে গোলাপী হয় এবং পাকলে কালো বা কালচে বেগুনি হয়ে যায়। এটি খেলে জিহ্বা বেগুনি হয়ে যায়। কালোজাম পুষ্টিতে ভরা। কালোজামের বিচিও অনেক রোগের দাওয়াই। কালোজামের রয়েছে হাজারো স্বাস্থ্য উপকারিতা। কালোজামে আছে ওষুধি গুণ।
১০০ গ্রাম কালোজামে রয়েছে শক্তি ৬০ কিলোক্যালরী, শর্করা ১৫.৫৬ গ্রাম, স্নেহ পদার্থ ০.২৩ গ্রাম, প্রোটিন ০.৭২ গ্রাম, ভিটামিন এ ৩.০ আন্তর্জাতিক একক, থায়ামিন বি১ ০.০০৬ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন বি২ ০.০১২ মিলিগ্রাম, ন্যায়েসেন বি৪ ০.২৬০ মিলিগ্রাম, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড বি৫ ০.১৬০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ ০.০৩৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১৪.৩ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৯ মিলিগ্রাম, লোহা ০.১৯ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১৫ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১৭ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৭৯ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ১৪ মিলিগ্রাম, পানি ৮৩.১৩ গ্রাম। গরমে বেশি করে কালোজাম খেলে নানা রোগ থেকে নিস্তার মিলবে। সেই সঙ্গে আপনার সারা বছরের পুষ্টির চাহিদাও মেটাবে। রক্তের টক্সিন দূর করা থেকে শুরু করে হাড় মজবুত করা। সব জায়গায় এর রয়েছে গুণাগুণ। আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ জাম হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে। এছাড়াও রয়েছে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা।
ডায়াবেটিস মোকাবিলায় অব্যর্থ কালোজাম
কালোজাম ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুব ভালো। কালোজামের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন সি, থিয়ামিন, রাইবোফ্লাভিন সমৃদ্ধ কালোজাম খেলে পেট ভালো থাকে। দাঁত আর মুখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও কালোজাম অপরিহার্য। প্রতিদিন কালোজাম খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। কালোজামে সুক্রোজ একেবারেই থাকে না। ফলে কালোজাম রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তবে কালোজামের শাঁসের থেকে অনেক বেশি উপকারি কালোজামের বীচি। কালোজামের বীজে থাকে জাম্বোলিন। যা স্টার্চ সুগারে পরিণত করতে সাহায্য করে। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে কালোজাম।
ক্যানসার প্রতিরোধে
কালোজাম মুখের ভেতর উৎপাদিত ক্যানসারের সহায়ক ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব থেকে দেহকে রক্ষা করে মুখের ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রঙিন ফলের ভেতর যে পরিমাণ যৌগিক উপাদান রয়েছে, এর মধ্যে কালোজামে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ যৌগিক উপাদান রয়েছে যা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করে। জাম লড়াই করে জরায়ু, ডিম্বাশয় ও মলদ্বারের ক্যানসারের বিরুদ্ধে।
মানসিকভাবে সতেজ রাখে
কালোজামে গ্লুকোজ, ডেক্সট্রোজ ও ফ্রুকটোজ রয়েছে, যা মানুষকে জোগায় কাজ করার শক্তি। বয়স যত বাড়তে থাকে, মানুষ ততই হারাতে থাকে স্মৃতিশক্তি। কালোজাম স্মৃতিশক্তি প্রখর রাখতে সাহায্য করে।
ভিটামিন সি-এর অভাবজনিত রোগ দূর করে
কালোজামে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি। এই ফল ভিটামিন সি-এর অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধ করে। এ ছাড়া মুখের দুর্গন্ধ রোধ, দাঁত মজবুত, মাঢ়ি শক্ত এবং মাঢ়ির ক্ষয়রোধেও জামের জুড়ি নেই । এতে বিদ্যমান পানি, লবণ ও পটাসিয়ামের মতো উপাদান গরমে শরীর ঠা-া এবং শারীরিক দুর্বলতাকে দূর করতে সক্ষম। জামে রেয়েছে প্রচুর পরিমাণ আয়রন, যা রক্তস্বল্পতা দূর করে।
হাড়ের শক্তি বৃদ্ধি করে
কালোজাম ক্যালসিয়াম, লোহা, পটাসিয়াম এবং ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ। এতে প্রচুর পুষ্টি রয়েছে যা সু-স্বাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। জামে থাকা প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও লৌহ হাড়ের শক্তি বৃদ্ধির জন্য চমৎকারভাবে কাজ করে। তাই হাড় ক্ষয়ে যাওয়া রোগীদের এবং বয়স্ক মানুষদের খাবার তালিকায় এই সুস্বাদু ফলটি রাখা উচিত।
হার্টের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে
কালোজামে আছে অ্যালজিনিক এসিড বা অ্যালজিট্রিন, অ্যান্থোসিয়ানিন এবং অ্যান্থোসায়ানাডিনস এর মতো পুষ্টিসমূহ যা রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং এই যৌগগুলো শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস-সমৃদ্ধ যা অক্সিডেশন প্রতিরোধ করে এবং হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভালো রাখতে অসামান্য অবদান রাখে। এছাড়াও এটি পটাসিয়াম-এর একটি সমৃদ্ধ ভা-ার, যা উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে সাহায্য করে, যা হার্ট অ্যাটাক-এর ঝুঁকি, স্ট্রোক প্রভৃতির ঝুঁকির কারণ।
ওজন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কালোজাম
কালোজামে কম পরিমাণে ক্যালোরি থাকে, যা ক্ষতিকর তো নয়ই বরং স্বাস্থ্যসম্মত। তাই যারা ওজন নিয়ে চিন্তায় আছেন এবং নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন, তারা খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন কালোজাম।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
কালোজামে ফাইটো কেমিক্যালস আর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট বিদ্যমান। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, সঙ্গে মৌসুমি সর্দি-কাশি থেকে মুক্তি দেয়। প্রতিরোধ করে ইনফেকশনের মতো সমস্যারও। জামে পাওয়া গেছে অ্যালার্জিক নামে এক ধরনের এসিডের উপস্থিতি, যা ত্বককে করে শক্তিশালী। ক্ষতিকর আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মির প্রভাব থেকে ত্বক ও চুলকে রক্ষা করে। এ অ্যালার্জিক এসিড ক্ষতিকর ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
চোখের সমস্যা দূর করে
বৃদ্ধ বয়সে চোখের অঙ্গ ও স্নায়ুগুলোকে কর্মময় করতে সাহায্য করে। কালোজাম চোখের ইনফেকশনজনিত সমস্যা ও সংক্রামক (ছোঁয়াচে) রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। রাতকানা রোগ এবং যাদের চোখের ছানি অপারেশন হয়েছে তাদের জন্য কালোজাম ভীষণ উপকারী। আমাদের নাক, কান, মুখের ছিদ্র, চোখের কোনা দিয়ে বাতাসে ভাসমান রোগজীবাণু দেহের ভেতর প্রবেশ করে। কালোজামের রস এ জীবাণুকে মেরে ফেলে।
কালোজামের বীজ খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে
কালোজাম খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। কালোজাম ছাড়াও এর বীজ কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা হয়, জামের বীজের গুঁড়া বানিয়ে খেলে ডায়াবিটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে। গরমের পর অন্যান্য মরসুমে জামের বীজ খেয়েও ডায়াবিটিসকে জব্দ করতে পারেন। জামের বীজে জাম্বোলিন এবং জাম্বোসিন নামে যৌগ থাকে যা রক্তে শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। শরীরে ইনসুলিন হরমোনোর ক্ষরণ বাড়ায়। জামের বীজের প্রোফাইল্যাকটিক ক্ষমতা যা হাইপারগ্লাইসেমিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে। এই ফলের বীজ ঘন ঘন মূত্রত্যাগ কমাতেও সাহায্য করে। এ ছাড়া জামে ভরপুর মাত্রায় অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট থাকে, যা ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য উপকারী। যাঁরা ডায়াবিটিসে ভোগেন, তাঁদের অনেকের যৌন চাহিদা কমে যায়, লিঙ্গ উত্থানেও সমস্যা দেখা যায়। এই সমস্যা দূর করতেও কালোজামের বীজ বেশ উপকারী। কালোজামের বীজে ভরপুর মাত্রায় ফাইবার থাকে, যা হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। পেট পরিষ্কার থাকলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, ফলে ডায়াবেটিসও বাগে রাখা সম্ভব হয়।
কালোজামের বীজ যেভাবে খাবেন
জাম মাখা খাওয়ার সময়ে ফল থেকে বীজ আলাদা করে নিন। এ বার বীজগুলোকে ভাল করে ধুয়ে শুকনো কাপড়ের উপর রেখে রোদে শুকোতে দিন। ৩-৪ দিন রাখুন। বীজগুলো সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার পর বাইরের খোলস ছাড়িয়ে ভিতর থেকে সবুজ অংশ সংগ্রহ করে নিন। বীজের ভিতরের অংশগুলিকে ফের রোদে শুকোতে হবে। শুকিয়ে গেলে ভাল করে পিষে নিন। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক গ্লাস দুধ কিংবা পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেয়ে ফেলুন।