ঢাকা ০৪:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

টেকসই নগরায়ণ ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ

  • আপডেট সময় : ১০:৪২:২৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ৭৭ বার পড়া হয়েছে

মো. আবু নাইম সোহাগ : ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা হল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক প্রণীত একটি পরিকল্পনা যা ঢাকার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি, স্থায়ী এবং পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে প্রণয়ন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর অঞ্চলের জন্য প্রস্তুতকৃত বিদ্যমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১০ সালে অনুমোদিত হয় এবং পরবর্তীতে বেশ কিছু পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন ও হালনাগাদ করতঃ ২০২২ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ড্যাপের মূল লক্ষ্য হল ঢাকার ভূমি ব্যবহার, অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, এবং নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়নকে সমন্বিত করে একটি সুসমন্বিত নগরায়ন গঠন করা। যেকোনো দেশের টেকসই উন্নয়ন ও পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
ড্যাপ যদি সঠিকভাবে এবং সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তবে ঢাকার নগরায়ণের ক্ষেত্রে এটি একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটি একটি পরিবেশবান্ধব, বাসযোগ্য, এবং সুপরিকল্পিত নগরায়ণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, অংশীজন ও নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ করে টেকসই সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ এবং অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহারের কারণে শহরের পরিবেশ এবং বাসযোগ্যতার উপর নেতিবাচক প্রভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঢাকায় প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে যানজট, বায়ু দূষণ, পানি নিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা সমস্যাসহ বিভিন্ন পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ। নাগরিকগণ বঞ্চিত হচ্ছে মৌলিক সুযোগ সুবিধাসমূহ হতে। বসবাসযোগ্যতার মানদন্ডে ঢাকার অবস্থান ক্রমাগত নিম্নগামী। এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। ড্যাপের মূল উদ্দেশ্যই হল ঢাকার জন্য একটি সুস্থ, সবুজ ও পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত করা।
ড্যাপের মাধ্যমে রাজউক ঢাকাকে একটি আদর্শ নগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তবে এর সফল বাস্তবায়ন এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন দক্ষ নেতৃত্ব, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং যথাযথ আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামো। গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার কর্তৃক বর্তমানে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। এই সরকার দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে এবং বর্তমান রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকালীন সময়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল নানাবিধ যৌক্তিক অযৌক্তিক দাবীতে সরকারকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে।
আমরা যারা নগর, অঞ্চল ও স্থানিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি তারা অত্যন্ত উদ্বেগ এর সাথে লক্ষ্য করছি যে, ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বাতিলের দাবীতে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল উঠে পড়ে লেগেছে। বিশেষ করে ড্যাপের কয়েকটি নীতিমালা এবং বিধি বাতিলের দাবি তুলেছেন তারা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মূলত আবাসন ব্যবসায়ীদের মধ্যেই বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এর আগে ড্যাপ বাতিলের জন্য কম রাজনীতি হয়নি।
২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর রিহ্যাব কর্তৃক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে পত্র মারফত ড্যাপের বিরুদ্ধে বিষদগার করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের তৎকালীন সভাপতি এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা’কে সরকারের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেন। তবে এতো রাজনীতির পরও ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তা গেজেটভুক্ত (২০২২-২০৩৫) করা হয়।
প্লট মালিক ও আবাসন ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন যে ড্যাপের প্রস্তাবিত পরিকল্পনা ও নীতিমালাগুলো তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কিছু মূল উদ্বেগ হলো: ভূমি ব্যবহার নিষেধাজ্ঞা: ড্যাপে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ভূমি ব্যবহার সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে যা নতুন আবাসন প্রকল্পের জন্য জমি কেনা এবং উন্নয়নকে কঠিন করে তুলছে।
উচ্চতাসীমা নির্ধারণ: ড্যাপে ভবনের উচ্চতা সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাব রয়েছে। এই নিয়মের কারণে ব্যবসায়ীরা সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করতে পারছেন না, যা তাদের মুনাফার ওপর সরাসরিভাবে প্রভাব ফেলছে।
আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া: ড্যাপের অধীনে আবাসন প্রকল্পগুলোর জন্য আরও কঠোর অনুমোদন প্রক্রিয়া প্রস্তাব করা হয়েছে, যা সময়সাপেক্ষ এবং জটিল।
পরিবেশগত বিধিনিষেধ: পরিবেশ রক্ষার নামে কিছু এলাকা নির্মাণ কার্যক্রম থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছে।
আবাসন ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, ড্যাপের কারণে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তারা বলছেন, ড্যাপের প্রস্তাবিত নীতিমালা গুলো বর্তমান বাস্তবতা এবং বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ফলে তারা ড্যাপ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন এবং রাজউককে নতুন করে আলোচনার মাধ্যমে একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ১ সেপ্টেম্বর রাজউকে ড্যাপ সংশোধন সংক্রান্ত একটি অংশীজন সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় আবাসন ব্যবসায়ীরা অনেকটাই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ড্যাপ বাতিল করে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী ভবন নির্মানের অনুমোদন দেয়ার দাবী জানায়। এই দাবীর সাথে একাত্মতা ঘোষনা করে স্থপতি সংগঠনের প্রতিনিধিরাও। অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এই যে বিভিন্ন মহল ড্যাপে প্রস্তাবিত জোনিং প্রবিধান, ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) এর সংস্কার নিয়েও উঠে পড়ে লেগেছে।
ড্যাপের এফএআর সংশ্লিষ্ট বিষয়টি প্লট মালিক ও আবাসন ব্যবস্যায়ীদের অর্থনৈতিক লাভ ও মুনাফার সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিধায় এফএআর বাড়ানোতেই তাদের এত আগ্রহ অথচ ড্যাপ প্রণীত এফএআর এর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে ইতিপূর্বে অনলাইনে জরিপে নাগরিক সমাজের ৭০ শতাংশ লোকজনই এফএআর কে যৌক্তিক বলেছে। ড্যাপ বাতিল সংক্রান্ত অযৌক্তিক দাবী উপস্থাপনকারী ও দাবীর সাথে একাত্মতা পোষনকারীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা এখন সময়ের দাবী।
ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাতিল করে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মোতাবেক ভবণ নির্মানের অনুমোদন দেয়া হলে এর বেশ কিছু ক্ষতিকর প্রভাব আমদের প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার মানের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। ২০০৮ এর নির্মান বিধিমালাকে অনুসরণ করার কারনে ঢাকার পাশাপাশি বর্তমানে চট্রগ্রাম শহরের বসবাসযোগ্যতাও নষ্ট হয়েছে। শুধু বড় শহর গুলোই নয় বরং জেলা শহর, পৌর এলাকাও অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং ২০০৮ এর নির্মান বিধিমালাকে অনুসরণ করার কারণে বসবাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।
যে কোনো পরিকল্পনাই ভুল-ত্রুটি উর্ধে নয়। এমনকি প্রতি ৫ বছর পর পর বর্তমান ড্যাপ রিভিউ করার বিধান রয়েছে। ড্যাপে যদি পরিকল্পনাগত ভুল থেকে থাকে তবে তা সংশোধন করাই শ্রেয় কিন্ত স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে ড্যাপ বাতিল বা স্থগিত করা হবে আত্মঘাতী। ড্যাপ যদি সঠিকভাবে এবং সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তবে ঢাকার নগরায়ণের ক্ষেত্রে এটি একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এটি একটি পরিবেশবান্ধব, বাসযোগ্য ও সুপরিকল্পিত নগরায়ণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, অংশীজন ও নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ করে টেকসই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ণ ও বাস্তবায়ন।
লেখক: পরিকল্পনাবিদ, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স এর ফেলো ও নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং পরিকল্পনা পরামর্শক, উন্নয়ন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষনা কার্যক্রমসহ নির্মাণ ব্যবসার সাথে যুক্ত, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

২৬ ব্যাংকের এমডি-পরিচালকের সম্পদ যাচাই, তদন্তের আওতায় সাবেক গভর্নররাও

টেকসই নগরায়ণ ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ

আপডেট সময় : ১০:৪২:২৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মো. আবু নাইম সোহাগ : ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা হল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক প্রণীত একটি পরিকল্পনা যা ঢাকার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি, স্থায়ী এবং পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে প্রণয়ন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর অঞ্চলের জন্য প্রস্তুতকৃত বিদ্যমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১০ সালে অনুমোদিত হয় এবং পরবর্তীতে বেশ কিছু পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন ও হালনাগাদ করতঃ ২০২২ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ড্যাপের মূল লক্ষ্য হল ঢাকার ভূমি ব্যবহার, অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, এবং নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়নকে সমন্বিত করে একটি সুসমন্বিত নগরায়ন গঠন করা। যেকোনো দেশের টেকসই উন্নয়ন ও পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
ড্যাপ যদি সঠিকভাবে এবং সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তবে ঢাকার নগরায়ণের ক্ষেত্রে এটি একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটি একটি পরিবেশবান্ধব, বাসযোগ্য, এবং সুপরিকল্পিত নগরায়ণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, অংশীজন ও নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ করে টেকসই সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ এবং অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহারের কারণে শহরের পরিবেশ এবং বাসযোগ্যতার উপর নেতিবাচক প্রভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঢাকায় প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে যানজট, বায়ু দূষণ, পানি নিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা সমস্যাসহ বিভিন্ন পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ। নাগরিকগণ বঞ্চিত হচ্ছে মৌলিক সুযোগ সুবিধাসমূহ হতে। বসবাসযোগ্যতার মানদন্ডে ঢাকার অবস্থান ক্রমাগত নিম্নগামী। এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। ড্যাপের মূল উদ্দেশ্যই হল ঢাকার জন্য একটি সুস্থ, সবুজ ও পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত করা।
ড্যাপের মাধ্যমে রাজউক ঢাকাকে একটি আদর্শ নগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তবে এর সফল বাস্তবায়ন এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন দক্ষ নেতৃত্ব, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং যথাযথ আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামো। গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার কর্তৃক বর্তমানে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। এই সরকার দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে এবং বর্তমান রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকালীন সময়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল নানাবিধ যৌক্তিক অযৌক্তিক দাবীতে সরকারকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে।
আমরা যারা নগর, অঞ্চল ও স্থানিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি তারা অত্যন্ত উদ্বেগ এর সাথে লক্ষ্য করছি যে, ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বাতিলের দাবীতে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল উঠে পড়ে লেগেছে। বিশেষ করে ড্যাপের কয়েকটি নীতিমালা এবং বিধি বাতিলের দাবি তুলেছেন তারা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মূলত আবাসন ব্যবসায়ীদের মধ্যেই বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এর আগে ড্যাপ বাতিলের জন্য কম রাজনীতি হয়নি।
২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর রিহ্যাব কর্তৃক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে পত্র মারফত ড্যাপের বিরুদ্ধে বিষদগার করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের তৎকালীন সভাপতি এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা’কে সরকারের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেন। তবে এতো রাজনীতির পরও ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তা গেজেটভুক্ত (২০২২-২০৩৫) করা হয়।
প্লট মালিক ও আবাসন ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন যে ড্যাপের প্রস্তাবিত পরিকল্পনা ও নীতিমালাগুলো তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কিছু মূল উদ্বেগ হলো: ভূমি ব্যবহার নিষেধাজ্ঞা: ড্যাপে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ভূমি ব্যবহার সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে যা নতুন আবাসন প্রকল্পের জন্য জমি কেনা এবং উন্নয়নকে কঠিন করে তুলছে।
উচ্চতাসীমা নির্ধারণ: ড্যাপে ভবনের উচ্চতা সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাব রয়েছে। এই নিয়মের কারণে ব্যবসায়ীরা সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করতে পারছেন না, যা তাদের মুনাফার ওপর সরাসরিভাবে প্রভাব ফেলছে।
আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া: ড্যাপের অধীনে আবাসন প্রকল্পগুলোর জন্য আরও কঠোর অনুমোদন প্রক্রিয়া প্রস্তাব করা হয়েছে, যা সময়সাপেক্ষ এবং জটিল।
পরিবেশগত বিধিনিষেধ: পরিবেশ রক্ষার নামে কিছু এলাকা নির্মাণ কার্যক্রম থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছে।
আবাসন ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, ড্যাপের কারণে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তারা বলছেন, ড্যাপের প্রস্তাবিত নীতিমালা গুলো বর্তমান বাস্তবতা এবং বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ফলে তারা ড্যাপ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন এবং রাজউককে নতুন করে আলোচনার মাধ্যমে একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ১ সেপ্টেম্বর রাজউকে ড্যাপ সংশোধন সংক্রান্ত একটি অংশীজন সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় আবাসন ব্যবসায়ীরা অনেকটাই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ড্যাপ বাতিল করে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী ভবন নির্মানের অনুমোদন দেয়ার দাবী জানায়। এই দাবীর সাথে একাত্মতা ঘোষনা করে স্থপতি সংগঠনের প্রতিনিধিরাও। অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এই যে বিভিন্ন মহল ড্যাপে প্রস্তাবিত জোনিং প্রবিধান, ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) এর সংস্কার নিয়েও উঠে পড়ে লেগেছে।
ড্যাপের এফএআর সংশ্লিষ্ট বিষয়টি প্লট মালিক ও আবাসন ব্যবস্যায়ীদের অর্থনৈতিক লাভ ও মুনাফার সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিধায় এফএআর বাড়ানোতেই তাদের এত আগ্রহ অথচ ড্যাপ প্রণীত এফএআর এর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে ইতিপূর্বে অনলাইনে জরিপে নাগরিক সমাজের ৭০ শতাংশ লোকজনই এফএআর কে যৌক্তিক বলেছে। ড্যাপ বাতিল সংক্রান্ত অযৌক্তিক দাবী উপস্থাপনকারী ও দাবীর সাথে একাত্মতা পোষনকারীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা এখন সময়ের দাবী।
ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাতিল করে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মোতাবেক ভবণ নির্মানের অনুমোদন দেয়া হলে এর বেশ কিছু ক্ষতিকর প্রভাব আমদের প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার মানের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। ২০০৮ এর নির্মান বিধিমালাকে অনুসরণ করার কারনে ঢাকার পাশাপাশি বর্তমানে চট্রগ্রাম শহরের বসবাসযোগ্যতাও নষ্ট হয়েছে। শুধু বড় শহর গুলোই নয় বরং জেলা শহর, পৌর এলাকাও অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং ২০০৮ এর নির্মান বিধিমালাকে অনুসরণ করার কারণে বসবাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।
যে কোনো পরিকল্পনাই ভুল-ত্রুটি উর্ধে নয়। এমনকি প্রতি ৫ বছর পর পর বর্তমান ড্যাপ রিভিউ করার বিধান রয়েছে। ড্যাপে যদি পরিকল্পনাগত ভুল থেকে থাকে তবে তা সংশোধন করাই শ্রেয় কিন্ত স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে ড্যাপ বাতিল বা স্থগিত করা হবে আত্মঘাতী। ড্যাপ যদি সঠিকভাবে এবং সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তবে ঢাকার নগরায়ণের ক্ষেত্রে এটি একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এটি একটি পরিবেশবান্ধব, বাসযোগ্য ও সুপরিকল্পিত নগরায়ণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, অংশীজন ও নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ করে টেকসই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ণ ও বাস্তবায়ন।
লেখক: পরিকল্পনাবিদ, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স এর ফেলো ও নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং পরিকল্পনা পরামর্শক, উন্নয়ন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষনা কার্যক্রমসহ নির্মাণ ব্যবসার সাথে যুক্ত, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক