প্রযুক্তি ডেস্ক: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইচালিত নতুন এক চিকিৎসা সহায়ক টুল তৈরি করেছে মাইক্রোসফট, যা জটিল রোগ শনাক্ত করতে মানুষের চেয়ে চার গুণ বেশি ভালো বলে দাবি মার্কিন সফটওয়্যার জায়ান্ট কোম্পানিটির। সম্প্রতি নতুন এক গবেষণা প্রকাশ করেছে মাইক্রোসফট। তাদের মতে, এ গবেষণা চিকিৎসার গতি বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।
‘এআই ডায়াগনস্টিক অর্কেস্ট্রেটর’ নামের নতুন এআই টুলটি তৈরি করেছে মাইক্রোসফট, যা তাদের নতুন স্বাস্থ্যবিষয়ক এআই ইউনিটের প্রথম প্রকল্প। এ ইউনিটটি তৈরি করেছেন মুস্তাফা সুলেইমান। এআই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিপমাইন্ড-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি, যেটি এখন গুগলের মালিকানাধীন স্টার্টআপ। ডিপমাইন্ড থেকে কিছু দক্ষ কর্মীকে নিয়ে এসে সুলেইমান এ নতুন মাইক্রোসফট ইউনিটে কাজ শুরু করেন বলে প্রতিবেদনে লিখেছে ব্রিটিশ দৈনিক পত্রিকা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস। এক সাক্ষাৎকারে মাইক্রোসফট এআই-এর এই প্রধান বলেছেন, এ ট্রায়ালটি ‘মেডিক্যাল সুপারইন্টেলিজেন্স’-এর পথে এমন এক পদক্ষেপ, যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কর্মী সংকট ও দীর্ঘ অপেক্ষার সময় কমিয়ে আনতে সহায়তা করতে পারে। মাইক্রোসফটের নতুন সিস্টেমে পাঁচটি আলাদা এআই প্রোগ্রাম রয়েছে, যেগুলো একে অপরের সঙ্গে কথা বলে ও মতামত বিনিময় করে। বিষয়টি এমন, যেন পাঁচজন ‘ডাক্তার’ মিলে রোগের সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে ও রোগীর সঠিক পরীক্ষা নির্ধারণ করতে ‘পরামর্শ’ দিচ্ছে। এ পুরো প্রক্রিয়াটি ‘অর্কেস্ট্রেটর’ নামের প্রচলিত এক সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে, যার নাম ‘এমএআই-ডিএক্সও’। এটি সবাইকে একত্র করিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় কোনো রোগের চিকিৎসার জন্য সঠিক পথ কী হবে।
টুলটির সক্ষমতা পরীক্ষা করতে ‘এমএআই-ডিএক্সও’ সিস্টেমকে ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন’ বা এনইজেএম থেকে নেওয়া তিনশ ৪টি গবেষণা পড়ানো হয়েছে, যেগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছে সবচেয়ে জটিল রোগের বিভিন্ন কেইস কীভাবে সমাধান করেছিলেন ডাক্তাররা। ফলে গবেষকরা পরীক্ষা করতে পেরেছেন, এ প্রোগ্রামটি সঠিক রোগ নির্ণয় বের করতে পারে কি না এবং কীভাবে সে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তা-ও ব্যাখ্যা করতে পারে কি না। এজন্য ‘চেইন অফ ডিবেট’ নামে নতুন এক কৌশল ব্যবহার করেছেন তারা, যা এআই মডেলকে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করতে বাধ্য করে কীভাবে সমস্যার সমাধান করেছে এটি।
চ্যাটজিপিটির নির্মাতা ওপেনএআই, মেটা, অ্যানথ্রপিক, গুগল, এক্সএআই ও ডিপসিকের উন্নত ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ বা এলএলএম ব্যবহার করেছে মাইক্রোসফট, যেখানে এসব সব মডেলকে আরো ভালোভাবে কাজ করতে সাহায্য করেছে ‘অর্কেস্ট্রেটর’। তবে এটি সবচেয়ে ভালো কাজ করেছে ওপেনএআইয়ের ‘০৩’ রিজনিং মডেলের সঙ্গে, যেটি এনইজেএম-এর ৮৫.৫ শতাংশ কেইস সঠিকভাবে সমাধান করেছে।
অভিজ্ঞ ডাক্তাররা যেখানে কেবল ২০ শতাংশ কেইস সঠিকভাবে সমাধান করতে পেরেছেন সেখানে ওপেনএআইয়ের মডেল অনেক ভালো করেছে। তবে এসব ডাক্তারদের সেই পরীক্ষায় বই দেখার বা সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি, যা পেলে তাদের সাফল্যের হার আরো বেশি হতে পারত বলে প্রতিবেদনে লিখেছে এফটি।
এ প্রযুক্তির একটি সংস্করণ শিগগিরই কোপাইলট এআই চ্যাটবট এবং বিং সার্চ ইঞ্জিনেও ব্যবহার করতে পারে মাইক্রোসফট, যেগুলো প্রতিদিন প্রায় ৫ কোটি স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে।
সুলেইমান বলেছেন, মাইক্রোসফট এখন এমন এআই মডেল তৈরির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে, যা কেবল মানুষের চেয়ে ভালো নয়, বরং মানব সক্ষমতার চেয়ে নাটকীয়ভাবে ভালো। এগুলো মানুষের কর্মক্ষমতার চেয়ে দ্রুত, সাশ্রয়ী ও চার গুণ বেশি নির্ভুল। সত্যিই এক বিশাল পরিবর্তন এনে দেবে এই টুল।
সুলেইমানের এ নতুন উদ্যোগ এমন সময়ে এসেছে যখন এরইমধ্যে স্বাস্থ্যখাতে এআই নিয়ে বড় অর্জনের পথ দেখিয়েছে ডিপমাইন্ড। এআই ব্যবহার করে প্রাণের ভিত্তি গঠনকারী প্রোটিনের জৈবিক রহস্য উন্মোচনের জন্য গত বছর যৌথভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন গুগলের এ এআই গবেষণাগারের প্রধান ডেমিস হাসাবিস।
এফটি লিখেছে, ওপেনএআইতে প্রায় এক হাজার চারশ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে মাইক্রোসফট। পাশাপাশি ওপেনএআইয়ের প্রযুক্তি ব্যবহার ও বিক্রির একচেটিয়া অধিকার রয়েছে কোম্পানিটির। তবে বর্তমানে এ দুই কোম্পানির মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ টানাপোড়েন চলছে। কারণ, লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের চেষ্টা করছে ওপেনএআই। আর এ প্রক্রিয়ায় তাদের পার্টনারশিপের ভবিষ্যৎ শর্তাবলী নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে।
সুলেইমান বলেছেন, ওপেনএআইয়ের মডেল সেরা পারফর্ম করলেও এ নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে মাইক্রোসফট। তাদের কাছে ‘এমএআই-ডিএস্কও’-তে ব্যবহৃত চারটি ‘বিশ্বমানের মডেলে’র মধ্যে কোনটি ব্যবহৃত হচ্ছে তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
আমরা অনেক দিন ধরেই বিশ্বাস করে চলেছি, এসব মডেল কেবল পণ্য হিসেবেই রয়ে যাবেৃ তবে আমার ধারণা এই ‘অ্যাগ্রিগেট অর্কেস্ট্রেটর’ বা সম্মিলিত নিয়ন্ত্রণ সিস্টেমই মূল পার্থক্য তৈরি করবে।
গত বছরের শেষ দিকে মাইক্রোসফটে যোগ দেওয়া ডিপমাইন্ডের স্বাস্থ্য ইউনিটের প্রাক্তন প্রধান ডমিনিক কিং বলেছেন, এ প্রোগ্রামটি “আমাদের আগে দেখা যে কোনো কিছুর চেয়ে ভালো ফলাফল দিয়েছে এবং বর্তমানে এমন সুযোগ তৈরি করেছে, যা স্বাস্থ্যসেবায় নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে।
‘স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সলেশনাল ইনস্টিটিউট’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এরিক টোপল বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এটি। বাস্তব বিশ্বের চিকিৎসায় এর প্রয়োগ না হলেও প্রথমবারের মতো চিকিৎসা ক্ষেত্রে জেনারেটিভ এআইয়ের সমক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে এই টুল, যেখানে রোগ নির্ণয়ে নির্ভুলতা ও খরচ কমিয়ে আনার সম্ভাবনা রয়েছে এর।