ঢাকা ০৬:৩২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ অগাস্ট ২০২৫

টিপ ও হিজাব বিতর্কে সামাজিক ভাবনার স্বরূপ উন্মোচন

  • আপডেট সময় : ০৯:৫১:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ এপ্রিল ২০২২
  • ৯৬ বার পড়া হয়েছে

ইয়াসির আরাফাত (তূর্য) : ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ প্রদানকালে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন: ‘আমার জীবনে আমি দেখেছি গুলির সামনে এগিয়ে গেলেও আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেননি। আমি ১০-১২ বছর জেল খেটেছি। জীবনে কোনোদিন মুখ খুলে তিনি (বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব) প্রতিবাদ করেননি। যদি করতেন তাহলে হয়তো আমার জীবনে অনেক বাধা আসত। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে। ইতিহাসে পুরুষের নাম লেখা হয়, নারীর নাম লেখা হয় না। তাই আপনাদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম।’

জাতির পিতার আত্মোপলব্ধি অনুসরণ করে নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা সম্মান প্রদান করলে পুরুষ মানুষের গৌরব মহিমা কমে না, বরং সমুন্নত হয়। নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার ও সম্মান প্রদান করলে কার্যত পুরুষ-ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়। কেননা একজন নারী দিন শেষে কোনো না কোনো পুরুষের কন্যা, কোনো না কোনো পুরুষের বোন, কোনো না কোনো পুরুষের স্ত্রী, সন্তানের মা। তাই কন্যার সাফল্যে পিতার সমৃদ্ধি ঘটে, বোনের উন্নতির ইতিবাচক প্রভাব ভাইয়ের উপর পড়ে, স্ত্রীর মর্যাদা বাড়লের স্বামীর মর্যাদাও বাড়ে, মায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে সন্তানকেও কেউ অধিকারবঞ্চিত করতে পারে না।

শিক্ষা নিয়ে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের উপলব্ধি ‘শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।’ অর্থাৎ শিক্ষা মিথ্যাকে দূরীভূত করে সত্যের বিকাশ ঘটায়। বাংলাদেশে গত এক দশকে সরকারি বেসরকারি নানামুখি উদ্যোগে শিক্ষার হার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারিভাবে দেশব্যাপী কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে বছরের প্রথম দিনেই বিনামূল্যে নতুন বই ও শিক্ষা উপকরণ প্রদান, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান ও শিক্ষার প্রসারে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে ফলে শিক্ষা সহজলভ্য হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া প্রায় ৩০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষায় একটি অলিখিত বিপ্লব সাধিত হয়েছে যা দৃশ্যমান।

দেশ ও জাতি ইতোমধ্যে প্রগতির মহাসড়ক ধরে দুর্বার গতিতে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীর এগিয়ে চলার ইতিবাচক ফল পেতে শুরু করেছে। অবধারিতভাবেই দেশের প্রত্যেক সেক্টরে নেতৃত্ব প্রদানে এগিয়ে আসছে শিক্ষিত নারী। এ দেশে জ্ঞাণ-বিজ্ঞান ও শিক্ষার আলোয় আলোকিত একটি সচেতন প্রজন্ম তৈরি হয়ে গেলে শিক্ষা সম্পর্কে মহামতি সক্রেটিসের উপলব্ধির ন্যায় মিথ্যার বেসাতি নিয়ে সমাজকে অতিতের অন্ধকারের দিকে টেনে নিতে তৎপর স্বার্থান্ধদের মুখোশ খুলে যাবে। জাতির কাছে উন্মোচিত হয়ে পড়বে তাদের অন্তঃসারশূণ্য চিন্তাভাবনা, লালসালুর কঙ্কাল। সুশিক্ষিত জ্ঞানের আলোয় আলোকিত তরুণদের দ্বারা সত্যের মুক্তি নিশ্চিত হবে, মিথ্যাকে পদদলিত করে সূচিত হবে উন্নত সমাজের শুভ উদ্বোধন।

আজ থেকে ১১০ বছর পূর্বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অমরসৃষ্টি ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়িকা কুমুদিনীকে তাঁর স্বামী মধুসূদনকর্তৃক যৌন নিপিড়নের শিকার হয়ে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বড় ভাই বিপ্রদাশের কাছে আশ্রয় নিলে বিপ্রদাশ তাদের আত্মমর্যাদায় বলিয়ান মায়ের কথে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমার মা যে অপমান পেয়েছিলেন তাতে সমগ্র স্ত্রী জাতির অসম্মান। কুমু (কুমুদিনী) তুই নিজের কথা না ভেবে সেই অসম্মানের বিরুদ্ধে দাঁড়াবি। কিছুতেই হার মানবি না।’

নারীর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলে প্রকারান্তরে দেশ ও জাতি উন্নতির পথে অগ্রসর হয় সে সুন্দরতম সত্যকে উপলব্ধি করে জগদ্বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি দেব।’

গত এক দশকে সামগ্রিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অগ্রসরমান অভিযাত্রা দেশটির প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ আন্তর্জাতিক চক্র ও এদেশের পাকিস্তানপন্থী ধর্ম ব্যবসায়ীদের অনুভূতিতে প্রবল আঘাত হেনেছে। তাই দ্রুত অগ্রসরমান বাংলাদেশকে ঠেকাতে তাদের প্রধান ও সহজতম টার্গেটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের নারী সমাজ। কারণ বাংলাদেশের নারী সমাজকে কর্মক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত করতে পারলে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতির প্রায় ৫০ শতাংশ থামিয়ে দেয়া সম্ভব।

এ দেশে নারীদের ব্যবহার্য অনুষঙ্গ টিপ, হিজাব নিয়ে কুচর্চা হচ্ছে ধর্মের লেবাসধারী বাংলাদেশবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের ষড়যন্ত্রের, অপরাজনীতির অস্ত্র। তবে রহস্যের বিষয় হলো দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা নারীর প্রতি সামাজিক সহিংসতা রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানি নিয়ে ধর্মীয় মোড়লগণ তেমন একটা উচ্চবাচ্য করেন না। বাংলাদেশে প্রায় ৮৪ শতাংশ নারী প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে, শিক্ষাঙ্গনে, কর্মস্থলে এমনকি নিজ পরিবারে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন! প্রতিদিন দেশে গড়ে ৩ জনের বেশি নারী জোরপূর্বক পুরুষ কর্তৃক ধর্ষিত হচ্ছেন। ধর্ষণ হলো আগ্রাসী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পেশিশক্তির কদর্যতম প্রকাশ।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই কাপুরুষোচিত পরাজয় নিয়ে নারীকে চার দেয়ালে বন্দি করে স্রেফ দাসী হিসেবে দেখতে আগ্রহী ফতোয়াবাজ মোল্লারা খুব একটা সোচ্চার নন। এর কারণ কি তাহলে এই দাঁড়ালো যে, ধর্ম্যবসায়ীরা নারীর আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক মুক্তি ও আত্মমর্যাদায় তাদের অগ্রগতি মেনে নিতে পারছে না! পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর এগিয়ে চলাকে অহেতুক কারণে ভয় পায়! আধিপত্যবাদী পুরুষতন্ত্রের শেকল পরিয়ে নারীকে আর কতকাল অবরোধবাসিনী করে রাখবে এই অন্ধকারের কীট পশ্চাদগামীর দল?

মহাকালের ইতিহাসে এতদঞ্চলে নারীর প্রতি অবহেলা, সামাজিক নিপিড়নের বেদনাদগ্ধ ক্ষত মুছে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার এক নব যুগের প্রাণোচ্ছল প্রান্তরের দিশা দিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে আওয়ামী লীগ সরকারের এই সাফল্য দলমত নির্বিশেষে সবাইকে স্বীকার করতে হবে। গত একযুগ ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হলেও সামাজিক চিন্তাশক্তির, মানবিক মূল্যবোধের আশানুরূপ উন্নয়ন ঘটেনি। যার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এই আধুনিক যুগেও বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি। আমাদের সমাজের একদল স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ী পশ্চাদপদ চিন্তার ধারক ও বাহক পাকিস্তানি ভাবাদর্শ লালনকারী অপশক্তি।

যারা নারীকে অবরোধবাসিনী হিসেবে অন্দরমহলে আবদ্ধ রাখতে চিরকাল বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানারকম ফতোয়ার অবতারণা করে এসেছে। পুরাতন ফতোয়ার কার্যকারিতা মুখ থুবড়ে পড়লে আবার নতুন কোনো ফতোয়া নিয়ে উপস্থিত হয় এই গোষ্ঠী। মানুষের শক্তিশালীতম সত্তা ‘নারী’কে অবরুদ্ধ করতে যুগের পর যুগ নানান রকম ফতোয়া জারি করে তারা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতেও নারীজাতির সার্বিক মুক্তির পথের প্রধান প্রতিবন্ধকতা এই ধর্মব্যবসায়ী অপশক্তি। তাদের সব অপতৎপরতা পদদলিত করে বাঙালি নারী প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে। শিক্ষা-দীক্ষায় ও জ্ঞাণ-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ, সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অগ্রসরমান বাংলা মায়ের অমিত সম্ভাবনার আধার এদেশের নারী সমাজ। এই ডিজিটাল যুগে এসে শিক্ষিত সচেতন বাঙালি নারীকে কোনো ধর্মব্যবসায়ী কূপমন্ডুকের দল দাবায়ে রাখতে পারবে না।

চিরতারুণ্য ও যৌবনের জয়গান গেয়ে যাওয়া অমর মানবসত্তা বিদ্রোহী কবি হিসেবে সুবিদিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চিরবিদ্রোহী কাজী নজরুলকে অনুসরণ করে সমাজে নারী-পুরুষের সমঅধিকার সুনিশ্চিত হওয়ার চির প্রত্যাশা ব্যক্ত করে এদেশের তরুণ সমাজের কণ্ঠে অভিন্নসুরে উচ্চারিত হোক সাম্যবাদের অমোঘ মর্মবাণী:
‘‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাবি

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

টিপ ও হিজাব বিতর্কে সামাজিক ভাবনার স্বরূপ উন্মোচন

আপডেট সময় : ০৯:৫১:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ এপ্রিল ২০২২

ইয়াসির আরাফাত (তূর্য) : ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ প্রদানকালে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন: ‘আমার জীবনে আমি দেখেছি গুলির সামনে এগিয়ে গেলেও আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেননি। আমি ১০-১২ বছর জেল খেটেছি। জীবনে কোনোদিন মুখ খুলে তিনি (বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব) প্রতিবাদ করেননি। যদি করতেন তাহলে হয়তো আমার জীবনে অনেক বাধা আসত। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে। ইতিহাসে পুরুষের নাম লেখা হয়, নারীর নাম লেখা হয় না। তাই আপনাদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম।’

জাতির পিতার আত্মোপলব্ধি অনুসরণ করে নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা সম্মান প্রদান করলে পুরুষ মানুষের গৌরব মহিমা কমে না, বরং সমুন্নত হয়। নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার ও সম্মান প্রদান করলে কার্যত পুরুষ-ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়। কেননা একজন নারী দিন শেষে কোনো না কোনো পুরুষের কন্যা, কোনো না কোনো পুরুষের বোন, কোনো না কোনো পুরুষের স্ত্রী, সন্তানের মা। তাই কন্যার সাফল্যে পিতার সমৃদ্ধি ঘটে, বোনের উন্নতির ইতিবাচক প্রভাব ভাইয়ের উপর পড়ে, স্ত্রীর মর্যাদা বাড়লের স্বামীর মর্যাদাও বাড়ে, মায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে সন্তানকেও কেউ অধিকারবঞ্চিত করতে পারে না।

শিক্ষা নিয়ে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের উপলব্ধি ‘শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।’ অর্থাৎ শিক্ষা মিথ্যাকে দূরীভূত করে সত্যের বিকাশ ঘটায়। বাংলাদেশে গত এক দশকে সরকারি বেসরকারি নানামুখি উদ্যোগে শিক্ষার হার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারিভাবে দেশব্যাপী কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে বছরের প্রথম দিনেই বিনামূল্যে নতুন বই ও শিক্ষা উপকরণ প্রদান, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান ও শিক্ষার প্রসারে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে ফলে শিক্ষা সহজলভ্য হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া প্রায় ৩০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষায় একটি অলিখিত বিপ্লব সাধিত হয়েছে যা দৃশ্যমান।

দেশ ও জাতি ইতোমধ্যে প্রগতির মহাসড়ক ধরে দুর্বার গতিতে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীর এগিয়ে চলার ইতিবাচক ফল পেতে শুরু করেছে। অবধারিতভাবেই দেশের প্রত্যেক সেক্টরে নেতৃত্ব প্রদানে এগিয়ে আসছে শিক্ষিত নারী। এ দেশে জ্ঞাণ-বিজ্ঞান ও শিক্ষার আলোয় আলোকিত একটি সচেতন প্রজন্ম তৈরি হয়ে গেলে শিক্ষা সম্পর্কে মহামতি সক্রেটিসের উপলব্ধির ন্যায় মিথ্যার বেসাতি নিয়ে সমাজকে অতিতের অন্ধকারের দিকে টেনে নিতে তৎপর স্বার্থান্ধদের মুখোশ খুলে যাবে। জাতির কাছে উন্মোচিত হয়ে পড়বে তাদের অন্তঃসারশূণ্য চিন্তাভাবনা, লালসালুর কঙ্কাল। সুশিক্ষিত জ্ঞানের আলোয় আলোকিত তরুণদের দ্বারা সত্যের মুক্তি নিশ্চিত হবে, মিথ্যাকে পদদলিত করে সূচিত হবে উন্নত সমাজের শুভ উদ্বোধন।

আজ থেকে ১১০ বছর পূর্বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অমরসৃষ্টি ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়িকা কুমুদিনীকে তাঁর স্বামী মধুসূদনকর্তৃক যৌন নিপিড়নের শিকার হয়ে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বড় ভাই বিপ্রদাশের কাছে আশ্রয় নিলে বিপ্রদাশ তাদের আত্মমর্যাদায় বলিয়ান মায়ের কথে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমার মা যে অপমান পেয়েছিলেন তাতে সমগ্র স্ত্রী জাতির অসম্মান। কুমু (কুমুদিনী) তুই নিজের কথা না ভেবে সেই অসম্মানের বিরুদ্ধে দাঁড়াবি। কিছুতেই হার মানবি না।’

নারীর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলে প্রকারান্তরে দেশ ও জাতি উন্নতির পথে অগ্রসর হয় সে সুন্দরতম সত্যকে উপলব্ধি করে জগদ্বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি দেব।’

গত এক দশকে সামগ্রিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অগ্রসরমান অভিযাত্রা দেশটির প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ আন্তর্জাতিক চক্র ও এদেশের পাকিস্তানপন্থী ধর্ম ব্যবসায়ীদের অনুভূতিতে প্রবল আঘাত হেনেছে। তাই দ্রুত অগ্রসরমান বাংলাদেশকে ঠেকাতে তাদের প্রধান ও সহজতম টার্গেটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের নারী সমাজ। কারণ বাংলাদেশের নারী সমাজকে কর্মক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত করতে পারলে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতির প্রায় ৫০ শতাংশ থামিয়ে দেয়া সম্ভব।

এ দেশে নারীদের ব্যবহার্য অনুষঙ্গ টিপ, হিজাব নিয়ে কুচর্চা হচ্ছে ধর্মের লেবাসধারী বাংলাদেশবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের ষড়যন্ত্রের, অপরাজনীতির অস্ত্র। তবে রহস্যের বিষয় হলো দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা নারীর প্রতি সামাজিক সহিংসতা রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানি নিয়ে ধর্মীয় মোড়লগণ তেমন একটা উচ্চবাচ্য করেন না। বাংলাদেশে প্রায় ৮৪ শতাংশ নারী প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে, শিক্ষাঙ্গনে, কর্মস্থলে এমনকি নিজ পরিবারে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন! প্রতিদিন দেশে গড়ে ৩ জনের বেশি নারী জোরপূর্বক পুরুষ কর্তৃক ধর্ষিত হচ্ছেন। ধর্ষণ হলো আগ্রাসী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পেশিশক্তির কদর্যতম প্রকাশ।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই কাপুরুষোচিত পরাজয় নিয়ে নারীকে চার দেয়ালে বন্দি করে স্রেফ দাসী হিসেবে দেখতে আগ্রহী ফতোয়াবাজ মোল্লারা খুব একটা সোচ্চার নন। এর কারণ কি তাহলে এই দাঁড়ালো যে, ধর্ম্যবসায়ীরা নারীর আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক মুক্তি ও আত্মমর্যাদায় তাদের অগ্রগতি মেনে নিতে পারছে না! পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর এগিয়ে চলাকে অহেতুক কারণে ভয় পায়! আধিপত্যবাদী পুরুষতন্ত্রের শেকল পরিয়ে নারীকে আর কতকাল অবরোধবাসিনী করে রাখবে এই অন্ধকারের কীট পশ্চাদগামীর দল?

মহাকালের ইতিহাসে এতদঞ্চলে নারীর প্রতি অবহেলা, সামাজিক নিপিড়নের বেদনাদগ্ধ ক্ষত মুছে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার এক নব যুগের প্রাণোচ্ছল প্রান্তরের দিশা দিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে আওয়ামী লীগ সরকারের এই সাফল্য দলমত নির্বিশেষে সবাইকে স্বীকার করতে হবে। গত একযুগ ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হলেও সামাজিক চিন্তাশক্তির, মানবিক মূল্যবোধের আশানুরূপ উন্নয়ন ঘটেনি। যার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এই আধুনিক যুগেও বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি। আমাদের সমাজের একদল স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ী পশ্চাদপদ চিন্তার ধারক ও বাহক পাকিস্তানি ভাবাদর্শ লালনকারী অপশক্তি।

যারা নারীকে অবরোধবাসিনী হিসেবে অন্দরমহলে আবদ্ধ রাখতে চিরকাল বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানারকম ফতোয়ার অবতারণা করে এসেছে। পুরাতন ফতোয়ার কার্যকারিতা মুখ থুবড়ে পড়লে আবার নতুন কোনো ফতোয়া নিয়ে উপস্থিত হয় এই গোষ্ঠী। মানুষের শক্তিশালীতম সত্তা ‘নারী’কে অবরুদ্ধ করতে যুগের পর যুগ নানান রকম ফতোয়া জারি করে তারা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতেও নারীজাতির সার্বিক মুক্তির পথের প্রধান প্রতিবন্ধকতা এই ধর্মব্যবসায়ী অপশক্তি। তাদের সব অপতৎপরতা পদদলিত করে বাঙালি নারী প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে। শিক্ষা-দীক্ষায় ও জ্ঞাণ-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ, সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অগ্রসরমান বাংলা মায়ের অমিত সম্ভাবনার আধার এদেশের নারী সমাজ। এই ডিজিটাল যুগে এসে শিক্ষিত সচেতন বাঙালি নারীকে কোনো ধর্মব্যবসায়ী কূপমন্ডুকের দল দাবায়ে রাখতে পারবে না।

চিরতারুণ্য ও যৌবনের জয়গান গেয়ে যাওয়া অমর মানবসত্তা বিদ্রোহী কবি হিসেবে সুবিদিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চিরবিদ্রোহী কাজী নজরুলকে অনুসরণ করে সমাজে নারী-পুরুষের সমঅধিকার সুনিশ্চিত হওয়ার চির প্রত্যাশা ব্যক্ত করে এদেশের তরুণ সমাজের কণ্ঠে অভিন্নসুরে উচ্চারিত হোক সাম্যবাদের অমোঘ মর্মবাণী:
‘‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাবি