আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নতুন প্রশাসনের দুই সপ্তাহ পার হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের তিন প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর কঠোর শুল্ক আরোপ করেছেন। তার এই নীতি বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত এক নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি হওয়া পণ্যে ২৫ শতাংশ এবং চীন থেকে আমদানি করা পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্ত বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এতে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি ট্রাম্পের প্রথম পদক্ষেপ মাত্র, সামনে তার আরও কঠোর শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা থাকতে পারে।
আগের চেয়ে কঠোর শুল্ক ব্যবস্থা: ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ফলে তার বাণিজ্যনীতির কঠোর অবস্থান সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকলে সেটি দূর হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার আগে কানাডা ও মেক্সিকোর কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন, যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে পারেন, উত্তর আমেরিকার ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে এমন শুল্ক আরোপ হবে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। তবে তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি ট্রাম্প।
শুল্কের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে কেবল কানাডার তেল ও গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে, যা ১০ শতাংশ হারে শুল্কের আওতায় থাকবে। চীনের ওপর আরোপিত ১০ শতাংশ শুল্ক তুলনামূলক কম মনে হলেও এটি আগে থেকে চলমান ২৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশটির সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনে তার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল চীন, যেখানে প্রায় ৩৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। এবার কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি করা প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য শুল্কের আওতায় আনা হয়েছে। এমনকি স্মার্টফোন, কম্পিউটার ও খেলনার মতো ভোক্তা-সংশ্লিষ্ট পণ্যও এবার শুল্কের আওতায় এসেছে, যা ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
আগেরবারের তুলনায় এবারের শুল্ক ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর হতে যাচ্ছে। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ধাপে ধাপে শুল্ক আরোপ করেছিলেন, যা ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতির জন্য সময় দিয়েছিল। এবার ৪ ফেব্রুয়ারি থেকেই নতুন শুল্ক কার্যকর হচ্ছে। তিনি আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি এই শুল্ক আরোপের ক্ষমতা পেয়েছেন।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও সমালোচনা: বিশ্লেষকদের মতে, এই নতুন শুল্ক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব আয় ১১০ বিলিয়ন ডলার বাড়তে পারে, যা দেশটির মোট রাজস্ব আয়ের মাত্র ২ শতাংশ। এই শুল্কের ব্যয় মূলত বহন করতে হবে মার্কিন ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের। মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আমদানি হওয়া গাড়ি, টমেটো, অ্যাভোকাডো, ও তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে।
ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, উচ্চ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন বাড়াতে পারবেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মতো দক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে না। তিন দশকের বেশি সময় ধরে কানাডা, মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
মেক্সিকো ও কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে। তবে তারা একটি দোটানার মধ্যে রয়েছে—যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা শুল্ক বসালে তাদের নিজেদের অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, আবার কোনো পদক্ষেপ না নিলে দুর্বলতা প্রকাশ পাবে।
ট্রাম্প এর মধ্যেই ইউরোপের বিরুদ্ধে নতুন শুল্ক আরোপের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং তেল ও গ্যাসের ওপর সাধারণ শুল্ক বসানোর পরিকল্পনা করছেন। তার লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হওয়া সব পণ্যের ওপর শুল্ক বসানো। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের ওপর আরোপিত শুল্ক বিশ্ববাণিজ্যে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। তারচেয়েও বড় কথা, এটি এই সংকটের শুরু মাত্র।